Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ বার নতুন ঠিকানার খোঁজে মার্কিন দূতাবাস

ঠিকানা বদলাচ্ছে কলকাতার মার্কিন কনস্যুলেট। হো চি মিন সরণি ছেড়ে শহরের অন্য কোথাও এই দফতর স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মার্কিন বিদেশ মন্ত্রক। শহরের মধ্যে উপযুক্ত জায়গা না পাওয়া গেলে কলকাতার উপকণ্ঠেও কনস্যুলেট নিয়ে যেতে রাজি আমেরিকা। এ নিয়ে রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার জন্য আগামী ২ মার্চ ওয়াশিংটন থেকে শহরে আসবেন বারাক ওবামা প্রশাসনের প্রতিনিধিরা।

হো চি মিন সরণির বর্তমান ঠিকানা। ছবি:  দেবস্মিতা চক্রবর্তী।

হো চি মিন সরণির বর্তমান ঠিকানা। ছবি: দেবস্মিতা চক্রবর্তী।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৪৮
Share: Save:

ঠিকানা বদলাচ্ছে কলকাতার মার্কিন কনস্যুলেট।

হো চি মিন সরণি ছেড়ে শহরের অন্য কোথাও এই দফতর স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মার্কিন বিদেশ মন্ত্রক। শহরের মধ্যে উপযুক্ত জায়গা না পাওয়া গেলে কলকাতার উপকণ্ঠেও কনস্যুলেট নিয়ে যেতে রাজি আমেরিকা। এ নিয়ে রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার জন্য আগামী ২ মার্চ ওয়াশিংটন থেকে শহরে আসবেন বারাক ওবামা প্রশাসনের প্রতিনিধিরা। বৈঠকের ব্যাপারে ছাড়পত্র চেয়ে নবান্ন থেকে ইতিমধ্যেই বিদেশ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে আর্জি জানানো হয়েছে। সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, ইতিমধ্যেই মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনায় বসার ছাড়পত্রও দিয়েছে বিদেশ মন্ত্রক। রাজ্য সরকারের তরফে পরিবহণ সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে ওই বৈঠক সঞ্চালনার দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে। তবে বিদেশ মন্ত্রকের তরফে স্পষ্ট করে জানানো হয়েছে, বৈঠকে মার্কিন সদস্যদের কাছে কোনও আগাম প্রতিশ্রুতি যেন না দেওয়া হয়।

সূত্রের খবর, গত ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতার মার্কিন কনস্যুলেটের ভাইস-কনসাল অ্যান্ড্রু এফ রায়ান রাজ্য সরকারকে চিঠি লিখে মার্কিন প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। চিঠিতে রায়ান লিখেছেন, “মার্কিন কনসাল জেনারেল কলকাতা বা সংলগ্ন এলাকায় নতুন কনস্যুলেট অফিসের জন্য জায়গা খুঁজছেন। সে জন্য ওয়াশিংটন থেকে আসা ‘নিউ সাইট অ্যাকুইজিশন টিম’-এর সদস্যরা পরিকাঠামোর বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চান।”

যদিও ওই চিঠিতে হো চি মিন সরণি থেকে অফিস সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কারণ জানানো হয়নি। তবে রাজ্য প্রশাসন এবং নিরাপত্তা এজেন্সি সূত্রের খবর, বর্তমানে মধ্য কলকাতার যে এলাকায় মার্কিন কনস্যুলেট রয়েছে সেখানে নিরাপত্তা একটি বড় সমস্যা। গত কয়েক বছরে ওই অফিসের চারপাশে এমন বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে যাতে মার্কিন কনস্যুলেটের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ২০০২ সালে আমেরিকান সেন্টারের সামনে জঙ্গি হামলা হয়। তসলিমা নাসরিনকে শহরে থাকতে না দেওয়ার দাবিতে ২০০৭ সালে যে বিক্ষোভ হয়, তা মূলত মার্কিন কনস্যুলেট অফিস থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বেই শুরু হয়। তার পরের কয়েক বছরেও এই কনস্যুলেটকে লক্ষ্য করে বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠনের বিক্ষোভ হয়েছে কয়েক বার। ২০১৪ সালে একটি মৌলবাদী সংগঠনের মিছিল-সমাবেশের কর্মসূচির দিনে আমেরিকান সেন্টার এবং দূতাবাস কর্মীদের অফিসে আসতে বারণ করে দেন কনস্যুলেট কর্তৃপক্ষ। ২০১১ সালের জুন মাসে তৎকালীন মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টনের কলকাতা সফরের সময়েও মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থাগুলি কনস্যুলেট সংলগ্ন এলাকায় নিরাপত্তার অভাব সংক্রান্ত প্রশ্ন তুলেছিল। ফলে মনে করা হচ্ছে, বর্তমানে রাজ্যের সার্বিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেই তুলনামূলক ভাবে সুরক্ষিত কোনও জায়গায় কনস্যুলেট সরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে মার্কিন প্রশাসন। যদিও এই ঠিকানা বদলের কারণ নিয়ে কোনও ব্যাখ্যা দিতে চাননি কনস্যুলেট কর্তৃপক্ষ। তবে সেখানকার এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, আমেরিকার বিদেশ দফতর কলকাতায় একটি নতুন কনস্যুলেট চত্বর নির্মাণের জন্য কাজ শুরু করেছে ইতিমধ্যেই।

মার্কিন দূতাবাস সূত্রের খবর, নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ঘেরাটোপে কনস্যুলেট অফিস তৈরির জন্য যে পরিমাণ জমি দরকার তা কলকাতা শহরের মধ্যেই খোঁজার চেষ্টা হচ্ছে। তা না পাওয়া গেলে নিউটাউনে অফিস স্থানান্তর নিয়েও মার্কিন প্রশাসন ভাবনাচিন্তা করছে। প্রস্তাবিত এই নতুন অফিস চত্বরে কনস্যুলেটের পাশাপাশি স্থানান্তরিত করা হবে আমেরিকান সেন্টারকেও।

দূতাবাস সূত্রের খবর, কলকাতার এই মার্কিন কনস্যুলেট আমেরিকার প্রাচীনতম কূটনৈতিক দফতরগুলির অন্যতম। ১৭৯২ সালে মার্কিন প্রশাসন কলকাতায় এই কনস্যুলেট খোলার সিদ্ধান্ত নেয়। তার দু’বছর পর বেঞ্জামিন জয় নামে এক কূটনীতিককে কলকাতার প্রথম কনসাল নিয়োগ করেন তৎকালীন মার্কিন প্রসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন। তবে ৫/১, হো চি মিন সরণির এই অফিস চলছে প্রায় ৫০ বছর। আগে ওই এলাকারই একটি বাড়িতে কনস্যুলেট অফিস ছিল। তখন অবশ্য ওই রাস্তার নাম ছিল হ্যারিংটন স্ট্রিট। পরে ভিয়েতনাম যুদ্ধের স্মরণে সে দেশের কমিউনিস্ট নেতা হো চি মিনের নামে এই রাস্তার নামকরণ করে বামফ্রন্ট সরকার। আর জওহরলাল নেহরু রোডের আমেরিকান সেন্টারের ভবনটির উদ্বোধন হয়েছিল ১৯৯১ সালে। তার আগে ‘ইউনাইটেড স্টেটস ইনফরমেশন সার্ভিস’ নামে এই অফিসটি ছিল ধর্মতলার মেট্রোপলিটন বিল্ডিংয়ে। তবে ২০০২-এ আমেরিকান সেন্টারের নতুন ভবনের সামনে জঙ্গি হামলায় নিহত হন পাঁচ পুলিশ কর্মী। মার্কিন কনস্যুলেট এবং আমেরিকান সেন্টারের অবস্থান নিয়ে সুরক্ষার প্রশ্ন যে বার বারই উঠেছে তা-ও গত কয়েক বছরের ঘটনাক্রমে স্পষ্ট।

কর্তৃপক্ষ স্পষ্ট করে ঠাঁই বদলের কারণ না জানালেও দূতাবাসের তথ্যই জানাচ্ছে, নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে আগেও দেশের একাধিক জায়গায় শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মার্কিন কনস্যুলেট। যেমন, নিরাপত্তার কারণে ২০১১ সালে মুম্বইয়েও একই ভাবে শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে কনস্যুলেট সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৩৮ সাল থেকে মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডিতে অবস্থিত মহারাজা ওয়াঙ্কানের প্যালেসে আমেরিকার কনসাল জেনারেলের অফিস ছিল। আর চার্চগেট এলাকায় ছিল আমেরিকান সেন্টারের অফিস। পরবর্তীকালে বান্দ্রা-কুর্লা কমপ্লেক্সে কনস্যুলেট অফিস এবং আমেরিকান সেন্টার সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ওয়াশিংটন। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ২০০৮ সালের ২৬/১১ হামলাই ছিল ওই শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে অফিস স্থানান্তরের মূল কারণ। দেখা গিয়েছে, পাকিস্তানের করাচি, পেশোয়ার, আফগানিস্তানের হেরাট, লিবিয়ার বেনগাজি, ইয়েমেনের সানা, টিউনিস-সহ যেখানেই মার্কিন দূতাবাসে জঙ্গি হামলা হয়েছে, সেগুলি সবই ছিল শহরের কেন্দ্রস্থলে। প্রাণকেন্দ্রের পরিবর্তে শহরের উপকণ্ঠে কনস্যুলেট থাকলে তা আরও বেশি সুরক্ষিত হবে বলেই বিশেষজ্ঞদের অনেকের ধারণা। সম্ভবত সেই কারণেই মুম্বইয়ের পর হায়দরাবাদেও কনস্যুলেট অফিস সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মার্কিন প্রশাসন। এ বার পালা কলকাতার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE