Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Relief Fund

ভেঙেছে সেতু, ত্রাণটুকুও পায়নি বিচ্ছিন্ন গ্রাম

প্রবল জলোচ্ছ্বাসে ওই সেতু ভেঙেই ১০ দিন ধরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হরিপুর। কাঁথি-১ ব্লকের অন্তর্গত হরিপুর মৎস্য খটি এলাকার বাসিন্দা চৈতন্য।

জলোচ্ছ্বাসে ভেঙেছে হরিপুরে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম সেতু।

জলোচ্ছ্বাসে ভেঙেছে হরিপুরে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম সেতু। নিজস্ব চিত্র।

কেশব মান্না
কাঁথি শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০২১ ০৬:১০
Share: Save:

খরতাপে পুড়ছে চারপাশ। খড়ের ছাউনি আর বাঁশ দিয়ে ঘেরা চিলতে বাড়িটার ভাঙাচোরা দশা। তারই বারান্দায় বসে মেঝে সমান করছিলেন বছর চল্লিশের চৈতন্য দালাল। চারদিক নিঝুম। সেই নিস্তব্ধতা খানখান করে চৈতন্য বলে উঠলেন, ‘‘ইয়াসের দিন সমুদ্রের জল বুক সমান হয়ে বাড়িতে ঢুকেছিল। আমাকেও ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। গ্রামে ঢোকার মুখে সেতুর ভাঙা অংশে আটকে কোনও রকমে বেঁচেছি।’’

প্রবল জলোচ্ছ্বাসে ওই সেতু ভেঙেই ১০ দিন ধরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হরিপুর। কাঁথি-১ ব্লকের অন্তর্গত হরিপুর মৎস্য খটি এলাকার বাসিন্দা চৈতন্য। পূর্ব মেদিনীপুরের সাগর তীরের এই এলাকায় একসময় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে চেয়েছিল তৎকালীন বাম সরকার। স্থানীয়দের আন্দোলনে শেষমেশ তা হয়নি। সেই হরিপুরই ইয়াসের ধাক্কায় সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে ছারখার হয়ে গিয়েছে। ছোট ছোট ঘরের বেশির ভাগ স্রোতে ভেসে গিয়েছে। জলের তোড়েই ভেঙেছে এই খটি এলাকায় যাতায়াতের পাকা সেতু। বিক্ষিপ্ত ভাবে ইটের কাঠামোটুকু শুধু দাঁড়িয়ে আছে।

কোনওরকমে খাল পেরিয়ে আধ কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছতে হল হরিপুর। প্রায় জনমানবশূন্য এলাকা। ইতিউতি ছড়িয়ে কয়েকটা ভাঙাচোরা নৌকা। বালির উপর ছিঁড়ে পড়ে আছে বিদ্যুতের তার। গ্রামের গোটা পঞ্চাশেক ঘরে মূলত মৎস্যজীবীরাই সপরিবার থাকেন। মাছ ধরা এবং শুকনো করার সময় অনেকে বাড়ি ছেড়ে এখানে এসে থাকেন। আবার অনেকের এটাই স্থায়ী ঠিকানা। যেমন চৈতন্য। প্রায় চার দশক এখানেই রয়েছেন তিনি। খড়-মাটির ঘরের ছাউনিটা ঠিক রয়েছে। বাকি সব ভেঙেছে। চৈতন্যর স্ত্রী বললেন, ‘‘হাঁড়ি, কড়াইও ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। জল নামার পরে অনেকটা দূর থেকে গিয়ে কুড়িয়ে এনেছি।’’ চৈতন্য অবশ্য খুঁজে পাননি তাঁর বাঁচার রসদ নৌকাখানা। বলছেন, ‘‘কে জানে জলের ঝাপটায় কোথায় গিয়ে পড়েছে! আদৌ আস্ত আছে কি না!’’

এখনও পর্যন্ত সরকারি ভাবে ত্রাণ পৌঁছয়নি গ্রামে। দিন তিনেক কাঁথি থেকে রেড ভলান্টিয়ার্সরা গিয়ে রান্না করা খাবার দিয়ে এসেছিলেন। ব্যস ওইটুকুই। আর বাড়িতে আছে নোনা জল। বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে ‘দুয়ারে ত্রাণ’ কর্মসূচি। তবে ক্ষয়ক্ষতির অঙ্ক জানিয়ে এখনও আবেদন করার অবস্থায় নেই হরিপুরের বাসিন্দারা। কাঁথি ১-এর বিডিও তুহিনকান্তি ঘোষ বলেন, "সেতু ভেঙে যাওয়ায় ওই গ্রামে পৌঁছতে সমস্যা হচ্ছে। তবে গ্রামের প্রতিনিধি কেউ ব্লক অফিসে এলে ত্রাণ দেওয়া হবে।" বিডিও আরও জানালেন, সেচ ও মৎস্য দফতরের মধ্যে সমন্বয় রেখে সেতু নির্মাণের প্রক্রিয়া প্রশাসনিক ভাবে শুরু হয়ে গিয়েছে। আপাতত বর্ষাকালের কথা মাথায় রেখে কাঠের সাঁকো বানিয়ে দেওয়া হবে।

তিন কিলোমিটার দূরে জুনপুট। সেখানেও মৎস্যজীবীদের হাহাকার। খালি গায়ে লুঙ্গি পরে কাদামাটির মধ্যে মিশে থাকা একটা ব্যাগ বের করার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছিলেন পঞ্চাশ পেরনো মনোরঞ্জন মাইতি। বললেন, ‘‘বাড়ির তিন জনের রেশন কার্ডই ভেসে গিয়েছে। এ সপ্তাহে রেশনের চালটুকু পেলাম না।’’ জলোচ্ছ্বাসের পরে অধিকাংশেরই বাড়ির মজুত চাল নষ্ট হয়ে গিয়েছে। খিদে সয়েই চলছে জীবন-যুদ্ধ। ভুপতিনগর থানার চম্পাইনগর থেকে স্ত্রী আর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে জুনপুটে এসে মনোরঞ্জন ঘর বেঁধেছেন বহু বছর আগে। প্রৌঢ়ের কথায়, ‘‘সমুদ্রের এমন ভয়ঙ্কর চেহারা দেখিনি কখনও। গোঁ গোঁ আওয়াজ করে যে ভাবে জল ঢুকল, প্রাণে বাঁচতে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলাম। শ্রমিকের কাজে যেটুকু রোজগার করি তা দিয়ে ৫০ কেজি চাল কিনে রেখেছিলাম। কিন্তু এখন বাড়িতে এক কণাও চাল নেই।"

জল সরলেও ক্ষতচিহ্ন ছড়িয়ে উপকূল জুড়ে। মাছ শুকনো করার মাচা ভেঙে রয়েছে, উল্টে পড়ে ভাঙা নৌকা। সে সব ধ্বংসচিত্রের দিতে তাকিয়ে এক যুবক বলে উঠলেন, ‘‘ঠাকুরদা বলে গিয়েছিলেন সমুদ্র কিছুই নেয় না। সব ফেরত দিয়ে দেয়। কই আমাদের তো কিছুই ফেরাল না!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Contai Relief Fund
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE