খরতাপে পুড়ছে চারপাশ। খড়ের ছাউনি আর বাঁশ দিয়ে ঘেরা চিলতে বাড়িটার ভাঙাচোরা দশা। তারই বারান্দায় বসে মেঝে সমান করছিলেন বছর চল্লিশের চৈতন্য দালাল। চারদিক নিঝুম। সেই নিস্তব্ধতা খানখান করে চৈতন্য বলে উঠলেন, ‘‘ইয়াসের দিন সমুদ্রের জল বুক সমান হয়ে বাড়িতে ঢুকেছিল। আমাকেও ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। গ্রামে ঢোকার মুখে সেতুর ভাঙা অংশে আটকে কোনও রকমে বেঁচেছি।’’
প্রবল জলোচ্ছ্বাসে ওই সেতু ভেঙেই ১০ দিন ধরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হরিপুর। কাঁথি-১ ব্লকের অন্তর্গত হরিপুর মৎস্য খটি এলাকার বাসিন্দা চৈতন্য। পূর্ব মেদিনীপুরের সাগর তীরের এই এলাকায় একসময় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে চেয়েছিল তৎকালীন বাম সরকার। স্থানীয়দের আন্দোলনে শেষমেশ তা হয়নি। সেই হরিপুরই ইয়াসের ধাক্কায় সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে ছারখার হয়ে গিয়েছে। ছোট ছোট ঘরের বেশির ভাগ স্রোতে ভেসে গিয়েছে। জলের তোড়েই ভেঙেছে এই খটি এলাকায় যাতায়াতের পাকা সেতু। বিক্ষিপ্ত ভাবে ইটের কাঠামোটুকু শুধু দাঁড়িয়ে আছে।
কোনওরকমে খাল পেরিয়ে আধ কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছতে হল হরিপুর। প্রায় জনমানবশূন্য এলাকা। ইতিউতি ছড়িয়ে কয়েকটা ভাঙাচোরা নৌকা। বালির উপর ছিঁড়ে পড়ে আছে বিদ্যুতের তার। গ্রামের গোটা পঞ্চাশেক ঘরে মূলত মৎস্যজীবীরাই সপরিবার থাকেন। মাছ ধরা এবং শুকনো করার সময় অনেকে বাড়ি ছেড়ে এখানে এসে থাকেন। আবার অনেকের এটাই স্থায়ী ঠিকানা। যেমন চৈতন্য। প্রায় চার দশক এখানেই রয়েছেন তিনি। খড়-মাটির ঘরের ছাউনিটা ঠিক রয়েছে। বাকি সব ভেঙেছে। চৈতন্যর স্ত্রী বললেন, ‘‘হাঁড়ি, কড়াইও ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। জল নামার পরে অনেকটা দূর থেকে গিয়ে কুড়িয়ে এনেছি।’’ চৈতন্য অবশ্য খুঁজে পাননি তাঁর বাঁচার রসদ নৌকাখানা। বলছেন, ‘‘কে জানে জলের ঝাপটায় কোথায় গিয়ে পড়েছে! আদৌ আস্ত আছে কি না!’’