Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
এসএসসি-র নিয়োগে অনিয়ম। কী ভাবে ফাঁস হল বেআইনি নিয়োগের
West Bengal SSC Scam

SSC Scam: খালি খাতার মজাই আলাদা, দাবি অডিয়োয়

এসএসসি নবম থেকে দ্বাদশের চাকরিপ্রার্থীরা জানাচ্ছেন,  ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁরা চাকরির দাবিতে প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন।

বিক্ষোভকারী চাকরিপ্রার্থীরা।

বিক্ষোভকারী চাকরিপ্রার্থীরা। ফাইল চিত্র।

আর্যভট্ট খান
শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০২২ ০৫:৫১
Share: Save:

আন্দোলন শুরু হওয়ার পরেও ‘ইঁদুর পচেছে’।

এসএসসি নবম থেকে দ্বাদশের চাকরিপ্রার্থীরা জানাচ্ছেন, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁরা চাকরির দাবিতে প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন। টানা ২৭ দিন অনশনের পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় মঞ্চে এসে তাঁদের চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে অনশন তুলে নিতে বলেছিলেন। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে বিকাশ ভবনের কর্তাদের কথা বলার জন্য চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে থেকেই একটি পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেও দেওয়া হয়। চাকরিপ্রার্থী অভিষেক সেন বলেন, “দেখা গেল, ওই কমিটির সব চাকরিপ্রার্থীদের স্কুলে চাকরি হয়ে গেল। এবং তাঁদের মধ্যে এমন কয়েক জন আছেন, যাঁদের ওয়েটিং লিস্টে র‌্যাঙ্ক আমাদের থেকে অনেকটাই নীচে।”

অভিষেক জানাচ্ছেন, সেই সময়ে তাঁদের যুব ছাত্র অধিকার মঞ্চের সভাপতি বিকাশ ভবনের ঠিক করে দেওয়া ওই কমিটিতে ছিলেন। ওই প্রার্থী ইতিহাসে মেল-ফিমেল ক্যাটেগরিতে ওয়েটিং লিস্টে ১৪৪ নম্বরে ছিলেন। ওই একই বিষয়ের মেল-ফিমেল ক্যাটেগরিতে থাকা এক চাকরিপ্রার্থী সেতাবুদ্দিন জানান, তাঁদের কয়েক জনের র‌্যাঙ্ক ছিল ১৪৪ র‌্যাঙ্কধারীর আগে। তাঁরা আরটিআই করে ওই ওয়েটিং লিস্টের ১৪৪ র‌্যাঙ্কধারীর রেকমেন্ডেশন লেটারের মেমো নম্বর এবং অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারের মেমো নম্বর জোগাড় করে মামলা করেন। সেই মামলার নম্বর wpa 13700/ 2021। এ ক্ষেত্রেও এসএসসি ভুল স্বীকার করে এবং ওই প্রার্থীর চাকরি বাতিল হয়।

চাকরিপ্রার্থীদের দাবি, প্রায় প্রতিটি বিষয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘ভুল’ স্বীকার করেছে এসএসসি। তাঁদের প্রশ্ন, এত ভুল কেন? যে সব প্রার্থীদের ‘ভুল’ করে নিয়োগ করা হয়েছে, তাঁদের কেউ কমিশন বা বিকাশ ভবনের কাছের লোক বলে জানা যায়নি। তবু কেন ‘ভুল করে’ তাঁদের চাকরি হচ্ছে? চাকরিপ্রার্থীদের অভিযোগ, আর্থিক লেনদেনই এই ‘ভুলের’ মূলে। মেধা তালিকায় অনিয়ম করে চাকরি পাইয়ে দেওয়া, মেধা তালিকায় নাম না থেকেও চাকরি, এমনকি, পাশ না করেও চাকরি— এই সবই হয়েছে মোটা টাকার বিনিময়ে।

কেন এমন বলছেন তাঁরা। উচ্চ প্রাথমিকের (পঞ্চম থেকে অষ্টম) চাকরিপ্রার্থী সুশান্ত ঘোষ জানান, ২০১৬ সালে উচ্চ প্রাথমিক লিখিত পরীক্ষা হয়, ইন্টারভিউ হয় তারপর মেধা তালিকাও বেরোয়। কিন্তু সেই মেধা তালিকা হাইকোর্ট বাতিল করে দেয় ২০২০ সালের ১১ ডিসেম্বর। সুশান্তের কথায়, “যারা টাকার বিনিময়ে মেধা তালিকায় নাম তুলেছিল, তালিকা বাতিল হওয়ায় তাদের মাথায় হাত পড়ে। বালুরঘাট, রায়গঞ্জ, তেহট্ট, করিমপুর বারাসতে বিভিন্ন এজেন্টের বাড়িতে টাকা ফেরত নিতে চড়াও হয় তারা। এমনকি, টাকা ফেরত চেয়ে বিক্ষোভও দেখায়। সুতরাং টাকার বিনিময়ে যে মেধা তালিকায় নাম উঠেছিল, তা তো স্পষ্ট।”

নবম থেকে দ্বাদশের চাকরিপ্রার্থী অভিষেক সেন জানান, শুধু টাকা ফেরত চেয়ে বিক্ষোভই নয়, এক প্রার্থীর সঙ্গে এক এজেন্টের অডিয়ো টেপও প্রকাশিত হয়েছে। আইনজীবী ফিরদৌস শামিম সেই অডিয়ো টেপ বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে বাজিয়েছিলেন। আইনজীবী ফিরদৌস শামিমও জানান, সে দিন নবম-দশমে ভুয়ো নিয়োগের প্রার্থীর মামলা বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে উঠেছিল। টাকার বিনিময়ে নিয়োগের প্রমাণ হিসাবে তিনি ওই অডিয়ো টেপটি শোনান বিচারপতিকে।

ওই টেপে (অডিয়ো টেপের সত্যতা অবশ্য আনন্দবাজার যাচাই করেনি।) বলতে শোনা যায়, এক জন এজেন্ট বাংলার নবম-দশমের এক মহিলা চাকরিপ্রার্থীকে ফোনে বলছেন, ‘‘তুমি পাস ক্যান্ডিডেট? তুমি ওয়েটিং-এ যেহেতু আছো, ১৮ লাখ দিলেই হয়ে যাবে। তোমাকে আমি আট দিনের মধ্যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট তুলে দেব। স্কুল খুললেই জয়েন করবে।’’ ওই এজেন্ট জানায়, যাদের মেধা তালিকা ওয়েটিং-এ নাম নেই, তাদের ২০ লক্ষ লাগবে। তাঁকে এ-ও বলতে শোনা যায়, ‘‘তুমি যদি আমাদের খালি খাতা দিতে, তা হলে তোমাকে ওয়েটিং-এ থাকতে হত না। খালি খাতার মজাই আলাদা।’’

মজা বলে মজা! জানা গিয়েছে, লিখিত পরীক্ষার ওএমআর শিটে কিছু না লিখে এসে সাদা খাতা জমা দিলে সেই ওএমআর শিট পূরণ করারও ব্যবস্থা আছে। প্রার্থী সাদা খাতা জমা দেবেন, পরে অন্য কেউ ওএমআর শিট পূরণ করে দেবেন। সাদা খাতা জমা দেওয়ার সুবিধা হল, পরে কেউ চ্যালেঞ্জও করতে পারবে না। কারণ, পরে যিনি বেনিয়ম করে ওএমআর শিট পূরণ করছেন, তিনি সব উত্তরই ঠিক লিখছেন। ফলে কিস্তি মাত!

অডিয়োক্লিপে ইঙ্গিত রয়েছে আরও কেলেঙ্কারির। অডিয়োয় ওই ব্যক্তিকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘এক দিনেই দিয়েছিল (নিয়োগপত্র) ২২০ জনকে। ওয়েস্টবেঙ্গলের ২২০ জন ফেল কেসকে (নিয়োগপত্র) দেওয়া হয়েছিল। এ বার সব জোগাড় করা হচ্ছে। আর একটা দিন ফেল কেস (পরীক্ষায় ব্যর্থদের নিয়োগপত্র) দেওয়া হবে। কিন্তু বর্তমানে নিয়ম করে দিয়েছে, ওয়েস্ট বেঙ্গলের বিএড হতে হবে। বাইরের বিএড হবে না।’’

তারপরেই ওই এজেন্টকে বলতে শোনা যায়, ‘‘ তোমার বন্ধুবান্ধবের মধ্যে ওয়েস্ট বেঙ্গলের বিএড দাও না। যে কোনও সাবজেক্টের। তুমি নম্বর দাও না। আমরাই জোগাড় করে বাড়িতে ডেকে নেব। এক সঙ্গে কুড়ি জনকে দিয়েছিলাম।’’ এ-ও তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘‘অ্যাপয়েন্টমেন্ট অথেন্টিক করি। এটা নিয়ে কোনও টেনশন নেই।’’ ওই মহিলা তখন জানান, বাড়ির সঙ্গে কথা বলে দেখতে হবে। এতগুলো টাকার ব্যাপার।

অডিয়ো টেপে যে মহিলা কণ্ঠ শোনা যায়, তাঁর নম্বরে ফোন করা হলে এক মহিলা ফোন ধরেন। নিজেকে ওই মহিলার দিদি বলে পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন, “আমার বোন অসুস্থ। সংবাদমাধ্যমকে কিছু বলছেন না। যা বলার, ওঁর উকিল ফিরদৌস শামিমকে বলবেন।” ফিরদৌস বলেন, “অডিয়োর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ নেই। ওই প্রার্থীর কাছে টাকার বিনিময়ে চাকরির ওই এজেন্টের ফোন এসেছিল ২০২১ সালের ২ জুনে। এজেন্ট এবং প্রার্থী দু’জনেই পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার বাসিন্দা। যেহেতু একই জায়গার বাসিন্দা, তাই নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশ করছি না। কিন্তু টাকার বিনিময়ে চক্র যে চলছে, তা ওই অডিয়ো টেপ থেকে বলাই যায়।”

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।

অন্য বিষয়গুলি:

West Bengal SSC Scam ssc candidate agent
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE