Advertisement
E-Paper

রামমোহন রায়কে ‘দালাল’ বলে বঙ্গ বিজেপির রক্তচাপ বাড়িয়ে দিলেন মধ্যপ্রদেশের শিক্ষামন্ত্রী! ক্ষমা চাইলেন দিল্লির ধমক খেয়ে

সমাজ এবং ধর্মীয় সংস্কারক হিসাবে বিশ্বজোড়া পরিচিতি রামমোহনের। তাঁর সম্পর্কে এমন মন্তব্যকে স্বাভাবিক ভাবেই ‘অস্ত্র’ করেছে তৃণমূল। ‘বাঙালি বিদ্বেষী’ বলে বিজেপি-কে তারা যে তকমা দিয়ে থাকে, তা আরও জোরালো করছে বঙ্গের শাসকদল।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২৫ ২৩:১৫
রাজা রামমোহন রায়কে নিয়ে মন্তব্যে অস্বস্তিতে বঙ্গ-বিজেপি। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

রাজা রামমোহন রায়কে নিয়ে মন্তব্যে অস্বস্তিতে বঙ্গ-বিজেপি। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

‘বাংলা এবং বাঙালি অস্মিতা’র ভাষ্যকে সামনে রেখেই তৃণমূল যে ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে লড়তে নামছে, তা মোটামুটি স্পষ্ট। শাসকদলের নেতারা তা নিয়ে নিত্যদিন আক্রমণ শানাচ্ছেন বিজেপির বিরুদ্ধে। সেই আবহে বাঙালি মনীষী, বাংলার নবজাগরণের দূত রাজা রামমোহন রায়কে ‘ব্রিটিশদের দালাল’ বলে মন্তব্য করে রাজ্যের পদ্মশিবিরের রক্তচাপ বাড়িয়ে দিলেন বিজেপিশাসিত মধ্যপ্রদেশের উচ্চশিক্ষামন্ত্রী। প্রাথমিক ভাবে পরিস্থিতি এমন দিকে গড়িয়েছিল যে, রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের কেউ প্রকাশ্যে মুখই খুলছিলেন না বিষয়টি নিয়ে। পরে যদিও বিবৃতি মেলে। মধ্যপ্রদেশের মন্ত্রীর মন্তব্যের তীব্র নিন্দাই করেছেন রাজ্য বিজেপির সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য। তিনি মনে করেন, এই মন্তব্যের প্রতিবাদ হওয়াই উচিত।

প্রকাশ্যে ক্ষমাও চেয়েছেন মধ্যপ্রদেশের ওই মন্ত্রী ইন্দর সিংহ পারমার। বিজেপি সূত্রেই খবর, ভোটমুখী বঙ্গে তাঁর ওই মন্তব্যের গভীর অভিঘাত উপলব্ধি করেই হস্তক্ষেপ করেছিলেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। শেষমেশ দিল্লিই ধমক দিয়ে, মন্ত্রীকে ক্ষমা চাইতে বলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছে।

বিরসা মুন্ডার সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে গিয়ে পারমার দাবি করেছিলেন, ঔপনিবেশিক শাসনকালে ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে জনগণের বিশ্বাস পরিবর্তনের জন্য যাঁরা কাজ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রামমোহন। তাঁর মতে, ‘‘বাংলা এবং আশপাশের অঞ্চলে ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে সে সময় মানুষের বিশ্বাস পরিবর্তনের জন্য একটি চক্র কাজ কাজ করছিল। ব্রিটিশেরা বেশ কয়েক জন ভারতীয়কে ভুয়ো সমাজ সংস্কারক হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন। রাজা রামমোহন রায় ছিলেন তাঁদের মধ্যে এক জন, যিনি ব্রিটিশদের দালাল হিসাবে কাজ করতেন।’’

সমাজ এবং ধর্মীয় সংস্কারক হিসাবে বিশ্বজোড়া পরিচিতি রামমোহনের। ইতিহাসবিদদের মত, দেশের মানুষকে অতীতমুখী, মধ্যযুগীয় মানসিকতার গণ্ডি থেকে বার করে এনে এক নতুন যুগের জীবন দর্শনের আলো দেখানোই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। রামমোহনই প্রথম বাঙালি তথা ভারতীয় মনীষী, যিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রের আড়ালে থাকা জ্ঞানবিজ্ঞান এ দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে। যদিও ব্রিটিশদের শোষণনীতি তিনি কখনও সমর্থন করেননি। এক আধুনিক ভারতেরই স্বপ্ন দেখেছিলেন রামমোহন। সতীদাহ প্রথা বন্ধের নেপথ্যে কান্ডারিও ছিলেন তিনি। তাঁর সম্পর্কে এমন মন্তব্যকে স্বাভাবিক ভাবেই ‘অস্ত্র’ করেছে তৃণমূল। ‘বাঙালি বিদ্বেষী’ বলে বিজেপি-কে তারা যে তকমা দিয়ে থাকে, তা আরও জোরালো করছে বঙ্গের শাসকদল।

প্রাথমিক ভাবে তৃণমূলের এই আক্রমণের জবাব ছিল না রাজ্য বিজেপির কাছে। মুখে কার্যত কুলুপই এঁটেছিলেন রাজ্য নেতৃত্ব। দলীয় সূত্রে বলা হচ্ছিল, এ বিষয়ে যা বলার মধ্যপ্রদেশের বিজেপি নেতৃত্বই বলবেন। ঘটনাচক্রে, তার পরেই পারমারের একটি ভিডিয়োবার্তা প্রকাশ্যে আসে। তাতে নিজের মন্তব্যের জন্য দুঃখপ্রকাশ করে ক্ষমা চান মন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘বিরসা মুন্ডার জীবন নিয়ে কথা বলার সময় আমি ভুল করে রাজা রামমোহন রায় সম্পর্কে মুখ ফস্কে ভুল কথা বলে ফেলেছি। এর জন্য গভীর ভাবে দুঃক্ষিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী।’’ তাঁর মতে, রাজা রামমোহন রায় একজন ‘বিখ্যাত’ সমাজ সংস্কারক ছিলেন।

পরে শমীকও পারমারের মন্তব্যের নিন্দা করেন। এ-ও বলেন, তৃণমূল প্রতিবাদ করে ভালই করেছে। তবে পাশাপাশিই তাঁর বক্তব্য, শাসকদল যে ভাবে বিষয়টিকে উপস্থাপন করছে, তা অনুচিত। শমীকের কথায়, ‘‘মধ্যপ্রদেশের মন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন, আমরা তার তীব্র নিন্দা করছি এবং বিরোধিতা করছি। রাজা রামমোহন রায় সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে সমসাময়িক কালখণ্ডে তাঁর ভূমিকা এবং তাঁর সমাজ সচেতনতা সম্পর্কে বিশদে জানা দরকার। এই মন্তব্যের প্রতিবাদ হওয়া দরকার। শুধু বাংলার মানুষ প্রতিবাদ করবেন বা করছেন, এমন নয়। গোটা ভারতে যে কোনও সুস্থ, স্বাভাবিক, শিক্ষিত ব্যক্তিই এই মন্তব্যের প্রতিবাদ করছেন। তৃণমূল এর প্রতিবাদ করেছে। ভালই করেছে। কিন্তু তৃণমূল যে ভাবে বিষয়টিকে উপস্থাপিত করতে চাইছে, তা হাস্যকর।’’

বিজেপি সূত্রের খবর, পারমারের মন্তব্যকে মধ্যপ্রদেশের বিজেপি নেতৃত্বও অনুমোদন করেনি। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও ওই মন্তব্যে অসন্তুষ্ট হন। তাই রাজ্য নেতৃত্বের কাছ থেকে তো বটেই, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছ থেকেও পারমারকে ভর্ৎসনার মুখে পড়তে হয় বলে বিজেপি সূত্রের দাবি। ওই সূত্রের আরও দাবি, পারমার ক্ষমা চেয়েছেন আদতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশেই। বঙ্গ-বিজেপিও অবশ্য চুপ করে বসে ছিল না। মধ্যপ্রদেশের মন্ত্রীর এই মন্তব্য যে বাংলায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে, তার আঁচ পেয়ে বিষয়টি দিল্লিকে জানান রাজ্য নেতৃত্ব। তবে বিজেপি সূত্রের দাবি, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বাংলার নেতাদের প্রতিক্রিয়া পেয়ে সক্রিয় হয়েছিলেন, এমন নয়। রামমোহন সম্পর্কে এই মন্তব্যের পরিণাম কী হতে পারে, তার আশঙ্কা করে দিল্লিও নিজে থেকেই সক্রিয় হয়েছিল।

বিজেপির মোকাবিলায় ২০২১ সালের বিধানসভা ভোট থেকেই ‘বাঙালি গরিমা’কে হাতিয়ার করেছে তৃণমূল। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটেও তার অন্যথা হয়নি। ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগেও সেই প্রবণতায় বদল ঘটেনি। তার কিছু কারণও রয়েছে। সাম্প্রতিক কালে ভিন্‌ রাজ্যে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর হেনস্থার অভিযোগ উঠেছে। যাকে হাতিয়ার করেছে তৃণমূল। তার সঙ্গেই জুড়েছে বাংলার প্রতি কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগ। আবাস যোজনা, ১০০ দিনের কাজ-সহ বিভিন্ন প্রকল্পে কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না বলে অভিযোগ করে আসছে শাসকদল। সম্প্রতি রাজ্যে ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন বা এসআইআর শুরু হয়েছে। এই প্রক্রিয়া নিয়ে আতঙ্কে রাজ্যে অন্তত ১৫ জনের প্রাণ গিয়েছে বলে অভিযোগ তুলেও বিজেপিকে ‘বাঙালি বিরোধী’ তকমা দিতে ছাড়ছে তৃণমূল। এই পরিস্থিতিতে রামমোহনকে ‘ব্রিটিশদের দালাল’ বলে মন্তব্য আসলে ভোটের আগে শাসকদলের হাতে ‘বড় অস্ত্র’ তুলে দেওয়া বলেই মনে করছেন অনেকে।

বাস্তবে ঘটছেও তা-ই। বিজেপির মন্ত্রীর মন্তব্যের সমালোচনা করে এক্স হ্যান্ডলে আক্রমণ শানাতে শুরু করেছে তৃণমূল। তাদের বক্তব্য, ‘‘বাংলার মনীষীদের প্রতি বিজেপির ঘৃণার সীমা নেই। তবে এটাই প্রথম বার নয়। ওরা বাংলাকে আগেও অপমান করেছে। বাংলায় অমিত শাহের সমাবেশে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছিল। স্বামী বিবেকানন্দকে বিভ্রান্ত বামপন্থী বলে আক্রমণ করেছিলেন সুকান্ত মজুমদার। জেপি নড্ডা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মস্থান নিয়ে ভুল তথ্য দিয়েছেন। উত্তরপ্রদেশে স্কুলের পাঠ্যবই থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’’

তৃণমূলের মুখপাত্র অরূপ চক্রবর্তীও বলেন, ‘‘যারা নিজেরা ব্রিটিশদের দালালি করেছে, তারা রামমোহন রায়কে দালাল বলছে। এই জন্যই বিজেপি বাংলাবিরোধী। বাংলার মানুষ এর জবাব দেবেন।’’

যদিও শমীকের পাল্টা জবাব, ‘‘তৃণমূলের জন্ম তাদের গর্ভ থেকে, যারা এক সময়ে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে সাড়া দিতে চায়নি। যারা এক সময়ে এই বাংলায় বিদ্যাসাগরকে ‘ভয়ানক ব্রিটিশ দালাল’ বলেছিল। বিদ্যাসগর মূর্তির শিরশ্ছেদ করেছিল। সেই সব শক্তি এখন তৃণমূলে রয়েছে। তৃণমূলের সঙ্গে রয়েছে। তাই তৃণমূল বাঙালি মনীষীদের সম্মানের বিষয়ে কথা বললে হাস্যকর শোনায়।’’

Raja Ram Mohan Roy BJP TMC
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy