Advertisement
E-Paper

উত্তরবঙ্গের বিপর্যয়: তিস্তায় বাঁধ দেওয়া হল ‘সামাজিক অপরাধ’! কেন্দ্রকে বিঁধে মুখ্যমন্ত্রী বললেন: দুর্যোগের পরে ওরা কিচ্ছু দেয়নি

উৎসবের মরসুমে ওই দুর্যোগের পরে এই নিয়ে তৃতীয় বার উত্তরবঙ্গে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী। সিকিমে তিস্তা নদীর উপর বাঁধ দেওয়ার অনুমতি কেন দিল কেন্দ্র, তা নিয়ে ফের প্রশ্ন তুললেন তিনি।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৫ ২০:২৬
উত্তরবঙ্গের সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে ফের কেন্দ্রকে দুষলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

উত্তরবঙ্গের সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে ফের কেন্দ্রকে দুষলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। — ফাইল চিত্র।

উত্তরবঙ্গে বন্যা পরিস্থিতি ঘিরে ফের এক বার কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ‘বঞ্চনা’র অভিযোগ তুললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বন্যা এবং দুর্যোগের জেরে উত্তরবঙ্গের এই দুরাবস্থার জন্য কেন্দ্র কোনও অর্থসাহায্য করেনি। সোমবার উত্তরকন্যা থেকে সেই কথাই মনে করিয়ে দিতে চাইলেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “উত্তরবঙ্গে এত বড় বিপর্যয় হয়ে গেল, কেউ এসেছে? কথা বলেছে এক বারও? এক পয়সাও দিয়েছে! কিচ্ছু দেয়নি।”

ভুটান এবং পড়শি রাজ্য সিকিম থেকে জল এসে উত্তরবঙ্গে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়। এই অভিযোগ আগেও তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সোমবার ফের এক বার তা নিয়ে কেন্দ্রকে নিশানা করেন। জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য সিকিমে তিস্তা নদীর উপর বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। সেখান থেকে জল ছাড়লেই দার্জিলিং, কালিম্পং, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, মাটিগাড়া, নকশালবাড়ির মতো এলাকাগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে অভিযোগ মুখ্যমন্ত্রীর। তাঁর কথায়, এটি একটি ‘সামাজিক অপরাধ’।

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “তিস্তাকে ‘ব্লক’ করে দিয়েছে। এটা অপরাধ নয়! এটা সামাজিক অপরাধ নয়! এটা ক্রিমিনাল অফেন্স নয়! কী করে কেন্দ্র পারমিশন দিল! তিস্তার জল দিতে হবে বলে মাঝে মাঝেই চিৎকার করে। তিস্তাকে বাঁচাতে হবে, এটা নিয়ে তো ভাবে না।” মমতার অভিযোগ, সিকিম এবং ভুটানের জল উত্তরবঙ্গে প্রবেশ করার ফলে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়। এর ফলে বনভূমি, কৃষিজমি এবং চা-বাগান নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এর পরেও কেন্দ্রীয় সরকার এই পরিস্থিতি নিয়ে ‘উদাসীন’ বলে অভিযোগ তোলেন মুখ্যমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে ইন্দো-ভুটান নদী কমিশন গঠনের পক্ষেও ফের এক বার সওয়াল করেন তিনি।

সোমবার শুধু উত্তরবঙ্গের পরিস্থিতি নিয়েই নয়, দক্ষিণবঙ্গের প্লাবন পরিস্থিতি নিয়েও কেন্দ্রকে নিশানা করেন মুখ্যমন্ত্রী। ডিভিসির ছাড়া জলে দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা যে বন্যায় ভাসে, তা স্মরণ করিয়ে দেন তিনি। উঠে আসে দুর্গাপুজোর আগে ভারী বৃষ্টির জেরে কলকাতার জলমগ্ন পরিস্থিতির কথাও। এ প্রসঙ্গেও গঙ্গার নাব্যতা কমে যাওয়া নিয়ে কেন্দ্রকে আক্রমণ শানান তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, কলকাতায় জল জমলে, সেই জল ফেলবেন কোথায়! উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ বা বিহারের বৃষ্টির জলও গঙ্গা দিয়ে বাংলায় চলে আসে। কেন গঙ্গায় ‘ড্রেজ়িং’ করানো হয় না, তা নিয়েও প্রশ্ন মুখ্যমন্ত্রীর। মমতার কথায়, অতীতে বিহারও এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

কেন্দ্রের তরফে আর্থিক ‘অবরোধ’-এর অভিযোগ তুলে মুখ্যমন্ত্রী জানান, এ বারের দুর্যোগের পরে তিনি কেন্দ্রের থেকে কোনও সাহায্যই চাননি। কারণ অতীতেও ধারাবাহিক ভাবে এ বিষয়ে কেন্দ্রের থেকে ‘বঞ্চনা’ই জুটেছে। এ বিষয়ে সোমবার উত্তরকন্যা থেকে অতীতের বেশ কিছু ‘অবহেলা’র প্রসঙ্গও তুলে ধরেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী জানান, ২০২১ সালের জুলাই-অগস্টে বন্যা ও ভূমিধসের জন্য ১২০০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছিল। ওই বছরের সেপ্টেম্বরের দুর্যোগের জন্য য়াওয়া হয়েছিল ১৪০০ কোটিরও বেশি টাকা। গত বছরেও বন্যা, নদী-ভাঙন এবং ভূমিধসের কারণে ৪২৩৩ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছিল। গত বছরের অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড় ডেনার সময়েও ১৬৮৫ কোটি টাকার আর্থিক সাহায্য চাওয়া হয়। কিন্তু প্রতি ক্ষেত্রেই কেন্দ্রের তরফে বিমাতৃসুলভ আচরণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ তৃণমূলনেত্রীর।

ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সাহায্য

উৎসবের মরশুমে ওই দুর্যোগের পরে এই নিয়ে তৃতীয় বার উত্তরবঙ্গে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী। দুর্যোগ পরবর্তী উত্তরবঙ্গের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগও নেন তিনি। দুর্যোগে সামগ্রিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ১১,৫৫৫টি পরিবারকে এবং গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত ৩,২৩৯টি পরিবারকে বাড়ি পুনর্নির্মাণের জন্য অনুদান দেন তিনি। এর জন্য রাজ্য সরকার মোট ১৬১ কোটি ৩৩ লক্ষ টাকা খরচ করছে। এ ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় সরকারের ‘বঞ্চনা’র অভিযোগে সরব হন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী জানান, কেন্দ্রীয় সরকার হঠাৎ করে গ্রামীণ আবাসন প্রকল্পে আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার আগে ওই প্রকল্পের আওতায় পশ্চিমবঙ্গ ভারতের এক নম্বর রাজ্য ছিল। ওই প্রকল্পের আওতায় ৪৫.৭ লক্ষেরও বেশি ঘর নির্মিত হয়েছে রাজ্যে। কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে রাজ্য সরকার ‘বাংলার বাড়ি’ প্রকল্প চালু করেছে, তা-ও স্মরণ করিয়ে দেন তিনি। মমতা জানান, এই প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যে ১২ লক্ষ পরিবারকে ১৪,৪০০ কোটি টাকার অনুদান দেওয়া হয়েছে। শীঘ্রই আরও ১৬ লক্ষ পরিবার এই আর্থিক সাহায্য পাবে বলে আশ্বস্ত করে মুখ্যমন্ত্রী।

পাশাপাশি উত্তরবঙ্গের সাম্প্রতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ফসলের বীজও দেওয়া হয়। মুখ্যমন্ত্রী জানান, সরষে, গম, মুসুর, ভুট্টা, খেসারি, আলু ও অন্যান্য ফসলের চাষের জন্য ১ লক্ষ ১৬ হাজারেরও বেশি কৃষককে সাড়ে ছয় কোটি টাকার বীজ ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ২০,৭২৪ কৃষককে মরসুমি সবজি চাষের জন্য সাড়ে তিন কোটি টাকার বীজ ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দেওয়া হয়েছে। পাহাড়ি এলাকার জন্য দার্জিলিঙের এক হাজারেরও বেশি কৃষককে কমলালেবু, আদা ও বড় এলাচের চারা গাছ দেওয়া হয়।

মহাকাল মন্দিরের ট্রাস্ট গঠন

সোমবার উত্তরকন্যা থেকে মুখ্যমন্ত্রী জানান, শিলিগুড়ি মহাকাল মন্দির গঠনের জন্য ইতিমধ্যে একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে। ওই ট্রাস্টের প্রধান হিসাবে দায়িত্বে রয়েছেন রাজ্যের মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমরা ইতিমধ্যে ১৭.৪ একর জমি পেয়ে গিয়েছি। মন্ত্রিসভায় এ নিয়ে আলোচনাও হয়ে গিয়েছে। মহাকাল মন্দিরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কারণ এ ক্ষেত্রে একটি ট্রাস্ট তৈরি করতে হয়। আমরা মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে একটি ট্রাস্ট তৈরি করে দিয়েছি।” এই ট্রাস্টে দার্জিলিঙের মহাকাল মন্দিরের পুরোহিত, মদনমোহন মন্দিরের প্রতিনিধি, জলপাইগুড়ির জল্পেশ মন্দিরের প্রতিনিধি, মেয়র গৌতম দেব, জিটিএ চেয়ারম্যান অনিত থাপা-সহ অন্যদেরও রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “জমিটা আমরা এক পয়সায় দিয়ে দিচ্ছি। মানে পয়সা নিচ্ছি না, ফ্রি-তে দিয়ে দিচ্ছি।” এই ট্রাস্টের আহ্বায়ক থাকছে হিডকো।

চা-বাগান নিয়ে কেন্দ্রের খোঁচা

চা-বাগানের শ্রমিকদের জন্যও কেন্দ্রীয় সরকার কিছুই করেনি বলে অভিযোগ মুখ্যমন্ত্রীর। মমতার বক্তব্য, নির্বাচনের আগে কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিশ্রতি দিয়েছিল চা-বাগান খোলা হবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কিছুই করেনি। কেন্দ্র ‘মিথ্যা প্রতিশ্রুতি’ দিয়েছিল বলে অভিযোগ মুখ্যমন্ত্রীর। তাঁর কথায়, নির্বাচন এলে কেন্দ্র আবার একই কথা বলবে। তবে তাঁর নেতৃত্বে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে সম্প্রতি পাহাড়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া ২৪টি চা-বাগান খুলেছে বলে উত্তরবঙ্গ থেকে জানান মমতা। পরে মুখ্যমন্ত্রী সমাজমাধ্যমে লেখেন, এর আগে ৫৯টি চা-বাগান পুনরায় চালু হয়েছে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে। সোমবার ৩৯ হাজারেরও বেশি চা-বাগান পাট্টা বিলি হয়েছে বলে জানান তিনি।

চা-বাগান এলাকায় মাঝেমধ্যেই চিতাবাঘের উপদ্রব দেখা যায়। স্কুলে যাওয়া আসার পথে যাতে ছোট ছোট পড়ুয়ারা চিতাবাঘের আক্রমণের মুখে না-পড়ে তা নিশ্চিত করতেই পদক্ষেপ করছে রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রী জানান, চা-বাগান এলাকার পড়ুয়াদের নিরাপত্তার কথা ভেবে, তাদের স্কুলে যাওয়ার জন্য ১০টি বাস দেওয়া হবে রাজ্য সরকারের তরফে। শীঘ্রই ওই বাসগুলি চা-বাগান এলাকায় পৌঁছে যাবে বলে জানান তিনি।

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রাজনীতির অভিযোগ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা’ গান গাওয়াকে কেন্দ্র করে অসম কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সম্প্রতি প্রশ্ন তুলেছে বিজেপি। রবীন্দ্রনাথের ওই গানটি বাংলাদেশেরও জাতীয় সঙ্গীত। কেন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে বিজেপি। এরই মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘বন্দে মাতরম’ গানের ১৫০ বছরকে ধুমধাম করে পালনের উদ্যোগ নিয়েছে বিজেপি শিবির। সোমবার কারও নাম না-করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “জনগণ এবং বন্দেমাতরমের মধ্যে ঝগড়া লাগাচ্ছেন। ভাল ভাবে তো গাইতেও পারেন না। আমরা দুটোকেই সমান সম্মান করি। বন্দে মাতরম শতবর্ষ কমিটি করেছি। জনগণ শতবর্ষ কমিটিও মাথায় আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়েও রাজনীতি করতে হবে! লজ্জা লাগে না!”

Mamata Banerjee North Bengal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy