Advertisement
E-Paper

অবৈধ সব ইটভাটাই আইনি করার পথে হাঁটতে চায় রাজ্য

পরিবেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বেআইনি ইটভাটাগুলিকে আইনসিদ্ধ করতে উদ্যোগী হল রাজ্য সরকার। দূষিত ধোঁয়া ছেড়ে প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষিত করা এবং জলাভূমির উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের ভারসাম্য নষ্টের জন্য রাজ্যের প্রায় ১০ হাজার অনুমোদনহীন ইটভাটা বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিল জাতীয় পরিবেশ আদালত।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৫ ০৩:২৬

পরিবেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বেআইনি ইটভাটাগুলিকে আইনসিদ্ধ করতে উদ্যোগী হল রাজ্য সরকার।

দূষিত ধোঁয়া ছেড়ে প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষিত করা এবং জলাভূমির উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের ভারসাম্য নষ্টের জন্য রাজ্যের প্রায় ১০ হাজার অনুমোদনহীন ইটভাটা বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিল জাতীয় পরিবেশ আদালত। কিন্তু তা মানার বদলে ইটভাটাগুলিকে আইনি স্বীকৃতি দিতে চাইছে মুখ্যমন্ত্রীর গড়া মন্ত্রিগোষ্ঠী।

নবান্ন সূত্রের খবর, গত ২ মার্চ অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র, পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু, পরিবেশমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষ দস্তিদার ও সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে তৈরি হয় ওই মন্ত্রিগোষ্ঠী। ২৩ মার্চ মন্ত্রিগোষ্ঠীর কাছে বেআইনি ইটভাটাগুলিকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং অনুমোদিত ভাটাগুলি চালু রাখার বিষয়ে নীতি গ্রহণের প্রস্তাব পেশ করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধীন ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর। এর পরেই মন্ত্রিগোষ্ঠী সুপারিশ করে, ওই ইটভাটাগুলিকে অনুমোদন দেওয়া হোক। কারণ, এর সঙ্গে সরকারের রাজস্ব এবং হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থানের প্রসঙ্গ জড়িয়ে রয়েছে। নবান্ন সূত্রের খবর, শীঘ্রই মন্ত্রিসভার বৈঠকে পেশ হতে চলেছে মন্ত্রিগোষ্ঠীর ওই সুপারিশ।

নবান্নের সূত্রটি জানাচ্ছেন, ওই সব ইটভাটা ১৫ বছর ধরে রাজ্য সরকারকে নিয়ম মেনে রাজস্ব দেয় না। খাতায়-কলমে সেগুলি অবৈধ বলে সরকারও রাজস্ব পাওয়ার জন্য আইনি পথে হাঁটতে পারে না। ১০ হাজার বেআইনি ইটভাটার বৈধকরণের পক্ষে তাই সরকারের যুক্তি, অনুমোদন দিলে রাজকোষে অন্তত ১৫০ কোটি টাকার রাজস্ব আসার পথে তৈরি হবে।

ভূমি দফতর সূত্রের খবর, রাজ্যে ছোট-বড় ১২ হাজার ইটভাটা আছে।
যার ৮০ ভাগই বেআইনি। পরিবেশ ছাড়পত্র না থাকা, সরকারি নিয়ম না মানার জন্যই তারা বৈধতা পায়নি। সম্প্রতি গ্রিন বেঞ্চ দুই ২৪ পরগনার সব ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। পরিবেশ-বিধির তোয়াক্কা করে না বলেই দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ২০০০-এর পরে নতুন ইটভাটার ছাড়পত্র দেয় না। তার পর গজিয়ে ওঠা ইটভাটাগুলি বেআইনি ভাবেই চলেছে। এ বার সেই সব নিয়ম শিথিল করে সেগুলিকে অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে সরকার।

বর্তমান নিয়মে নদী থেকে এক কিমির মধ্যে ইটভাটা করা যায় না। কিন্তু প্রস্তাবিত নয়া নিয়মে অবশ্য নদী পাড়ের ২০০ মিটারের মধ্যেই ইটভাটা তৈরি করা যাবে। এমনকী, জেলা স্তরে নতুন ইটভাটা খোলার আবেদন খারিজ হলে রাজ্য স্তরে মনিটরিং কমিটির কাছে আবেদন করা যাবে। কিন্তু নিয়ম শিথিল করে বেআইনি ইটভাটাগুলিকে বৈধ করার পরে জাতীয় গ্রিন বেঞ্চকে কী জবাব দেবে রাজ্য সরকার? নবান্নের সূত্রটির দাবি, বেআইনি ইটভাটাগুলিকে বৈধতা দিতে গিয়ে পরিবেশ রক্ষার দিকটির সঙ্গে আপস করা হচ্ছে না। তাই এ বার ইটভাটা তৈরির আবেদন পর্যালোচনার জন্য জেলাস্তরের কমিটিতে পরিবেশ দফতরের এক অফিসারকেও রাখা হচ্ছে। পরিবেশবিদেরা অবশ্য এতে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন। তাঁরা বলছেন, রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে নদীর গতিপথ আটকে কিংবা নদীর চরে ইটভাটা তৈরি করা হয়েছে। এতে অনেক জায়গাতেই নদীর স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ হয়েছে। ইটভাটার আবর্জনা নদীতে পড়ে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের ক্ষতি করে। ইটভাটার চিমনি দিয়ে যে ধোঁয়া বেরোয়, তাতে এমন সব গ্যাস থাকে যা সমূহ প্রাণীজগতের ক্ষতি করে। আবার ইটভাটার শ্রমিকদের স্থায়ী শৌচাগার না থাকায় নদীর পাড়েই তাঁরা মলমূত্র ত্যাগ করেন। তাতেও দূষণ ছড়ায় নদীতে। ইটভাটাগুলি মাঠ থেকেও মাটি কাটে। তার ফলে ভূস্তরের উপরিভাগের জমি (টপ সয়েল) নষ্ট হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় আশপাশের চাষের কাজ।

কয়েক বছর আগে জলপাইগুড়ি জেলায় নদীর পাড় থেকে ইটভাটা মাটি কেটে নেওয়ায় একটি গ্রাম ভাঙনের মুখে পড়েছিল। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন মুখ্য আইনি অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘ওই ঘটনার পরে এলাকার কিছু ইটভাটা বন্ধ করা হয়েছিল।’’ শুধু তা-ই নয়, যেখানে মাটি কাটা হচ্ছে, তার অদূরে সেতু থাকলে তার ভারসাম্যও নষ্ট হতে পারে।

তবে কেন ইটভাটার জন্য নিয়ম শিথিল করছে সরকার? মন্ত্রিগোষ্ঠীর এক সদস্য জানান, পরিবেশ বিধি, আইন-আদালতের নানা রায়ের জেরে রাজ্যের সিংহভাগ ইটভাটা বেআইনি ভাবে চলছে। নিয়মকানুন সরল না করলে কোনও ভাটাই পরিবেশের ছাড়পত্র পাবে না। অথচ, ইটভাটার উপরেই রাজ্যের নির্মাণ শিল্পের অগ্রগতি নির্ভর করছে। হাজার হাজার অদক্ষ শ্রমিক এখানে কাজ করে। সরকারের কাজ জনস্বার্থ দেখা।
সেই জন্যই একটি শিল্পকে বাঁচাতে এবং কর্মসংস্থান বহাল রাখতে সরকার একটি নীতি প্রণয়ন করছে।

ভূমি দফতর সূত্রের খবর, বৈধ ইটভাটাগুলিকে মাটির দাম, সেস ও খাজনা দিতে হয়। সঙ্গে বিক্রয় কর, আয়কর ও পঞ্চায়েতের করও দেওয়া বাধ্যতামূলক। অধিকাংশ ভাটা বেআইনি ভাবে চলায় সরকার এর থেকে মোটা টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষ দস্তিদার বলেন, ‘‘ইটভাটাগুলিকে বাঁচিয়ে রাখা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা এবং রাজস্ব আদায়— সব দিক বিবেচনা করেই নীতি তৈরি হচ্ছে। গাছ লাগানোর শর্তেই নদীর পাড়ে ভাটা করা যাবে।’’

‘বেঙ্গল ব্রিকফিল্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি উত্তম রায় অবশ্য বলেন, ‘‘রাজ্যে এই একটি শিল্পই কোনও ক্রমে বেঁচে আছে। নানা অছিলায় তা বন্ধ করে দিলে দুই ২৪ পরগনা, নদিয়া, হুগলি, মালদহ, মুর্শিদাবাদ-সহ নানা জেলায় হাজার হাজার শ্রমিকের পেটের ভাত জুটবে না। আর কলকাতার উপকণ্ঠে যে ২২টি নতুন উপনগরীর প্রস্তাব এসেছে, তা-ও হবে না। ফলে সরকার নিয়ম শিথিল করলে আমরা তা স্বাগত জানাব।’’

brick trinamool TMC jagannath chattopadhyay mamata bandopadhyay subrata mukhopadhyay purnendu basu
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy