Advertisement
০৫ মে ২০২৪

রক্তের উপাদানের অভাব রাজ্য জুড়ে

বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালে লিউকেমিয়া রোগী বৃষ্টি সাহাকে দুই ইউনিট প্লেটলেট দিতে হবে। শহরের পাঁচটি নামী ব্লাড ব্যাঙ্কে হন্যে হয়ে ঘুরেও প্লেটলেট জোগা়ড় করতে পারেনি বৃষ্টির পরিবার।

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০১৬ ০৯:৩৯
Share: Save:

বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালে লিউকেমিয়া রোগী বৃষ্টি সাহাকে দুই ইউনিট প্লেটলেট দিতে হবে। শহরের পাঁচটি নামী ব্লাড ব্যাঙ্কে হন্যে হয়ে ঘুরেও প্লেটলেট জোগা়ড় করতে পারেনি বৃষ্টির পরিবার। উপায়ান্তর না দেখে ‘হোল ব্লাড’ দেওয়া হল তাঁকে। সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের আক্ষেপ, ‘‘যাঁর শরীরে শুধু প্লেটলেট প্রয়োজন, তাঁকে পুরো রক্তটা দেওয়া আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। সেটাই করতে হল।’’

শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ভর্তি তপোধীর সাহার দরকার ছিল ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা। ডাক্তার বলেছিলেন, যে করে হোক, জোগাড় করতেই হবে। দু’দিন চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তাঁকেও ‘হোল ব্লাড’ই দিতে হয়।

একই ভাবে শহরের বহু হাসপাতালে প্যাকড সেল বা রক্তের লোহিত কণিকার অভাবে ধুঁকছেন অসংখ্য রোগী। ব্লাড ব্যাঙ্কে ঘুরে ঘুরেও তা জোগাড় করতে পারছে না তাঁদের পরিবার। কোথাও আবার পাঁচ ইউনিট দরকার হলে, দু’-তিন দিনের চেষ্টায় মিলছে মাত্র এক ইউনিট।

কলকাতা-সহ গোটা পশ্চিমবঙ্গে এখন রক্তের আকাল চলছে। আর এই আকাল ভয়াবহ আকার নিচ্ছে রক্তের উপাদান বিভাজনের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ, ‘হোল ব্লাড’ তবুও যা মিলছে, প্যাকড সেল, প্লেটলেট বা প্লাজমা-র হাহাকার সর্বত্র। দিল্লি, বেঙ্গালুরু, মুম্বই, চেন্নাইয়ের মতো শহর যেখানে রক্তের উপাদান পৃথক করার ক্ষেত্রে বহু দূর এগিয়ে গিয়েছে, সেখানে কলকাতা পড়ে রয়েছে মান্ধাতার আমলেই। এই মুহূর্তে রাজ্যে যত রক্ত সংগ্রহ হয়, তার মাত্র ৩৩ শতাংশ ক্ষেত্রে উপাদান পৃথক করা হয়। স্বাস্থ্যকর্তারা স্বীকার করছেন, এতে দু’দিক থেকেই ক্ষতিটা হচ্ছে। প্রথমত, যেখানে এক ইউনিট রক্ত থেকে উপাদান বিভাজন করে তিন জনকে পরিষেবা দেওয়া সম্ভব, সেখানে দেওয়া যাচ্ছে মাত্র এক জনকে। আর দ্বিতীয়ত, যে উপাদানটুকু দরকার, তার বাইরে অন্য উপাদান শরীরে গিয়ে বহু সময়ে বড় ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও তৈরি হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ১৪ জুন দিনটিকে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ‘রক্তদানের শহর’ হিসেবে চিহ্নিত কলকাতারও একটা সময় পর্যন্ত গর্বের শেষ ছিল না। কিন্তু উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে, রক্তদান কতটা তার মাহাত্ম্য বজায় রাখতে পারছে, সে নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বহু রক্তদাতাই। রক্ত সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য অপূর্ব ঘোষ মনে করেন, এই সংশয়ের পিছনে যথেষ্ট যুক্তিও রয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘রক্তদান শিবিরের জন্য অভিজ্ঞ ডাক্তার ও টেকনিশিয়ান দরকার। রক্তের উপাদান পৃথক করার জন্যও ডাক্তার ও টেকনিশিয়ান দরকার। কিন্তু গত আট বছর এ রাজ্যে ব্লাড ব্যাঙ্কে পূর্ণ সময়ের ডাক্তার বা টেকনিশিয়ান নেওয়া হয়নি। ফলে সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসা সত্ত্বেও রক্তের সঙ্কট কাটছে না। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।’’

স্বাস্থ্যকর্তারা স্বীকার করছেন, লোকবলের অভাবেই এই সঙ্কট। প্রায় সমস্ত ব্লাড ব্যাঙ্কেই বহু পদ খালি। বাতিল হচ্ছে একের পর এক শিবির। যে সব ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্তের উপাদান ভাগ করার যন্ত্র রয়েছে, সেখানে ডাক্তার-টেকনিশিয়ানের অভাব। কেন নিয়োগের বিষয়ে ভাবনাচিন্তা হচ্ছে না? স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘টানা কয়েক বছর নিয়োগ পুরোপুরি বন্ধ ছিল। তাই শূন্য পদের সংখ্যাটা এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। ধাপে ধাপে তা পূরণের চেষ্টা চলছে। তবে সময় লাগবে।’’

রক্তদান আন্দোলনের কর্মী দীপঙ্কর মিত্র বলেন, ‘‘লোকবল যেটুকু আছে সেটাও কাজে লাগানো হচ্ছে না। সর্বত্রই গয়ংগচ্ছ মনোভাব। হাসপাতালের স্তরে বা স্বাস্থ্য দফতরে, কোথাওই কোনও নজরদারি নেই।’’

এক ইউনিট রক্ত থেকে উপাদান পৃথক করে লোহিত কণিকা, প্লেটলেট বা অণুচক্রিকা এবং ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা মেলে। যাঁদের ওই বিশেষ উপাদানগুলির মধ্যে কোনও একটা প্রয়োজন, তাঁদের যদি নির্দিষ্ট ভাবে তা না দিয়ে ‘হোল ব্লাড’ দেওয়া হয়, তা হলে কী হতে পারে? হেমাটোলজিস্টরা জানান, এর ফলে পরবর্তী সময়ে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। হেমাটোলজিস্ট আশিস মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রক্তের মধ্যে এমন অনেক জীবাণু থেকে যায়, যা থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর ভয় বেশি। প্লাজমার ক্ষেত্রে এটা অনেক বেশি। সাধারণ ভাবে রক্ত দেওয়ার আগে যে ধরনের পরীক্ষাগুলি করে নেওয়া হয়, তার বাইরেও বহু জীবাণু থাকে। হোল ব্লাড দিলে সেই জীবাণু সংক্রমণের ভয় বেড়ে যায়।’’

আছে অন্য ঝুঁকিও। লিউকেমিয়ার রোগীদের জন্য প্লেটলেট প্রয়োজন। হিমোফিলিয়া রোগীদের জন্য প্লাজমা। আবার থ্যালাসেমিয়া রোগীদের প্রয়োজন হয় প্যাকড সেল বা লোহিত রক্তকণিকা। এই তিন ধরনের রোগীদেরই নিয়মিত রক্ত নিতে হয়। এঁদের দরকার শুধু নির্দিষ্ট উপাদানটিই। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ‘‘হোল ব্লাড দিয়ে অনেক ‘মাইনর অ্যান্টিজেন’ শরীরে ঢোকে। এতে পরবর্তী সময়ে ওই রোগীকে যখন রক্ত দেওয়া হয়, তখন নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। লিউকেমিয়া, থ্যালাসেমিয়া বা হিমোফিলিয়া রোগীদের বেঁচে থাকাটাই রক্ত-নির্ভর। তাই রক্তের উপাদান নিয়ে এমন সঙ্কটে সব চেয়ে বেশি খেসারত দিতে হচ্ছে তাঁদেরই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Blood Elements Leukemia
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE