Advertisement
০৪ মে ২০২৪

সারদার জমি ব্যবসার জট কাটাতেন রাজ্যের মন্ত্রী

তদন্ত যত এগোচ্ছে সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে রাজ্যের এক মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়ে ততই নিশ্চিত হচ্ছে সিবিআই। সিবিআই সূত্রের খবর, দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুরে গত কয়েক বছরে জমি নিয়ে যখনই কোনও সমস্যায় পড়েছেন সুদীপ্ত, তখনই তাঁর উদ্ধারে প্রধান ভূমিকায় দেখা গিয়েছে রাজ্যের প্রভাবশালী এই মন্ত্রীকে।

ইডি অফিসে তারার দু’টি চ্যানেলের প্রাক্তন প্রধান রতিকান্ত বসু।  নিজস্ব চিত্র

ইডি অফিসে তারার দু’টি চ্যানেলের প্রাক্তন প্রধান রতিকান্ত বসু। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:২১
Share: Save:

তদন্ত যত এগোচ্ছে সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে রাজ্যের এক মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়ে ততই নিশ্চিত হচ্ছে সিবিআই।

সিবিআই সূত্রের খবর, দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুরে গত কয়েক বছরে জমি নিয়ে যখনই কোনও সমস্যায় পড়েছেন সুদীপ্ত, তখনই তাঁর উদ্ধারে প্রধান ভূমিকায় দেখা গিয়েছে রাজ্যের প্রভাবশালী এই মন্ত্রীকে।

২০০৬ সালে পূর্ব বিষ্ণুপুরের কোনচৌকি এলাকায় প্রায় ১১০০ একর জমির উপর আবাসন প্রকল্প শুরু করেছিলেন সুদীপ্ত। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে জমির দখল নেওয়া শুরু করেন তিনি। জোর করে জমি দখল করার অভিযোগও ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু ২০০৮ সালের পর থেকে রাজ্যের রাজনৈতিক হাওয়া ঘুরতে শুরু করে। ‘হাওয়া-মোরগ’ সুদীপ্ত তখন ওই প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। সিবিআইয়ের তদন্তকারীদের মতে, ২০০৮ সালের পর থেকেই সারদা গার্ডেন্সে যাতায়াত শুরু হয় ওই নেতার।

সিবিআই জানাচ্ছে, বিষ্ণুপুরের সারদা গার্ডেন্সে জমি কিনেছিলেন কলকাতার ভবানীপুরের ৭০ জন বাসিন্দা। দু’কোটি টাকা সারদার কাছে জমাও দিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু সুদীপ্ত ওই সোসাইটির সদস্যদের জমির দখল দিচ্ছিলেন না। বিষ্ণুপুর থানা-সহ বিভিন্ন জায়গায় দরবার করেও কোনও লাভ হয়নি। ২০০৮ সালে ওই তৃণমূল নেতা বিষয়টি জানতে পারেন। সুদীপ্ত-র সঙ্গে যোগাযোগ করে ওই সমস্যার সমাধান করেন তিনিই। ওই ঘটনার পর থেকেই সুদীপ্তর জমির ব্যবসায় এই তৃণমূল নেতা নিয়মিত ভাবে জড়িয়ে পড়েন বলে দাবি করছে সিবিআই।

সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই সময় সুদীপ্ত সেনের জমি সংক্রান্ত বহু সমস্যা মিটিয়ে দিয়েছিলেন ওই নেতা। জমি ব্যবসার সূত্রে তাই সুদীপ্তর কাছ থেকে তিনি আর্থিক ভাবে লাভবানও হয়েছিলেন কি না, তা খতিয়ে দেখছে সিবিআই। জেরায় সুদীপ্ত জানিয়েছেন, ওই সময় ওই নেতার সুপারিশে নানা সংস্থায় অনুদান হিসেবে টাকা দিয়েছেন তিনি। ওই সব অনুদানের একটি বড় অংশ ওই নেতার মাধ্যমেই দেওয়া হয়েছিল বলে তদন্তকারীদের কাছে কবুল করেছেন সুদীপ্ত।

তবে যত টাকা সুদীপ্ত দিয়েছেন তার পুরোটাই সঠিক জায়গায় পৌঁছেছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন সিবিআই অফিসারেরা। উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে, সারদা গার্ডেন্স লাগোয়া একটি নির্মীয়মাণ মন্দিরের কথা। তদন্তকারীদের দাবি, মন্দির নির্মাণের সময়ে সুদীপ্তর কাছ থেকে যে এক কোটি টাকা ওই মন্ত্রী নিয়েছিলেন, তার মধ্যে মাত্র কয়েক লক্ষ টাকা মন্দির তহবিলে জমা পড়ে। বাকি টাকার কোনও হদিস নেই বলে সিবিআই সূত্রের খবর। ওই টাকা কার কাছে গিয়েছে, তা জানার চেষ্টা চলছে।

প্রভাবশালী এই রাজনৈতিক নেতার পাশাপাশি সেবি-র (সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া) কিছু অফিসারকেও ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায় সিবিআই। সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে, এঁদের বেশির ভাগই এখন অবসরপ্রাপ্ত। যে সময় এ রাজ্যে সারদার ব্যবসায় বাড়বাড়ন্ত চলছিল, তখন এই সব অফিসার ক্ষমতার শীর্ষে ছিলেন। বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা সেবি-র। কিন্তু সিবিআইয়ের আশঙ্কা, তা না-করে সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে যোগসাজশ গড়ে তুলেছিলেন সেবি-র কিছু অফিসার। সারদা কেলেঙ্কারি সামনে আসার পরে রাজ্য সরকারকে সেবি একটি চিঠি দিয়ে সতর্ক করেছিল। সিবিআইয়ের দাবি, ওই চিঠি আসলে অনেক পরে লেখা হয়েছিল। কিন্তু রাজ্য সরকারকে পাঠানোর সময়ে পুরনো তারিখ দিয়ে (ব্যাক ডেট) সেই চিঠি পাঠানো হয়।

সিবিআই সূত্রের খবর, সেবি-র সঙ্গে সুদীপ্তর যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ছিলেন ধৃত ব্যবসায়ী সন্ধির অগ্রবাল। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার বক্তব্য, সন্ধিরের কাছ থেকে গত কয়েক দিন ধরে যে ল্যাপটপ, হার্ড ডিস্ক ও নথি উদ্ধার হয়েছে তাতে প্রমাণ মিলেছে যে সেবি ও সুদীপ্তর মধ্যে মূল সংযোগকারী ছিলেন তিনিই। তাই সোমবার সন্ধিরকে আদালতে তোলা হলে তাঁর জামিনের বিরোধিতা করে সিবিআই। তাঁকে বিচারক ১০ দিনের জন্য জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। সোমবার কলকাতায় সিবিআই দফতরে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে অসমের গায়ক ও চিত্রনির্মাতা সদানন্দ গগৈকেও।

সারদা তদন্তে সিবিআইয়ের পাশাপাশি সক্রিয় রয়েছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট-ও (ইডি)। এ দিন তারা রতিকান্ত বসুকে সকাল থেকে জেরা করে। এক সময়ে তারা মিউজিক ও তারা নিউজ চ্যানেলের প্রধান ছিলেন এই রতিকান্ত। জেরার পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “সুদীপ্ত কত টাকায় তারা-র চ্যানেলগুলি কিনেছেন সেটাই আমার কাছ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল।” রতিকান্তবাবুর দাবি অনুযায়ী, ২০০০ সালের এপ্রিলে শুরু হয় তারা নিউজ, তারা মিউজিক, তারা পঞ্জাবি এবং টিভি সাউথ-এশিয়া। মূল সংস্থার নাম ছিল ব্রডকাস্ট ওয়র্ল্ডওয়াইড লিমিটেড। সেখানে রতিকান্তবাবুর শেয়ার ছিল ১২ শতাংশ। সংস্থায় সিংহভাগ শেয়ার ছিল চেন্নাইয়ের শিবা ভেঞ্চার নামে একটি সংস্থার। প্রায় ১৭-১৮ জন মালিক ছিলেন ওই চ্যানেলগুলির।

২০১০ সালে চারটি চ্যানেলই কিনে নেন সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেন। সেই সময় রতিকান্ত ছিলেন সংস্থার চেয়ারম্যান। তাঁর দাবি, ১৮ কোটি টাকায় ওই চারটি চ্যানেল কিনেছিলেন সুদীপ্ত। কিন্তু সেই টাকার একাংশ তিনি দিতে পারেননি। পরিবর্তে সুদীপ্ত মধ্যমগ্রামের একটি শপিং মল বন্ধক রাখেন চেন্নাইয়ের ওই সংস্থার কাছে। গ্রেফতার হওয়ার আগে সুদীপ্ত সিবিআইকে যে চিঠি লিখেছিলেন, সেখানেও তিনি একই কথা জানান। সেই চিঠিতে সুদীপ্তর দাবি ছিল, চারটি চ্যানেল কেনার জন্য তিনি নগদ ১৬ কোটি টাকা দেন। বাকি ছিল আড়াই কোটি টাকার মতো। তাই শপিং মলটি তিনি বন্ধক রেখেছিলেন। কিন্তু ওই মল-এর বাজারদর তখনই ছিল প্রায় ১৫ কোটি টাকা। আড়াই কোটি টাকা বাকি থাকলে তার বিনিময়ে ১৫ কোটির শপিং মল কেন বন্ধক রাখতে হয়েছিল, এ প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই উঠছে। ফলে চারটি চ্যানেল কিনতে সুদীপ্ত ঠিক কত টাকা খরচ করেছিলেন, তা নিয়ে সংশয়ে ইডি অফিসারেরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE