Advertisement
E-Paper

‘দেখে নেব কে জেতে, আমি না ক্যানসার’

যেমন টালিগঞ্জের বাসিন্দা গুলাব কেশর মিশ্র। জীবনের পনেরোটা বছর পাঁচ-পাঁচ বার ক্যানসার থাবা বসিয়েছে তাঁর শরীরে।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৮ ১৫:০১
গুলাব কেশর মিশ্র

গুলাব কেশর মিশ্র

জীবনে এক বার কেউ ক্যানসারের মুখোমুখি দাঁড়ালে লড়াই চালাতে দম লাগে। কিন্তু কারও কারও জীবনে লড়াই হয় কঠোরতর, আর তাঁদের মনের জোরও তেমনই। অনায়াসে তাঁরা বাঁচার মতো বাঁচা-র পন্থা দেখিয়ে যান। সহজে যে হাল ছাড়তে নেই, তা-ও শিখিয়ে যান জলজ্যান্ত উদাহরণ হয়ে।

যেমন টালিগঞ্জের বাসিন্দা গুলাব কেশর মিশ্র। জীবনের পনেরোটা বছর পাঁচ-পাঁচ বার ক্যানসার থাবা বসিয়েছে তাঁর শরীরে। পুরনো ক্যানসার শরীরের ভিতরে অন্যত্র ছড়িয়েছে, এমন নয়। প্রতি বার শরীরের নতুন জায়গায় নতুন করে ক্যানসার দেখা দিয়েছে। এবং গুলাব তাঁর মোকাবিলা করেছেন। প্রতি বার হয়েছে অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি, রেডিয়োথেরাপি। তার পরে টানা পাঁচ বছর ওষুধ চলেছে। বৃদ্ধা সুস্থ হয়েছেন। কয়েক বছর পরে আবার নতুন ক্যানসার ধরা পড়েছে শরীরে। কিন্তু তাঁকে হারাতে পারেনি। ভরপুর আত্মবিশ্বাস নিয়ে বৃদ্ধা শুরু করেছেন নতুন যুদ্ধ। এখন তিনি তিরাশি। গত পাঁচ বছর ক্যানসারের কোনও ওষুধ খান না। গুলাবের রক্তচাপ, হিমোগ্লোবিন, নাড়ির গতি, প্লেটলেটের পরিমাণ আশ্চর্য রকম স্বাভাবিক। আনন্দে আছেন, সুস্থ আছেন এবং নাতির বিয়ে দিয়ে পুতি-র সঙ্গে খেলা করার স্বপ্ন দেখছেন!

‘‘একটাই জীবন, আনন্দ লুটেপুটে নেব। এত সহজে রোগের কাছে হেরে যাব কেন? আমি বরাবরই সব বিষয়ে ইতিবাচক ছিলাম। জীবন কুসুমাস্তীর্ণ হয় না। যখন কঠিন সময় আসবে, তখন এক জন মানুষ কতটা মাথা ঠান্ডা রেখে তার মুখোমুখি হয়ে সমাধান করবে সেটাই বড় কথা। ক্যানসার মানেই ‘মরে যাব’ মনে করে আগেই মরে রইলাম, তা আমি পারব না’’— হাসতে হাসতে বলছিলেন গুলাব। অসম্ভব ডাকাবুকো ছিলেন। ১৯৯২ সালে বাঁ দিকের স্তনে ক্যানসার ধরা পড়ে, স্টেজ ২। সুস্থ হন। তার ১০ বছর পরে ক্যানসার হয় ডান দিকের স্তনে। সেখানেও স্টেজ-২। সেরে ওঠেন। ২০০৫ সালে ক্যানসার হয় জরায়ুতে। ২০০৮-এ কোলন ক্যানসার স্টেজ ৩ এবং ২০০৯-এ লিম্ফনোড ক্যানসার। শেষ বার পাঁচটি কেমো নেওয়ার পরে এতটাই অসুস্থ হয়েছিলেন যে সকলে ভেবেছিলেন, এই বোধহয় লড়াইয়ের শেষ। তিরাশিতে পৌঁছে বৃদ্ধা এখন বলছেন, ‘‘হোক আবার ক্যানসার কত হবে! দেখে নেব কার বেশি জোর, আমার না ক্যানসারের?’’

ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালে দীর্ঘদিন গুলাবের চিকিৎসা চলেছে। সেখানকার চিকিৎসক অর্ণব গুপ্তের কথায়, ‘‘নিয়মিত ফলো-আপ, মনের জোর, হতোদ্যম না হওয়া, স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা, মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ না-করা আর ক্যানসার মানেই মৃত্যু মনে না-করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এতেই অর্ধেক যুদ্ধ জিতে নেওয়া যায়।’’

ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, এক বার ক্যানসার হয়ে চিকিৎসায় সুস্থ হওয়ার পরে রোগী যদি দীর্ঘদিন বেঁচে থাকেন, তা হলে তাঁর আর এক বার ক্যানসারের আশঙ্কা থাকে। কারণ, জিনগত ভাবে তাঁর দেহের কোষগুলি ক্যানসার প্রবণ হয়। গৌতমবাবুর কথায়, ‘‘এক জনের দেহে নতুন করে দু’বার বা তিন বারও ক্যানসার দেখা যায়। কিন্তু পাঁচ বার নতুন ক্যানসারের পরেও এত ভাল ভাবে এত বয়স্ক এক জন বেঁচে আছেন, এটা বিরল। লড়াইয়ের আদর্শ হতে পারেন তিনি।’’ ক্যানসার-বিশেষজ্ঞ সোমনাথ সরকারের কথায়, ‘‘পুরনো ক্যানসার যাঁদের শরীরের অন্যত্র ছড়ায়, তাঁরা সাধারণত বেশি দিন বাঁচেন না। কিন্তু যাঁদের নতুন করে বার বার ক্যানসার হয়, তাঁরা তুলনায় দীর্ঘজীবী হন।’’

চিকিৎসক শারদ্বত মুখোপাধ্যায়ের এক রোগীর প্রস্টেট, ল্যারিঙ্গস আর ফুসফুসে কয়েক বছরের ব্যবধানে ক্যানসার হয়েছিল। তিনি এখন দিব্যি আছেন। ‘‘অদ্ভুত স্ফূর্তি ছিল মানুষটির। এক বার করে নতুন জায়গায় ক্যানসার হত আর তিনি এসে বলতেন, ‘স্যর, আবার হয়েছে। শুরু করে দিন।’ কোনও অবসাদ ছিল না। ওঁরা বুঝেছিলেন, চিকিৎসা করে রোগটার মোকাবিলা করা যায়। ভয় পেয়ে নয়।’’— বলছিলেন শারদ্বত।

লড়াকুদের সবাই সমঝে চলে। ক্যানসারও।

Gulab Keshar Mishra cancer Cancer patient
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy