Advertisement
E-Paper

রবীন্দ্রনাথের চিঠির খোঁজ মেলে হার্ভার্ডের হটনে

শিক্ষা-সংস্কৃতির মূল কেন্দ্র কলকাতা। সেখানে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার ও সমমনস্ক মানুষের সাহচর্য অনেক সহজলভ্য।

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৮ ১৬:০০
তরণী: নৌকো থেকে উঠে আসছেন রবীন্দ্রনাথ।

তরণী: নৌকো থেকে উঠে আসছেন রবীন্দ্রনাথ।

অনেক দিন আগে কলকাতা টেগোর রিসার্চ ইন্সটিটিউট আমাকে রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য ুদবিতে ভূষিত করেন। এই পদবির আমি যোগ্য কি না, সেই বিষয়ে এখনও আমার মনে সংশয় আছে। আমার সহপাঠী ক্ষেত্রগোপাল গুপ্তশর্মা সংক্ষেপে যিনি ক্ষেত্র গুপ্ত নামে পরিচিত ছিলেন, তিনি তাঁর পরীক্ষার ফলাফলের দৌলতে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এই ক্ষেত্র গুপ্তর এক প্রকাশক বন্ধু ছিলেন। তিনি আমার এক রবীন্দ্রবিষয়ক বই প্রকাশে আগ্রহী হন। বইটির নাম ‘রবীন্দ্রনাট্যে রূপান্তর ও ঐক্য’। এই বই যখন ছাপা হচ্ছে, তখন আমি শিলিগুড়ি কলেজে পড়াচ্ছি। সেটি ছাপা হয়ে প্রকাশ পায় সম্ভবত ১৯৮৩ সালে। সে সময় আমি প্রুফ দেখতেও জানতাম না। অনেকটা প্রুফ আমার সহপাঠী বন্ধু শঙ্খ ঘোষ দেখে দিয়েছিলেন। অনেক দিন পরে বাদল সরকারের প্ররোচনায় বইটির একটি নতুন রূপ আনন্দ পাবলিশার্স থেকে বের হয়। এখনও সে বইটি চালু আছে।

শিক্ষা-সংস্কৃতির মূল কেন্দ্র কলকাতা। সেখানে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার ও সমমনস্ক মানুষের সাহচর্য অনেক সহজলভ্য। বিদগ্ধ আলাপচারিতা চিন্তায় নতুনত্বের সন্ধান দেয়। অন্য দিকে, শিলিগুড়ি তখন বড়ই নাবালক। পাহাড়তলির এই ছোট মফস্‌সল শহরে বইয়ের দোকান হাতে গোনা ও অত্যন্ত অনুন্নত। গ্রন্থাগারগুলোও সমৃদ্ধ নয়। শিলিগুড়ি কলেজের গ্রন্থাগার তৎকালীন অধ্যক্ষের প্রশ্রয়ে অনেকটাই আমারই সাজিয়ে তোলা। এই পরিবেশ থেকেই আমি রবীন্দ্রবিষয়ক গবেষণায় হাত দিই।

এখানে থেকেই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একটি কঠিন কাজ আমি করেছিলাম। পুলিনবিহারী সেনের অনুরোধে তাঁর কিছু পরিকল্পনায় সাহায্য করার জন্য আমি শান্তিনিকেতনে কিছু দিন থাকি। রবীন্দ্রভবনে ফাইলগুলো ওলটাতে ওলটাতে আমার নজরে পড়ে রবীন্দ্রনাথকে লেখা রোটেনস্টাইনের অনেক চিঠি। রবীন্দ্রনাথের জীবনে রোটেনস্টাইনের বড় ভূমিকা ছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাড়িতেই প্রথম তাঁর বাংলা কবিতার ইংরেজি অনুবাদ ‘গীতাঞ্জলি’ পড়ে শোনান। শ্রোতারা অভিভূত হয়ে যান। সেই রবীন্দ্রনাথকে লেখা রোটেনস্টাইনের চিঠিগুলো আমি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রভবনে বসে পড়ি। এই চিঠিগুলো নিয়ে আমি কলকাতার একটি পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখি। কিন্তু একতরফা চিঠি পড়ে আমার তৃপ্তি হচ্ছিল না। আমার মনে হয়েছিল যে, রবীন্দ্রনাথ রোটেনস্টাইনকে যে চিঠিগুলো লিখেছিলেন, সেগুলো পড়া দরকার। খোঁজ খবর করে জানলাম রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলো আছে মার্কিন দেশের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হটন লাইব্রেরিতে। এই সময় আমি আরও জানতে পারি, আমেরিকার এক গবেষক এই নিয়ে কাজ করছেন। আমি নিরস্ত হই না। তখন আমার ছোটবেলার বন্ধু মার্কিন দেশের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দেবনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি। দেবনাথ আমাকে হটন লাইব্রেরি থেকে রবীন্দ্রনাথের চিঠির মাইক্রোফিল্ম পাঠিয়ে দেন। এই ভাবে দুই পক্ষের চিঠিপত্র আমার হাতে এসে পৌঁছয়।

সমস্যা হল, মাইক্রোফিল্ম পড়ার উপায় তো তখন শিলিগুড়িতে নেই। কলেজ থেকে মাইক্রোস্কোপ এনে তার তলায় মাইক্রোফিল্ম ফেলে কপি করা শুরু করি। তখন শিলিগুড়িতে সব ঘরে বিদ্যুৎ ছিল না। আমার ঘরেও ছিল না। লন্ঠনের আলোয় মাইক্রোস্কোপের নীচে রাখা মাইক্রোফিল্ম পড়তে খুবই অসুবিধা হয়। কে জানে, আমার চোখের উপরে ওই অত্যাচারের সঙ্গে আমার এখনকার অন্ধত্বের যোগ কতখানি!

যাই হোক, এই ভাবেই কষ্ট করে আমি ‘রবীন্দ্রনাথ ও রোটেনস্টাইন’ নামে একটি বই লিখে ফেলি। প্রথমে সেই বইয়ের প্রকাশক মেলে না। পরে স্কটিশ চার্চ কলেজের অধ্যাপক আমার প্রাবন্ধিক বন্ধু অলোক রায় সেই বই প্রকাশনার ব্যবস্থা করেন।

আরও পড়ুন: কথা বলুক সবাই, চাইতেন রবীন্দ্রনাথ

আমি রবীন্দ্রনাথের চর্চা বর্জিত একটি মফস্সল শহরে থাকলেও পুলিনবিহারী সেনের স্নেহ ও সাহচর্য পেয়েছিলাম। তিনি আমাকে দিয়ে চিত্রাঙ্গদা নাট্যকাব্যের পাঠান্তর সম্বলিত সংস্করণ প্রস্তুত করিয়ে নেন। সেটা ছাপা হয়। শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায়ের যেমন বড় মাপের পাঠান্তর সম্বলিত রবীন্দ্ররচনা প্রকাশিত হয়েছিল, আমাকে দিয়েও তেমন বড় মাপের পাঠান্তর সম্বলিত রচনা করিয়ে নেওয়ার ইচ্ছে ছিল পুলিনবিহারীর। কিন্তু সে আর হয়ে ওঠেনি। পুলিনবিহারীর সাহচর্য সত্ত্বেও কলকাতা ও শান্তিনিকেতনে না থাকায় ওই জাতীয় কাজ আর করে উঠতে পারিনি।

ইতিমধ্যে রবীন্দ্রশতবার্ষিকীর বছর চলে আসে। তখন থেকে আমাদের অনেকের এবং আমারও কাজ হয় রবীন্দ্ররচনার পুনর্বিচার, বিশ্লেষণ ও সৌন্দর্য উদ্ঘাটন। সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত একটি প্রবন্ধ সংকলনে রবীন্দ্র বিষয়ে আমি প্রবন্ধ লিখি। সেই থেকে আমার কাজ হয়, এক দিকে আধুনিক সাহিত্য বিচার ও বিশ্লেষণ, অন্য দিকে রবীন্দ্রসাহিত্যে বিচার ও বিশ্লেষণ। মজা হচ্ছে, বিভাগীয় কূটনীতির কারণে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেও আমাকে কখনও রবীন্দ্রসাহিত্য পড়াতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু তাতে আমি নিরস্ত হই না। রবীন্দ্রসাহিত্যের মহিমায় অভিভূত আমি একের পর এক রবীন্দ্র বিষয়ক রচনা লিখেই চলি।

যে শহরে আমি বসবাস করতাম সেই শহরে রবীন্দ্রচর্চার পরিবেশ অনুকূল ছিল না। না ছিল ভাল গ্রন্থাগার। না আলোচনার যোগ্য মানুষ। রবীন্দ্রনাথের রচনাবলি হয়তো পাওয়া যেত, কিন্তু সেই বিষয়ে গভীর চর্চা চালিয়ে যাওয়ার আর কোনও উপাদান ছিল না। পরে যখন কাছে বিশ্ববিদ্যালয় হয়, তুলনায় উন্নত গ্রন্থাগার মেলে, বইপত্র কিছুটা সহজলভ্য হয়। কিন্তু রবীন্দ্ররচনার পটভূমি বিস্তারের যে উপকরণ সে সব সেই গ্রন্থাগারের সংগ্রহেও দুষ্প্রাপ্যই ছিল। এই স্বল্প সুযোগে সাধ্য মতো চেষ্টা করি রবীন্দ্ররচনার অন্তর্ভেদী বিশ্লেষণ করতে।

বহু সংখ্যক প্রবন্ধ অবশ্য লিখিনি, কিন্তু যেটুকু লিখেছি তাতে মৌলিক চিন্তা প্রকাশের চেষ্টা করেছি। বাহ্যিক বাধা কাটিয়ে উঠতে নিজের সাংসারিক প্রয়োজন খর্ব করে আধুনিক সাহিত্যের বই ও রবীন্দ্র সাহিত্য কিনে চলি অবিরাম। আরেকটি বইও লিখি আমি—রবীন্দ্র সম্পর্কিত রচনার সংকলন ‘বাক্যের সৃষ্টি ও রবীন্দ্রনাথ’। সেই বইয়ে আমার ভাবনাগুলো যথাসাধ্য লিপিবদ্ধ করেছি। পুলিনবিহারী সেন ছাড়া এই মফস্‌সলে আমার বড় সহায় কবি শঙ্খ ঘোষ, যিনি আমার বন্ধু ও সত্যিকারের রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ।

এত দূরে, ওই প্রতিকূলতায় এই কাজগুলো যে একসময় করতে পেরেছিলাম, তার জন্য নিজেকে মাঝে মাঝে বাহবা দেওয়ার লোভ হয়!

rabidranath jayanti special rabindranath tagore harvard
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy