Advertisement
E-Paper

উত্তাল রাজনীতির অকপট স্মৃতিকে আনন্দ-অভিবাদন

বিপ্লবী সন্তোষ রাণার স্মৃতিকথা ‘রাজনীতির এক জীবন’ (আনন্দ) ১৪২৪ সালের আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত।

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৮ ০৩:২৮
বিজয়ী। সন্তোষ রাণা।

বিজয়ী। সন্তোষ রাণা।

চার দশক আগের কথা। জুলাই, ১৯৭৭। মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে বেরিয়ে আসছেন এক বন্দি। জেলখানায় থাকতে থাকতেই গোপীবল্লভপুর আসন থেকে বিধানসভা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। অতঃপর তিনিই বিজয়ী। বন্দি এখন বিধায়ক!

বেরোনোর মুখে জেলগেটেই তাঁকে ছেঁকে ধরলেন সাংবাদিক ও স্থানীয় মানুষজন। আজকের মতো টিভি ক্যামেরা ও বুম নেই। প্রথমেই প্রশ্ন ছুটে এল, ‘মেদিনীপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। আপনি কি আমাদের সঙ্গে থাকবেন?’ বন্দি-বিধায়ক এলাকার দাপুটে নকশাল নেতা। আন্দোলনের আগুনঝরা দিনগুলিতে তাঁর দলই কলেজ স্কোয়ারে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙে স্লোগান তুলেছিল, ‘এই সমাজব্যবস্থায় যে যত পড়ে, তত মূর্খ হয়।’ ওই প্রশ্নের মধ্যে তাই সে দিন হয়তো কিঞ্চিৎ আশঙ্কাও লুকিয়ে ছিল।

আশঙ্কা এক কথায় উড়িয়ে দিলেন তিনি, ‘‘মেদিনীপুরে বিশ্ববিদ্যালয় হলে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু আমার কাছে জেলার প্রতিটি গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় তৈরি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ৭০ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় করে কী হবে?’’ জেল গেটে দাঁড়িয়ে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বাঙালি বিপ্লবী।

সেই বিপ্লবী সন্তোষ রাণার স্মৃতিকথা ‘রাজনীতির এক জীবন’ (আনন্দ) ১৪২৪ সালের আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত।

এ বারের আনন্দ পুরস্কারের বিচারকমণ্ডলীর পাঁচ সদস্য: জয় গোস্বামী, বাণী বসু, মনোজ মিত্র, সুধীর চক্রবর্তী, হাসান আজিজুল হক। তাঁদের বাছাই তালিকায় ছিল সাতটি বই। অমর মিত্রের উপন্যাস ‘কুমারী মেঘের দেশ চাই’, আশীষ লাহিড়ীর প্রবন্ধ সঙ্কলন ‘বুদ্ধিজীবীর ভাববিশ্ব সংশয়ে প্রত্যয়ে নির্মাণে বর্জনে’, কুণাল বসুর উপন্যাস ‘রবি-শঙ্কর’, গীতা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা-বিষয়ক লেখা নিয়ে ‘গদ্যসংগ্রহ’, নৃপেন ভৌমিকের ‘চিকিৎসাবিজ্ঞানকোষ’, সন্তোষ রাণার ‘রাজনীতির এক জীবন’ এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘নাটকসমগ্র’-এর দু’খণ্ড। এই সাতটি বইয়ের মধ্যে থেকে বিচার-বিশ্লেষণ শেষে পাঁচ বিচারক চূড়ান্ত পর্যায়ে নির্বাচন করেছেন সন্তোষ রাণার বইটি।

প্রাপক কিঞ্চিৎ বিমূঢ়, ‘‘পুরস্কার পেতে ভাল লাগে, কিন্তু বইটার সাহিত্যমূল্য নিয়ে একটু সংশয় ছিল।’’ বিপ্লবীরা কি এতটাই স্পষ্টবাক হন? না কি, বিপ্লবের বাইরেও রয়ে গিয়েছে আরও কিছু? ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজে তাঁর এক বাংলা রচনাকেই যে সেরার শিরোপা দিয়েছিলেন শিশিরকুমার দাশ।

সেটা মনে করাতে হাসেন তিনি, ‘‘আসলে যা মনে হয়েছে, অকপটে লিখে গিয়েছি।’’

অকপটেই বলেছেন, নকশাল আন্দোলনের সেই যুগে তাঁরা অম্বেডকর, পেরিয়ারের নাম শোনেননি! এ দেশে জাত-ব্যবস্থার গুরুত্ব নিয়ে আন্দাজ ছিল না। বাঙালি স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে প্রায়ই কেটেছেঁটে অর্ধেক জীবন লেখে। রবীন্দ্রনাথ থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সকলে। সন্তোষ রাণা ভুলের কথা লেখেন, সংশোধনের চেষ্টাও তুলে ধরেন। এখানেই ‘রাজনীতির এক জীবন’-এর গুরুত্ব।

গুরুত্ব আরও আছে। এই বই শুধু রোমাঞ্চকর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের খতিয়ান নয়। সন্তোষবাবু লিখছেন, সুবর্ণরেখার ধারে তাঁদের গ্রামে মূল উৎসব মকর। দুর্গাপুজো শুরু হয় অনেক পরে। হনুমান জয়ন্তীর রাজনীতি কেন যে বাংলায় কল্কে পায় না, পরিষ্কার। সন্তোষবাবুদের গ্রাম থেকে সরডিহা আসতে দু’দিন লাগত। সেখানেই তিনি প্রথম বৈদ্যুতিক আলো দেখেন, রসগোল্লা খান। সেই দু’দিনের রাস্তা এখন এক ঘণ্টার পথ। বাঙালির সাংস্কৃতিক স্মৃতিতেও রয়ে যাবে এই বই!

নকশাল আমলে বহড়াগোড়া থানা থেকে বন্দুক লুঠের পুরোধা ছিলেন। তার পর হিংসার রাজনীতি ক্রমে আরও বিস্তার পেল। সিপিএম থেকে এখন তৃণমূল। কী মনে হয়? ৭৫ বছরের সহজ মানুষটি হাসলেন, ‘‘সময়টা বুঝতে হবে। বহড়াগোড়ায় আমরা বন্দুক লুঠ করেছিলাম দুপুরবেলায়, তার পর সন্ধের মধ্যে জঙ্গলে। মোবাইল ফোনের যুগ হলে থাকলে এটা করা যেত না, সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়ে যেতাম। রাজনীতির প্রকরণ প্রযুক্তির সঙ্গে বদলায়। কিন্তু এখনকার হিংসা অন্য রকম।’’

জঙ্গলমহলের কথাও বললেন তিনি, ‘‘আমরা ভূমিসংস্কার, খেতমজুরি বাড়ানোর দাবিকে সামনে রেখে জনসংগঠন গড়ে তুলেছিলাম। আর মাওবাদীরা শুধুই প্রভাব বিস্তার করলেন, কিন্তু মানুষের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামালেন না।’’

এই ক্ষুরধার বিশ্লেষণী মস্তিষ্কের নিরভিমান স্মৃতিচারণকেই এ বার আনন্দ-কুর্নিশ!

Santosh rana সন্তোষ রাণা Ananda Purashkar Rajnitir Ek Jibon রাজনীতির এক জীবন
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy