প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। —ফাইল ছবি।
আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে শুনানি ছিল। পশ্চিমবঙ্গবাসী তো বটেই গোটা দেশের নজর ছিল শুনানির দিকে। মঙ্গলবারের শুনানিতে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়ে রাজ্য সরকার। প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চে তদন্তের অগ্রগতি সংক্রান্ত ‘স্টেটাস রিপোর্ট’ জমা দেওয়ার কথা ছিল সিবিআইয়ের। সেই মতো রিপোর্ট দেয় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। মঙ্গলবারের শুনানিতে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ওঠে। রাতে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের নিয়ে রাজ্য সরকারের ‘বিতর্কিত’ বিজ্ঞপ্তি, জুনিয়র ডাক্তারদের চলতে থাকা কর্মবিরতি, পুলিশের ভূমিকা— নানা বিষয় নিয়ে সওয়াল-জবাব চলে।
মঙ্গলবার সকাল ১০টা ৫৩ মিনিট নাগাদ প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্রের বেঞ্চে আরজি কর মানলার শুনানি শুরু হয়। দু’ঘণ্টারও বেশি সময় শুনানি চলে। দুপুর ১টা ১২ মিনিট নাগাদ শুনানি শেষ হয়। মঙ্গলবারের শুনানিতে কী কী ঘটল?
শুনানি শুরুর আগেই প্রধান বিচারপতির বেঞ্চের কাছে রাজ্যের আইনজীবী কপিল সিব্বল আবেদন: মামলা শুরুর আগে ৫-১০ মিনিট বলার জন্য সময় চাই।
প্রধান বিচারপতি (রাজ্যের আইনজীবীকে): নির্দেশ অনুযায়ী বলবেন। তার পর এজলাসে উপস্থিত সকলের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘কেউ হঠাৎ বলতে উঠবেন না।’’
রাজ্যের আইনজীবী: শুনানির সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করা উচিত। সেটা বন্ধ করা হোক। বাইরে বিষয়টি নিয়ে অন্য ভাবে বলা হচ্ছে। এই মামলার সঙ্গে যুক্ত মহিলা আইনজীবীদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ধর্ষণ এবং অ্যাসিড হামলার হুমকিও দেওয়া হয়েছে। আমাদের একটা খ্যাতি রয়েছে। বলা হচ্ছে, আমরা নাকি আদালতে হাসাহাসি করছি।
প্রধান বিচারপতি (রাজ্যের আইনজীবীকে): আমরা শুনানির সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করতে বলতে পারব না। এটা জনস্বার্থ মামলা। ‘ওপেন কোর্ট’-এ শুনানি হচ্ছে। আপনাদের বিষয়টি আমরা দেখব।
প্রধান বিচারপতি সিবিআইকে ‘স্টেটাস রিপোর্ট’ জমা দেওয়ার কথা বলেন। সিবিআই আধিকারিক সত্যজিৎ সিংহ সেই রিপোর্ট জমা দেন। তার পর সেই রিপোর্ট পড়েন বেঞ্চের পড়ছেন তিন বিচারপতিই।
প্রধান বিচারপতি (সিবিআইয়ের আইনজীবীকে): মামলার চার্জশিট দিতে কত দিন সময় লাগবে?
কেন্দ্রের সলিসিটর জেনারেল তথা সিবিআইয়ের আইনজীবী তুষার মেহতা: নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই চার্জশিট দেব। আমাদের ৯০ দিন লাগবে।
প্রধান বিচারপতি: সিবিআইয়ের তদন্ত ঘুমিয়ে যায়নি। তাদের তদন্ত করতে আমরা পর্যাপ্ত সময় দেব। সত্য উদ্ঘাটন করার জন্য তাদের সময় দেওয়া প্রয়োজন। তদন্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রয়েছে। সিবিআই রিপোর্টে যা দিয়েছে তা খুবই উদ্বেগের। সিবিআইয়ের রিপোর্ট দেখে আমরা বিচলিত। রিপোর্ট দেখে আমাদের মনে হয়েছে, সব বিষয়ই এখানে রয়েছে। এই অবস্থায় রিপোর্ট প্রকাশ্যে এলে তদন্ত প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
রিপোর্টে কী কী বিষয় রয়েছে, সে সম্পর্কে প্রধান বিচারপতি মঙ্গলবারের শুনানিতে বলেন, ‘‘চালান দেওয়া হয়েছিল কি না? ময়নাতদন্তের পদ্ধতি মানা হয়েছিল কি না? তথ্যপ্রমাণ নষ্ট-সহ সব বিষয় রয়েছে।’’
ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্টের আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিংহ: ঘটনাস্থলে কারা ছিলেন তাঁদের নাম জমা দিতে চাই সিবিআইকে। যাঁদের সেখানে থাকার দরকার ছিল না, তাঁরাও ছিলেন। তবে এখনই এটা প্রকাশ্যে আনতে চাই না।
প্রধান বিচারপতি: গত ১২ সেপ্টেম্বর তদন্ত সংক্রান্ত কয়েকটি বিষয় নিয়ে সিবিআইকে চিঠি দিয়েছিলেন নির্যাতিতার বাবা। ওই বিষয়গুলি গোপনীয়। তাই সেগুলি প্রকাশ্যে আনা হচ্ছে না। সিবিআইয়ের উচিত সেগুলি গুরুত্ব দিয়ে দেখা।
প্রধান বিচারপতি: নির্যাতিতার ছবি ব্যবহার নিয়ে আমরা নির্দেশ দেব। (পরে নির্দেশে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ উইকিপিডিয়াতে নির্যাতিতার নাম মোছার নির্দেশ দেয়।)
জনস্বার্থ মামলাকারী বিজয়কুমার সিঙ্ঘলের আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি: সিজার লিস্টে জিন্স ও আন্ডারগার্মেন্ট নেওয়া হয়নি। নমুনা কবে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হল? কলকাতা পুলিশ কেন ২৭ মিনিটের ফুটেজ দিল? বাকি ফুটেজ দিল না কেন? সিসিটিভির ডিভাইস ব্লক করা হয়ে থাকতে পারে।
প্রধান বিচারপতি (তুষার মেহতাকে): সিবিআই কি পুরো ফুটেজ নিয়েছে? এটা নিশ্চিত করুন পুরো ফুটেজ রয়েছে। কোনও ব্লকেজ নেই। তদন্তে কলকাতা পুলিশকে সাহায্য করতে হবে। ডিভিআর-সহ পুরো ফুটেজ দিতে হবে।
রাজ্যের আইনজীবী: সাত-আট ঘণ্টার ফুটেজ দেওয়া হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি (রাজ্যের আইনজীবীকে): তা হলে সিবিআই কেন বলছে ২৭ মিনিটের ফুটেজ দেওয়া হয়েছে? এখানে বলা হচ্ছে একটি ক্যামেরার ফুটেজ দেওয়া হয়েছে।
জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্স ওয়েস্ট বেঙ্গলের আইনজীবী করুণা নন্দী: জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতির জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে বলে বলা হয়েছে। এটা ঠিক নয়। সিনিয়র ডাক্তারেরা কাজ করছেন।
ইন্দিরা: রাজ্য এবং জুনিয়র ডাক্তারদের যে বোঝাপড়া হয়েছে তা নথিভুক্ত রাখা হোক।
রাতে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের কাজ করা নিয়ে নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল তা নিয়ে জোর সওয়াল হয় মঙ্গলবারের শুনানিতে।
প্রধান বিচারপতি: রাজ্য কী ভাবে বলতে পারে মহিলারা রাতে কাজ করতে পারবেন না? কেন মহিলাদের জন্য সীমা টেনে দেওয়া হচ্ছে? তাঁরা এমন সুবিধা চায় না। পুরুষদের মতো মহিলারাও সমান কাজ করবেন। কর্মক্ষেত্রে সকলের সমান অধিকার। রাজ্যের কাজ নিরাপত্তা দেওয়া। তারা এমন কোনও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারে না। রাজ্যের উচিত ওই বিজ্ঞপ্তি সংশোধন করা। মহিলারা রাতে কাজ করতে পারবেন না, এটা না বলে আপনারা নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করুন। রাতে অনেক মহিলা কাজ করেন। বিমান চালকদের, সেনাকে রাতে কাজ হয়। রাতে মহিলা চিকিৎসকেরা কাজ করতে না পারলে তাঁদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে। সব চিকিৎসকের জন্য একই নিয়ম হওয়া উচিত। মহিলা চিকিৎসকদের কেন নিশানা করা হল, এটা বোধগম্য নয়।
গত ১৯ অগস্ট রাজ্য সরকারের ওই সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে ‘বিতর্কিত’ অংশ মুছে দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দেন রাজ্যের আইনজীবী।
রাজ্যের আইনজীবী: ওই বিজ্ঞপ্তির ৫ এবং ৬ নম্বর অংশ নিয়ে যে আপত্তি রয়েছে তা মুছে ফেলা হবে।
প্রধান বিচারপতি: গত শুনানিতে আমরা নির্দেশ দিয়েছিলাম চিকিৎসকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে হবে। ওই বিষয়ে রাজ্য কী পদক্ষেপ করেছে?
রাজ্যের আইনজীবী: আমরা পদক্ষেপ করেছি। আদালতকে ওই বিষয়ে জানাচ্ছি। ১৪ দিনের মধ্যে চিকিৎসকদের জন্য শৌচাগার এবং হাসপাতালে সিসি ক্যামেরা বসানো হবে। নিরাপত্তার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ করা হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি: এই ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশেরই এক জন। তিনি এক জন সিভিক ভলান্টিয়ার। নিরাপত্তার জন্য সিভিক ভলান্টিয়ারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি তো? নিরাপত্তার অভাব ছিল বলেই তো ওই সিভিক ভলান্টিয়ার হাসপাতালের সর্বত্র ঘুরে বেড়িয়েছেন। আবার নিরাপত্তার দায়িত্বে অস্থায়ী কর্মী রাখবেন? যেখানে সব সময় কাজ চলছে। ডাক্তাররা ৩৬ ঘণ্টা কাজ করছেন। সেখানে এমন নিরাপত্তা কেন?
রাজ্যের আইনজীবী: পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে। ‘রাত্রি সাথী’ বলে একটি বাহিনী তৈরি করা হয়েছে। সেখানে এক বছরের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিরাপত্তার দায়িত্ব নির্দিষ্ট সংস্থাকে দেওয়া হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি (রাজ্যের আইনজীবীকে): হাসপাতালের নিরাপত্তায় চুক্তিভিত্তিক কর্মী কেন? অভিযুক্তও এক জন অস্থায়ী কর্মী ছিলেন। মাত্র সাত দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে কী ভাবে নিশ্চিত নিরাপত্তা দেওয়ার আশা করেন? রাজ্য বলছে, তারা বাইরের নিরাপত্তা সংস্থার কর্মীদের দায়িত্ব দেবেন। তাদের দায়িত্ব দেওয়ার আগে ওই সব কর্মীদের মানসিক অবস্থা দেখেছেন? এটা কোনও প্রশ্ন নয়। মূল সমস্যা হচ্ছে নিরাপত্তার দায়িত্বে অস্থায়ী কর্মী কেন? কেন রাজ্য এমন পদক্ষেপ করছে?
প্রধান বিচারপতি: রাজ্যে ২৮টি সরকারি হাসপাতাল এবং সরকারের সঙ্গে যুক্ত আরও ১৭টি হাসপাতাল রয়েছে। ওই সব হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তারেরা কাজ করেন। সেই সব হাসপাতালে ১৮-৩০ বছরের মহিলারা কাজ করেন। যেখানে যদি চুক্তিভিত্তিক কর্মী থাকে তবে বলতে হবে সেটা নিরাপদ নয়। চিকিৎসকদের নিরাপত্তার জন্য রাজ্যের উচিত হাসপাতালে পুলিশ মোতায়েন করা।
রাজ্য সরকার হাসপাতালে সিসি ক্যামেরার প্রসঙ্গ তোলে।
প্রধান বিচারপতি: এখন বলছেন আরজি কর হাসপাতালে ৪১৫টি ক্যামেরা লগানো হবে। আগে মাত্র ৩৭টি ছিল? বলতে বাধ্য হচ্ছি, কাজ অত্যন্ত ধীরগতিতে চলছে। মহিলা চিকিৎসকেরা সেমিনার হলে বিশ্রাম নিতে গেলে তাঁদের বায়োমেট্রিক নেওয়া দরকার। স্বাস্থ্যসচিবকে বলুন তার ব্যবস্থা করতে। হাসপাতালে সিসি ক্যামেরা লাগানো রয়েছে কি না তা নিশ্চিত করতে হবে জেলাশাসকদের। এমনকি মহিলা চিকিৎসকদের বিশ্রাম কক্ষেও নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করা দরকার।
রাজ্যের আইনজীবী: রাজ্যের সব হাসপাতালে চিকিৎসকদের জন্য শৌচাগার, বিশ্রাম কক্ষ, সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হবে। চিকিৎসকদের ডিউটি রুমে নিরাপত্তা দেওয়া হবে।
ইন্দিরা: আমরা জানি, আমাদের দাবি এক দিনে সব হবে না। জুনিয়র ডাক্তারেরা কাজে ফিরতে চান। কর্মবিরতির ব্যাপারে জুনিয়র ডাক্তারেরা ‘জেনারেল বডি মিটিং’ করে সিদ্ধান্ত নেবেন। এর জন্য একটু সময় লাগবে।
রাজ্য: জেনারেল বডির মিটিং কখন হবে তা আমাদের জানানো হোক।
প্রধান বিচারপতি: চিকিৎসকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে রাজ্য। জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে ফেরা উচিত। তাদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করবে না রাজ্য।
শুনানির প্রায় শেষ লগ্নে প্রধান বিচারপতি এক আইনজীবীকে: এটা কোনও রাজনৈতিক মঞ্চ নয়। বিচারের পদ্ধতি মেনে চলুন। আমরা ডাক্তারদের চিন্তার বিষয়গুলি দেখছি। আপনি যদি বলেন মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের নির্দেশ দিতে হবে সেটা হতে পারে না। এটা আমাদের কাজ নয়।
শুনানি শেষে মঙ্গলবার কী কী নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট?
উইকিপিডিয়া থেকে নির্যাতিতার নাম এবং ছবি মুছে ফেলতে হবে।
নির্যাতিতার বাবা সিবিআইকে যে চিঠি দিয়েছিলেন, তদন্তকারী সংস্থাকে সেই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।
আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে জেলাশাসক, মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ এবং সিনিয়র চিকিৎসকদের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা করে হাসপাতালে শৌচাগার এবং সিসি ক্যামেরা বসাতে হবে।
মহিলা চিকিৎসকেরা সেমিনার হলে বিশ্রাম নিতে গেলে তাঁদের জন্য বায়োমেট্রিক ব্যবস্থা করতে হবে। নিরাপত্তার জন্য স্বাস্থ্যসচিবকে এই বিষয়ে পদক্ষেপ করতে হবে।
ওই ঘটনার (আরজি করের মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুন) পরে হাসপাতালের পুরো সিসিটিভি ফুটেজ সিবিআইকে দিতে হবে পুলিশকে। ফুটেজ নিয়ে কী কী সমস্যা রয়েছে, তা খুঁজে বার করে মেটাতে হবে। তদন্তে পুলিশকে পূর্ণ সহযোগিতা করতে হবে।
জুনিয়র ডাক্তারেরা বৈঠক করে কাজে যোগ দিলে রাজ্য সরকার কোনও কড়া পদক্ষেপ করতে পারবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy