Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
দ্বিমত চিকিৎসকরা

চার ঘণ্টা না কাটলে কেন অমিল ডেথ সার্টিফিকেট

মায়ের মরদেহ ছুঁয়ে বসেছিলেন গোপীচাঁদ। পেট ফুলে গিয়েছে। দীর্ঘ রোগভোগে শরীরটা ছোট। সেই দেহ দেখে ডুকরে কেঁদে চলেছেন গোপীচাঁদ ও পরিজনেরা। কিন্তু দাহ করার উপায় নেই। পাড়ার ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছেন, চার ঘণ্টা না কাটলে ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ দেওয়া যাবে না। অগত্যা, নিথর দেহ ধরে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই গোপীচাঁদের।

দেবজিৎ ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৬ ০৩:৫৬
Share: Save:

মায়ের মরদেহ ছুঁয়ে বসেছিলেন গোপীচাঁদ। পেট ফুলে গিয়েছে। দীর্ঘ রোগভোগে শরীরটা ছোট। সেই দেহ দেখে ডুকরে কেঁদে চলেছেন গোপীচাঁদ ও পরিজনেরা। কিন্তু দাহ করার উপায় নেই। পাড়ার ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছেন, চার ঘণ্টা না কাটলে ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ দেওয়া যাবে না। অগত্যা, নিথর দেহ ধরে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই গোপীচাঁদের।

হাওড়ার জয়পুরের এক প্রান্তিক গ্রামের বাসিন্দা হরিহর জানার বিড়ম্বনা আবার অন্য রকম। জীবদ্দশায় বাবা দেহ দানের অঙ্গীকার করায় তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ম্যাটাডর জোগাড় করে এনেছিলেন হরিহর। কিন্তু ডাক্তার বলে গিয়েছেন, চার ঘণ্টার আগে কোনওমতেই ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ দেওয়া যাবে না। গনগনে রোদে জয়পুর থেকে মোট ছ’ঘণ্টা পেরিয়ে কলকাতায় পৌঁছে সেই দেহ আদৌ কাজে লাগার মতো অবস্থায় থাকবে কি না, তা ভেবে আকুল গোটা পরিবার।

গোপীচাঁদ কিংবা হরিহরের এই দুর্ভোগ নতুন নয়। বহু পরিবারকেই এমন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। অথচ, কোন নিয়মবলে মৃত্যুর পরে চার ঘণ্টা না পেরোলে ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া যাবে না, তার হদিস দিতে পারেননি কেউই।

যদিও চার ঘণ্টার আগেও যে ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া যেতে পারে, তার উল্লেখ রয়েছে সরকারি নির্দেশেই। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন স্বাস্থ্যসচিবের জারি করা এক নির্দেশে সরকারি ডাক্তারদের উদ্দেশে বলা হয়, অঙ্গীকারবদ্ধ ব্যক্তির চোখ যাতে কাজে লাগানো যায় তার জন্য মৃত্যুর ঠিক এক ঘণ্টা পরে রোগীর দেহ তাঁর পরিজনদের হাতে তুলে দেওয়া যেতে পারে। ওই সময়ের মধ্যে ডেথ সার্টিফিকেটও দিয়ে দিতে হবে বলে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের নির্দেশ দেন স্বাস্থ্যসচিব। যদিও স্বাস্থ্যসচিবের ওই নির্দেশের অস্তিত্বের কথাই জানেন না বহু চিকিৎসক। তাই নির্দেশ মানা হয় না বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই।

কেন মানা হয় না? রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা (শিক্ষা) সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের জবাব, ‘‘সব আমিই বলব নাকি? রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার দিলীপ ঘোষকে জিজ্ঞেস করুন।’’

প্রশ্ন শুনে দিলীপবাবুর প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘‘আমাকে একটু সময় দিতে হবে। অনেকের সঙ্গে কথা বলতে হবে।’’ এর পরে বেশ কিছু দিন সময় নিয়ে রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার বলেছেন, ‘‘মৃত্যুর পরে চার ঘণ্টা না কাটলে ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া যাবে না, কোড অব মেডিক্যাল এথিকস-এ এমন কোনও নিয়মের উল্লেখ নেই। এটা প্রথা হিসেবেই চলে আসছে।’’ সুকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতো প্রবীণ চিকিৎসকও এর ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। তাঁর কথায়, ‘‘নিশ্চয়ই কোথাও কোনও কারণ আছে, না হলে আমরা দেব কেন?’’

এমন আর এক প্রথার দাপটেই এখনও সূর্যাস্তের পরে ময়না-তদন্ত হয় না। সমাজতত্ত্ববিদদের একাংশ বলছেন, ময়না-তদন্ত যখন চালু হয়েছিল তখন এত জোরালো আলোর ব্যবস্থা ছিল না, সন্ধের পরে কুপিই ছিল ভরসা। তাই আকাশে সূর্য থাকতে থাকতে যাবতীয় কাঁটাছেঁড়া সেরে ফেলা হতো। এখন বড় আলোর দৌলতে রাত-দিনের তফাৎ মুছে গিয়েছে। সেই আলোয় সন্ধ্যার পরে যদি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার চলতে পারে, তা হলে ময়না-তদন্ত নয় কেন?

ডাক্তারদের একাংশ যুক্তি দিচ্ছেন, হৃৎপিণ্ড বন্ধের তিন মিনিট পরে কোষের মৃত্যু শুরু হয়। এর পরেই সমস্ত অঙ্গ ঠান্ডা ও শক্ত হতে শুরু করে। চোখের মণি স্থির হয়। এর জন্যই বেশ কিছুটা সময় নিতে হয় বলে জানাচ্ছেন ডাক্তাররা। তাই বলে চার ঘণ্টা? হাওড়ার শিশু রোগ চিকিৎসক শুভাশিস সরকার বললেন, ‘‘বিতর্ক তৈরি হোক। এতে সমাজেরই ভাল হবে।’’

এক দল ডাক্তার আবার যুক্তি দিচ্ছেন, হৃদপিণ্ডে জল জমে থাকলে অনেক সময় তা স্টেথোস্কোপের সাহায্যে বোঝা যায় না। এমনকী, হৃদ্স্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও ফের চালু হতে পারে। তাই, ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়ার আগে কিছুটা সময় নেওয়া বাঞ্ছনীয়। সমাজতত্ত্ববিদদের একাংশ জানাচ্ছেন, এই ধারণা থেকেই মরদেহ ছুঁয়ে থাকার চল এসেছে।

কেন শুধুই প্রথার বশবর্তী হয়ে চার ঘণ্টার না পেরোলে ডাক্তাররা ডেথ সার্টিফিকেট লিখবেন না, তা নিয়ে অনেক দিন ধরে সরব একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। ওই সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ব্রজ রায় বলেন, ‘‘আমরা বিভিন্ন সময়ে ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে এই প্রথা শিথিল করার আবেদন জানিয়েছি। কিন্তু ডাক্তাররা নিজের যুক্তিতেই অটল থেকেছেন।’’ নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাটমি বিভাগের এক শিক্ষক বলেন, ‘‘শীতকালে মৃত্যুর ছ’ঘণ্টা পরেও দেহ নেওয়া যায়। কিন্তু গরমকালে ঝুঁকি থেকে যায়। পচন ধরে গিয়েছে, এমন বেশ কিছু দেহ আমরা ফেরত পাঠাতে বাধ্য হই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Death certificate
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE