গত এক দশকের বেশি সময় ধরেই ফারাক দেখা যাচ্ছিল। তবে ২০২৫ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রীরা ছাত্রদের ১ লক্ষ ২৭ হাজারে টপকে গিয়েছে। এটা শিক্ষামহলের অনেকের মতে ‘নিউ নর্মাল’। কিন্তু মাধ্যমিকে ছাত্রের সংখ্যা কম কেন? কেন বেশি ছাত্রীদের সংখ্যা? ছাত্রেরা কি বেশি সংখ্যায় ‘স্কুলছুট’ হচ্ছে? না কি ছাত্রীদের স্কুলে অন্তর্ভুক্তি বেড়েছে? যদি স্কুলছুট ছাত্রদের সংখ্যা বেশি হয়ে থাকে, তা হলে তারা যাচ্ছে কোথায়? ছাত্রীদের সংখ্যা বাড়লে সেটাই বা কেন হচ্ছে?
বিভিন্ন মহলের ব্যাখ্যা বিবিধ। কিন্তু একটা বিষয় অধিকাংশই উল্লেখ করছেন— ছাত্রীদের শিক্ষাঙ্গনমুখী করতে এবং বাল্যবিবাহ ঠেকাতে রাজ্য সরকারের যে বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে, পরীক্ষার্থীর সংখ্যায় তার প্রতিফলন রয়েছে।
চলতি বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে গত ১০ ফেব্রুয়ারি। প্রথম এবং দ্বিতীয় ভাষার পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে। শনিবার অঙ্ক পরীক্ষা। ২২ ফেব্রুয়ারি ঐচ্ছিক বিষয়ের পরীক্ষা দিয়ে মাধ্যমিক শেষ। মধ্যশিক্ষা পর্ষদের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে ৯ লক্ষ ৮৪ হাজার ৬৯০ জন। তার মধ্যে ছাত্র ৪ লক্ষ ২৮ হাজার ৭৮২ জন এবং ছাত্রী ৫ লক্ষ ৫৫ হাজার ৯০৮ জন। এই পরিসংখ্যানকে মূলত দু’ভাবে দেখা হচ্ছে। একাংশের বক্তব্য, ছাত্রের সংখ্যা কমেছে। কারণ, গ্রামাঞ্চলে অনেকেই স্কুলছুট হচ্ছে। তারা পেটের তাগিদে পড়াশোনা ফেলে রেখে কাজ করতে চলে যাচ্ছে। অনেক সময় ভিন্রাজ্যেও। ফলে ফারাক এতটা বেশি। আবার অন্য অংশের বক্তব্য, ছাত্রের সংখ্যা কমেনি। বরং ছাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে। তাই এই তফাত নজরে পড়ছে। ছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধির নেপথ্যে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন কল্যাণমূলক প্রকল্পই অন্যতম কারণ বলে অভিমত তাঁদের।

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
শিক্ষা দফতর সূত্রের তথ্য বলছে, ২০১১ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত প্রতি বার মাধ্যমিকেই ছাত্রের তুলনায় ছাত্রী পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি ছিল। উল্লেখ্য, ২০১১ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় ক্ষমতায় ছিল বামফ্রন্ট সরকার। সে বছর মে মাসে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। সেই পালাবদলের বছরেও ছাত্রের তুলনায় মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছাত্রীর সংখ্যা ছিল প্রায় ২৫ হাজার বেশি। তখন ‘কন্যাশ্রী’, ‘শিক্ষাশ্রী’ বা ‘সবুজ সাথী’র মতো ছাত্রবন্ধু প্রকল্পগুলি ছিল না। তখনও এই ধারা দেখা গিয়েছিল। ফলে প্রকল্পই যে একমাত্র কারণ, তা বলা যায় না। সর্বশিক্ষা মিশনের একাধিক রিপোর্ট বলছে, কেন্দ্রে প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলেই সারা দেশে স্কুলছুটের সংখ্যা ধারাবাহিক ভাবে কমানোর প্রয়াস শুরু হয়েছিল। মেয়েদের স্কুলমুখী করার ধারাও তখন থেকেই শুরু। তার কারণ হিসাবে অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ‘মিড ডে মিল’ ব্যবস্থার সাফল্যের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছিলেন। যদিও মিড ডে মিলে মাথাপিছু বরাদ্দ, গুণগত পুষ্টি ইত্যাদি নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০১১ সালের পর থেকে যত সময় এগিয়েছে, তত মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্র এবং ছাত্রীর সংখ্যার ব্যবধান বেড়েছে। ২০১৮ সালে ছাত্রের তুলনায় ছাত্রীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১২ শতাংশ বেশি। আবার যে দু’বছর মাধ্যমিকের সময়ে কোভিডের ভয়াবহতা ছিল, সেই ২০২১ এবং ২০২২ সালের মাধ্যমিকে ছাত্রের তুলনায় ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ১১ শতাংশ বেশি। এ বছরের ফারাকও নজরে পড়ার মতো।
আরও পড়ুন:
রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু এর মোট ছ’টি কারণ ক্রমানুযায়ী উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে প্রথম কারণ, ‘কন্যাশ্রী’, ‘সবুজ সাথী’র মতো প্রকল্প। এই প্রকল্পগুলো ছাত্রীদের স্কুলে পড়ার প্রবণতা বৃদ্ধি করেছে। দ্বিতীয়ত, প্রতি শ্রেণিতে ধারাবাহিক ভাবে ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীরা বেশি সংখ্যায় পড়ে এসেছে। সেই সংখ্যার প্রতিফলন রয়েছে মাধ্যমিকে। তৃতীয়ত, পড়ুয়াদের যাতে পড়াশোনার জন্য দূরে না যেতে হয়, তার জন্য ‘পাবলিক স্কুল নেটওয়ার্ক’ শক্তিশালী করা হয়েছে। ফলে মেয়েরা স্কুলে আসছে বেশি। চতুর্থত, সার্বিক ভাবে রাজ্য সরকারের তরফে মহিলাদের ক্ষমতায়ণের প্রশ্নে ‘সদর্থক ভূমিকা’। পঞ্চমত, প্রতিটি পরিবারে মহিলারা নানা ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গায় পৌঁছচ্ছেন। এর অন্যতম কারণ ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর মতো প্রকল্প। যার ফলে মহিলারা আর্থিক ভাবে সাবলম্বী হচ্ছেন। মায়ের প্রভাব পড়ছে মেয়ের উপর। ঝোঁক বাড়ছে লেখাপড়া করার। ব্রাত্যের মতে ষষ্ঠ কারণ, পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যায় লিঙ্গ (পুরুষ-মহিলা) অনুপাত জাতীয় গড়ের চেয়ে ভাল।
কোভিডের সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার ছবি দেশ জুড়েই বেআব্রু হয়ে গিয়েছিল। রাজ্যের কত শ্রমিক ভিন্রাজ্যে গিয়ে কাজ করেন, তা প্রকাশ্যে চলে এসেছিল। মাধ্যমিকে ছাত্রের সংখ্যা কমে যাওয়ার নেপথ্যে স্কুলের ছাত্রদের পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে যাওয়ার ঘটনা রয়েছে বলে অনেকের দাবি।
যদিও তা মানতে চাননি রাজ্যসভার তৃণমূল সাংসদ তথা পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান সামিরুল ইসলাম। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের রাজ্যের যে শ্রমিকেরা অন্য রাজ্যে গিয়ে কাজ করেন, তাঁদের নাম সরকারের কাছে নথিভুক্ত আছে। তাতে মাধ্যমিক পড়ুয়ার বয়সি কেউ নেই।’’ তাঁর এ-ও যুক্তি, ‘‘কেরল, মহারাষ্ট্রের মতো যে রাজ্যগুলিতে বাংলার শ্রমিকেরা যান, সেখানে অপ্রাপ্তবয়স্ক কাউকে কাজে নেওয়া হয় না। ফলে এই যুক্তি সঠিক নয়।’’ তবে শাসকদলের প্রথম সারির এক নেতার বক্তব্য, ভিন্রাজ্যে না গেলেও গ্রামাঞ্চলে ছাত্রদের মধ্যে পড়াশোনা ছেড়ে কাঁচা টাকা রোজগারের প্রবণতা রয়েছে। যদিও তার কোনও পরিসংখ্যান নেই।
শাসকদলের ছাত্র সংগঠন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্যের আবার বক্তব্য, ‘‘ছাত্রসংখ্যা কমেনি। বরং বেড়েছে ছাত্রীর সংখ্যা। কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের প্রকল্প।’’ তাঁর কথায়, ‘‘স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত মেয়েরা কন্যাশ্রী পাচ্ছেন। সরকার তাঁদের পড়ার টাকা দিচ্ছে। সেই কারণে পরিবারও বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে না। আবার পরিপার্শ্ব দেখে মেয়েদের মধ্যেও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মনোভাব ক্রমে বাড়ছে।’’ সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএএফআই আবার এই ফারাকের পরিসংখ্যানে ‘সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক অভিঘাত’ দেখছে। সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক দেবাঞ্জন দে বলেন, ‘‘সরকার যে তথ্য দিচ্ছে, তার আড়ালে আরও ভয়াবহ তথ্য রয়েছে। কোচবিহারে মাধ্যমিকের জন্য এ বার নাম নথিভুক্ত করিয়েছিল ৪৫ হাজার। কিন্তু পরীক্ষায় বসেছে মাত্র ন’হাজার। পাঁচ ভাগের এক ভাগ। সরকার কি স্কুলছুটদের শিক্ষাঙ্গনে ফেরানোর কোনও পরিকল্পনা করেছে?’’
অধ্যাপিকা তথা সমাজকর্মী শাশ্বতী ঘোষ ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যার ক্রমবর্ধমান ফারাকের নেপথ্যে সম্ভাব্য দু’টি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। এক, ছেলেরা কাজে চলে যাচ্ছে। দুই, মেয়েরা নানাবিধ প্রকল্পের সুবিধা পেয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে গত ১৪ বছরের পরিসংখ্যান বলছে, এগিয়ে থেকেছে মেয়েরাই। সেই সংখ্যা বছরে বছরে বেড়েছে। এ বারেও তার অন্যথা হয়নি। এটাই ‘নিউ নর্মাল’।