ছন্দ কেটেছে পশ্চিমবঙ্গ কবিতা অ্যাকাডেমির কাজে? কবিতা অ্যাকাডেমি আয়োজিত কবিতা উৎসব বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে নানাবিধ প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে কবি ও আবৃত্তিকার মহলে। সংশ্লিষ্ট মহলের অনেকেই মনে করছেন, আর্থিক অনিয়ম এবং স্বজনপোষণের অভিযোগ আগে থেকে ছিলই। তা প্রশাসনেরও গোচরে এসেছে। তার পরেই বন্ধ করা হয়েছে কবিতা উৎসব।
শেষ বার কবিতা উৎসব হয়েছিল ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে। প্রতি অর্থবর্ষেই জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে এই উৎসব হয়ে থাকে। গত অর্থবর্ষে হল না।
কবি-আবৃত্তিকারদের একটি অংশের বক্তব্য, অ্যাকাডেমির অভ্যন্তরে কয়েক জনের কাজ নিয়ে ‘ক্ষোভ’ জমছিল। এক প্রবীণ ব্যক্তি কয়েক বছর আগে ঘনিষ্ঠমহলে উষ্মা প্রকাশ করেন পুরস্কারপ্রাপকদের নামের তালিকা নিয়ে। সেই সময়েই তিনি সরকারের সর্বোচ্চ স্তরে বিষয়টি জানানোর জন্য দৌত্য শুরু করেছিলেন। কারও কারও অনুমান, এমনই ‘ক্ষুব্ধ’ কেউ কেউ প্রশাসনিক স্তরে অভিযোগ জানিয়ে থাকতে পারেন। যদিও এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক ভাবে কেউ কিছু বলতে চাননি। ‘ধোঁয়াশা’ কাটাননি অ্যাকাডেমির সভাপতি কবি সুবোধ সরকারও। তবে উৎসব যে বন্ধ হয়েছে, এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। কেন উৎসব বন্ধ হল, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে কমিটির সদস্য বাচিকশিল্পী ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়েরও।
আরও পড়ুন:
কী কী অভিযোগ উঠছে? প্রথমত, সকলকে সুযোগ না করে দিয়ে অ্যাকাডেমির কর্তাদের ‘ঘনিষ্ঠদের’ মঞ্চ পাইয়ে দেওয়া। অনুষ্ঠানে সুযোগ দেওয়ার বিনিময়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অর্থের লেনদেনের অভিযোগও উঠছে কবি-আবৃত্তিকারদের মহল থেকে। প্রশ্ন উঠছে বিগত দিনে হওয়া অনুষ্ঠানের খরচ নিয়ে। পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রেও ‘আমরা-ওরা’ চলছে বলে অভিযোগ।
একাধিক কবি এবং আবৃত্তিকার কবিতা অ্যাকাডেমির কাজ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। প্রবীণ আবৃত্তিশিল্পী এবং অভিনেতা প্রবীর ব্রহ্মচারীর কথায়, ‘‘ওখানে নির্বোধদের স্তাবকেরা সবটা পরিচালনা করেন। নিজেদের ভিতরেও অনেকগুলি গোষ্ঠী রয়েছে। ফলে উৎসব বন্ধ হওয়ারই ছিল।’’ কবি সুরঙ্গমা ভট্টাচার্যের অভিযোগ, ‘‘কবিতা অ্যাকাডেমিতে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের মূল উদ্দেশ্য সরকারি টাকা এবং অন্যান্য সুবিধা ভোগ করা। কবিতা সেখানে মুখোশ মাত্র। সরকারি টাকা কয়েক জনের নয়। তা যথার্থ ভাবে ব্যবহৃত হোক। প্রয়োজনে সরকার মতামতও নিতে পারে।’’ তরুণ কবি অমৃতা ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘সরকারি জায়গায় উৎসব বন্ধ হয়ে যাওয়াটা অনভিপ্রেত। যেখানে সরকারি অর্থ জড়িত, সেটা কেন বন্ধ হল তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘দীর্ঘ দিন ধরে দুর্নীতি সংক্রান্ত নানা অভিযোগ আসতে থাকলে সে সব অভিযোগের কারণ খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। প্রয়োজন হলে ভারপ্রাপ্ত কর্তৃত্বের পরিবর্তন ঘটিয়ে দেখা দরকার তাতে সমস্যার সমাধান হয় কি না! কবিতা আ্যাকাডেমি বাংলার কবি এবং বাচিকশিল্পীদের কাছে একটা নির্ভরযোগ্য সরকারি প্রতিষ্ঠান। এখানে যে কোনও সমস্যার আশু সমাধানের দরকার।’’
কবি নিয়াজুল হক আবার ভিন্ন প্রশ্ন তুলছেন। তাঁর মনে হয়েছে, রাজ্য সরকার সংখ্যালঘুদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে কাজ করলেও কবিতা অ্যাকাডেমির কাজে রাজ্য সরকারের সেই উদ্যম মার খাচ্ছে। নিয়াজুলের কথায়, ‘‘কবিতার ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান বাছবিচার করি না। কিন্তু আমি আমার সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করছি। আমার মতো একজন সরকারি মঞ্চে কবিতা পাঠ করলে সম্প্রদায়ের অগ্রগমন হয়। শুধু আর্থিক অগ্রগমন নয়, সংখ্যালঘুদের সাংস্কৃতিক অগ্রগমনও জরুরি।’’ তাঁর অভিযোগ, মুসলিম কবিদের দু’-চার জন ডাক পেলেও সার্বিক ভাবে সকলকে ডাকা হয় না।
উল্লেখ্য, উপরে উল্লিখিত কবি এবং আবৃত্তিকারদের সকলের সঙ্গেই কবিতা অ্যাকাডেমির ‘দূরত্ব’ রয়েছে। ফলে তাঁদের এমন অভিযোগ অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু কমিটির সদস্য খ্যাতনামী বাচিকশিল্পী ব্রততীও কবিতা উৎসব বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে জানিয়েছেন, তাঁর নিজের মধ্যেও এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ব্রততীর কথায়, ‘‘কেন কবিতা উৎসব হয়নি, তা আমি জানি না। এ নিয়ে আমার মধ্যেও প্রশ্ন রয়েছে। এই উৎসবের দিকে নতুনেরা তাকিয়ে থাকেন। আশা করব, পরের বার হবে।’’ কবিতা উৎসব হবে না, এই মর্মে অ্যাকামেডির কমিটিতে কোনও আলোচনা হয়েছিল? ব্রততীর জবাব, ‘‘না।’’ শেষ কবে বৈঠক হয়েছে? ব্রততী বলেন, ‘‘সম্ভবত গত বছর জুন-জুলাই মাস নাগাদ। তবে সেটাও ঠিক মনে নেই।’’
বিষয়টি বিশদে জানার জন্য অ্যাকাডেমির সভাপতি সুবোধের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি বিষয়টি ‘এড়িয়ে’ গিয়েছেন। সুবোধ সোমবার প্রথমে আনন্দবাজার ডট কম-এর সঙ্গে ফোনে কথা বলার পরে বলেন, হোয়াট্সঅ্যাপে লিখিত ভাবে ‘সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন’ পাঠাতে। তা তাঁকে পাঠানোও হয়। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা কাটতে চললেও সেই প্রশ্নের কোনও জবাব আসেনি। সুবোধকে প্রথম হোয়াট্সঅ্যাপ বার্তা পাঠানো হয় সোমবার দুপুর ১টা ২০ মিনিটে। জানতে চাওয়া হয়, কখন তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলা যাবে। দুপুর ১টা ৫২ মিনিটে সুবোধ জানান, বেলা ৩টে নাগাদ তাঁকে ফোন করা যাবে। বেলা ৩টে ১১ মিনিটে ফোন করা হলে মিনিট তিনেক কথা বলেন তিনি। তার পরে জানান, লিখিত ভাবে ‘সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন’ পাঠালে তিনি লিখিত ভাবেই জবাব পাঠাবেন। সোমবার বেলা ৩টে ১৭ মিনিটে সুবোধকে ‘সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন’ লিখিত ভাবেই পাঠানো হয়— কবিতা অ্যাকাডেমি আয়োজিত কবিতা উৎসব কেন বন্ধ হল, তা নিয়ে কবি ও আবৃত্তিকারদের মধ্য থেকে প্রশ্ন উঠছে। কেউ কেউ এমনও অভিযোগ করছেন যে, অর্থনৈতিক অনিয়ম এবং স্বজনপোষণের কারণে সরকারের নির্দেশেই উৎসব বন্ধ হয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে পারলে ভাল হয়।
তার পরে প্রায় ২৪ ঘন্টা কেটে গিয়েছে। সুবোধের জবাব আসেনি। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পরে অ্যাকাডেমির সভাপতি সুবোধ জবাব দিলে তা এই প্রতিবেদনে সংযুক্ত করা হবে।