চাষবাসের মতো কিছু কাজে এখনও পুরুষদের প্রাধান্য। কিন্তু সেই চেনা ধারণার ছক ভেঙে দিয়েছেন খয়রাশোলের কয়েক জন মহিলা নিজেরা নতুন ‘শ্রী’ পদ্ধতিতে ধান চাষ করেছেন তা-ই নয়, সেই ধান বীজ হিসাবে বিক্রির ছাড়পত্রও আদায় করে নিয়েছেন।
বীরভূমের খয়রাশোল ব্লকের খন্নি গ্রামের ৪টি স্বনির্ভর দলের ১২ জন মহিলা সদস্য। গত শনিবার থেকেই লোকপুরে মাতঙ্গিনী সঙ্ঘের কার্যালয় থেকে ৩০ টাকা কিলো দরে ওই ‘সার্টিফায়েড’ বীজ বিক্রি শুরু হয়েছে।
খয়রাশোলের সব স্বনির্ভর গোষ্ঠীই ওই মাতঙ্গিনী সঙ্ঘের আওতাভুক্ত। তাদের মাধ্যমেই সিড কর্পোরেশনে বীজ উৎপাদন ও বিক্রির লাইসেন্স চেয়ে আবেদন করেছিলেন স্বনির্ভর দলের সদস্যেরা। বর্ধমানে সরকারি পরীক্ষাগার বীজ পরীক্ষা করে জানিয়ে দিয়েছে, গুণমানে তা ৯৯.৪৭ শতাংশ খাঁটি। বীজ বিক্রির সূচনা অনুষ্ঠানে জেলার সহ-কৃষি অধিকর্তা (সিড সার্টিফিকেশন) মিনাজুর হাসান বলেন, ‘‘রাজ্য তো বটেই, দেশের নিরিখেও ওঁদের সাফল্য প্রশংসনীয়। তুলনামূলক ভাবে কম পয়সায় চাষিরা এই বীজ কিনতে পারবেন। বীজ বিক্রি হতে থাকলে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখবেন উদ্যোক্তা মহিলারা।’’
ওঁরা— ‘বন্ধন’ স্বনির্ভর দলের সদস্য নাসিমা বিবি, ‘শাল’ স্বনির্ভর দলের লুতফা বিবি, ‘কাকাবাবু’ দলের সরফুন্নেসা বিবিরা ও ‘নবচেতনা’ দলের আঙ্গুরা বিবিরা অবশ্য বলছেন, ধারাবাহিক পরিশ্রম ও যত্নে তাঁরা সবে এক ধাপ এগিয়েছেন। এ বার তাঁরা উৎপাদিত বীজ স্থানীয় ভাবেই বিক্রি করবেন। কিন্তু তাঁরা চান, সিড কর্পোরেশন যেন ভবিষ্যতে তাঁদের থেকেই ‘সার্টিফায়েড’ বীজ কেনে।
এই সাফল্যের বীজতলা অবশ্য তৈরি করেছে ‘লোককল্যাণ পরিষদ নামে একটি সংস্থা। বীরভূমে তারা জাতীয় গ্রামীণ জীবিকা মিশন (এমআরএলএম) রূপায়ণের দায়িত্বে রয়েছে। মহিলা কিসান স্বশক্তিকরণ পরিযোজনা প্রকল্পের (এমকেএসপি) অন্তর্গত ওই মিশন।
এমকেএসপি-র মূল উদ্দেশ্য, কৃষি কাজে মহিলাদের যোগ দেওয়ানোর মধ্যে দিয়ে তাঁদের আর্থিক স্বচ্ছলতা বাড়ানো। তাদের সহায়তায় এ বার বীরভূমের চারটি ব্লকে প্রায় তিনশো মহিলা কৃষক আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ‘শ্রী’ পদ্ধতিতে ধান চাষে যুক্ত হয়েছিলেন। এঁরা সকলেই কোনও না কোনও মহিলা স্বনির্ভর দলের সদস্য। লোকপুর পঞ্চায়েতের খন্নিগ্রামের স্বনির্ভর দলগুলিও সেই তালিকায় ছিল। কৃষি দফতর সরাসরি প্রকল্প রূপায়ণে যুক্ত ছিল না। লোককল্যাণ পরিষদই সেই দায়িত্বে ছিল।
২০১১ সাল থেকে মহিলা স্বনির্ভর দলের সদস্যদের নিয়ে কাজ করে আসা ওই সংস্থার জেলা প্রকল্প ম্যানেজার দুর্গা ভট্টাচার্য এবং সদস্য সুমনা মজুমদার জানান, লোকপুর পঞ্চায়েত এলাকার স্বনির্ভর দলের মহিলা সদস্যদের দায়িত্ব পাওয়ার পরে তাঁরা খন্নিগ্রামের ১০টি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর উৎসাহী সদস্যদের দিয়ে ‘শ্রী’ পদ্ধতিতে ধান চাষ করান। পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দেয় ব্লক কৃষি দফতর। গ্রামে ৫৩ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেন ৯টি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ৭০ জন সদস্য। এরই মধ্যে চারটি দলের ১২ জনকে দিয়ে বীজ উৎপাদনের জন্য সাড়ে সাত বিঘা জমিতে চাষ করানো হয়। সেই ধানই বীজ হিসাবে বিক্রি হচ্ছে।
দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার মতে, স্বনির্ভর দলের ওই ১২ জন সফল হয়েছেন প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ খুব ভাল করে মেনে চলেই। কৃষিকাজের প্রতিটি ধাপ — যেমন বীজ বাছাই থেকে শোধন, সার প্রয়োগ থেকে পোকার আক্রমণ রোখা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে জ্ঞানে তাঁরা পুরুষদের সমানে টক্কর দিতে পারেন। নাসিমা-লুতফারা খুশি, প্রথম বারেই তাঁরা ৫৩ কুইন্ট্যাল ধান উৎপাদন করেছেন। বীজ বিক্রি শুরু হতেই, প্রথম দিনে ১৮ জন কৃষক তাঁদের সঙ্ঘ থেকে বীজ কিনেছেন।
খয়রাশোলের সহ-কৃষি অধিকর্তা দেবব্রত আচার্য বলেন, ‘‘মহিলারা চাষে এমন সাফল্য পেলে পরিবারে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আসবে। ঘরের কাছে ভাল মানের বীজও পাবেন চাষিরা।’’