Advertisement
০৩ মে ২০২৪
Crime

সমীক্ষার পরে ফাঁদ, রয়েছে সিন্ডিকেটও

ডুয়ার্সে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি জানাচ্ছে, মেয়েদের প্রথমে কলকাতা তো বটেই, তার সঙ্গে দিঘা, মন্দারমণির মতো সৈকতের রিসর্টগুলিতে কাজে পাঠানো হয়।

Women trafficking

—প্রতীকী ছবি।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০২৩ ০৮:৩৪
Share: Save:

কোথাও সিন্ডিকেট, কোথাও আবার সমীক্ষক দল!

পাচারের জন্য মেয়েদের কোন জায়গা থেকে কী ভাবে খুঁজে বার করতে হবে, কোন ‘মন্ত্রে’ তাঁদের মন ভেজাতে হবে, সর্বোপরি কী ভাবে তাঁদের পাঠিয়ে দিতে হবে ‘যথাস্থানে’, এর জন্য এক এক জায়গায় এক এক রকম ‘ব্যবস্থা’।

যেমন ধরা যাক ডুয়ার্স। এখানে পাচার-তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পেরেছে, এলাকা জুড়ে রীতিমতো সমীক্ষা চালায় পাচার চক্রের দালাল বা আড়কাঠিরা। প্রথমেই তারা খোঁজ করে, কোন পরিবারে পুরুষেরা অতিরিক্ত মাদকাসক্ত। সেই সব পরিবারে মেয়েরা যথেষ্ট কষ্টে থাকেন। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্যেরা জানান, এই পরিবারগুলিকেই প্রধানত নিশানা করে পাচার চক্রের দালালেরা। একে টাকাপয়সার অভাব, তার উপরে দুর্বিষহ পারিবারিক জীবন, এই দুইয়ের ফাঁস থেকে ‘উদ্ধার’ করতে তারা নিয়ে আসে নানা চাকরির টোপ। পারিবারিক জীবনে কষ্টে থাকা মহিলারা সেই কাজ নিয়ে নেন।

ডুয়ার্সে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি জানাচ্ছে, মেয়েদের প্রথমে কলকাতা তো বটেই, তার সঙ্গে দিঘা, মন্দারমণির মতো সৈকতের রিসর্টগুলিতে কাজে পাঠানো হয়। সেখানে থাকাকালীন মেয়েরা চালচলনে ‘চোস্ত’ হয়ে গেলে তাঁদের দিল্লি নিয়ে যাওয়া হয়। তার পরে তুলে দেওয়া হয় কোনও চক্রের হাতে।

শুধু ডুয়ার্স নয়, পাহাড়ের মেয়েদেরও অনেক ক্ষেত্রে একই ভাবে পাচার করা হয়। সেই দলে দার্জিলিং, কালিম্পঙের মতো থাকেন সিকিম, এমনকি নেপালের মেয়েরাও। তাঁদের অনেকেই প্রথমে কাজ পান কলকাতা, দিল্লি, মুম্বইয়ের মতো কোনও শহরের বিউটি পার্লার, মাসাজ পার্লারে। পাহাড়ের ক্ষেত্রে অনেক সময়ে আড়কাঠিরা পরিবারের হাতে মোটা টাকা গুঁজে দেন। পরে তাঁদের যৌনপল্লিতে কাজ করতে বাধ্য করা হয়।

দক্ষিণবঙ্গে আবার সক্রিয় ‘সিন্ডিকেট’। বিশেষ করে সীমান্ত শহরগুলিতে। এখানে নারী পাচারকে ‘ধুর পাচার’ বলেও উল্লেখ করেন অনেকে। সূত্রের দাবি, বাংলাদেশ থেকে মেয়েদের এনে, সীমান্ত পার করিয়ে পৌঁছে দেওয়া হত মুম্বই, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদের মতো শহরে। সীমান্তবর্তী এলাকার হোটেলগুলিকে এই কাজে ব্যবহার করত পাচারকারীরা। বাইরে গিয়ে কেউ পেতেন পরিচারিকার কাজ। কারও আবার ঠাঁই হত যৌনপল্লিতে। তদন্তকারীদের কাছ থেকে জানা যায়, প্রাথমিক ভাবে মাথাপিছু ‘দাম’ ধরা হত দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। তার পরে সেই ‘দাম’ চড়ত।

দু’দেশের দালালদের নিয়েই তৈরি হত এই সব সিন্ডিকেট। সূত্রের দাবি, নানা কড়াকড়ি এবং ধরপাকড়ের কারণে এখন সীমান্ত দিয়ে নারী পাচার কমেছে। তবে সম্প্রতি নদিয়া ও উত্তর ২৪ পরগনায় মানব পাচার চক্রের হদিস পাওয়ার পরে গোয়েন্দারা মনে করছেন, এই চক্র পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়নি। বরং সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে পাচারকারীরা।

পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির দাবি, প্রেমের ফাঁদে ফেলে এবং বিয়ের নামে সব থেকে বেশি পাচার হয়। পুলিশের সূত্র জানাচ্ছে, সুন্দরবনের গোসাবা, ক্যানিং এলাকা থেকে প্রতি বছর নাবালিকাদের বিয়ের নামে প্রেমের জালে ‘ফাঁসিয়ে’ নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লি, মুম্বই-সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। অনেককে বেচে দেওয়া হয় যৌনপল্লিতে। মোবাইল ফোন এবং সমাজমাধ্যম এই ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করে। পুলিশ-প্রশাসনের কেউ কেউ বলেন, ‘‘করোনার সময়ে দেখা গিয়েছে, আয় কম বলে মোবাইল কিনতে পারছে না অনেকে। ফলে অনলাইন ক্লাস করতে পারেনি। অথচ, এ ক্ষেত্রে মোবাইলের অভাব হয় না!’’

শুধু দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবনের একাধিক এলাকাই নয়, উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগর, বসিরহাট ১, হিঙ্গলগঞ্জ ও হাসনাবাদ ব্লকেও নারী পাচারের অনেক ঘটনা বিভিন্ন সময়ে সামনে এসেছে। মানব পাচার নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠন সূত্রে দাবি করা হয়েছে, এই ব্লকগুলি থেকে গড়ে প্রতি মাসে তিনটি পাচারের ঘটনা সামনে এসেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পাচার হয়ে যাওয়া মহিলাদের উদ্ধার করা যায়নি। পাচারকারীকে গ্রেফতার করা বা শাস্তি দেওয়ার ঘটনা ১ শতাংশ ক্ষেত্রেও হয়নি।

মুর্শিদাবাদের ক্ষেত্রে আরও একটি রোমহর্ষক পাচারের উদাহরণ মিলেছে। কী সেই কাহিনি?

পাচারকারীদের ফাঁকি দিয়ে ফিরে আসা এক মহিলা বলছিলেন, তাঁকে তাঁর বাবা ‘বিয়ে’ দিয়ে দেন কাশ্মীরের এক ছেলের সঙ্গে। ওই মহিলার কথায়, ‘‘ওটা নামেই বিয়ে। আসলে মোটা কন্যাপণের বিনিময়ে আমাকে তুলে দেওয়া হয়েছিল পাচারকারীর হাতে।’’ তাঁর ঠাঁই হয়েছিল এক যৌনপল্লিতে। নিজের সেই অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে মহিলা বলেন, ‘‘সেখানে যে ভয়াবহ অত্যাচারের মুখে পড়তে হয়েছিল আমাকে, তা মুখে প্রকাশ করতে পারব না।’’

তিনি একা নন, অনেক মেয়েকেই এই ভাবে পাচার করা হয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেল, এক সময়ে কাশ্মীর থেকে বেশ কিছু দালাল ডোমকলের মতো এলাকায় এসে ঘাঁটি গাড়ত। তারা জনে জনে বলে বেড়াত, কাশ্মীরে মেয়ের সংখ্যা কম, তাই মোটা অঙ্কের পণ দিতে রাজি ছেলে পক্ষ। সেই টাকা পেয়ে অনেক বাবা-ই মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলতেন। শেষে মেয়েদের ঠাঁই হত কোনও যৌনপল্লিতে।

জলপাইগুড়ি জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “যে ক্ষেত্রে অভিযোগ হয়, সে ক্ষেত্রে তদন্তও হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযোগ হয় না। অথবা যখন অভিযোগ হয়, তত দিনে বছর পেরিয়ে গিয়েছে। তখন তদন্তে সমস্যা হয়।” একই বক্তব্য অন্য জেলার পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদেরও। তবু তাঁদের দাবি, মানব পাচার অনেকটাই কমানো গিয়েছে। কিন্তু কী ভাবে?

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Crime Women Trafficking
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE