প্রসাধনীতে ছাড় মিলছে বহুজাতিক ই-কমার্স সাইটে। প্রেগন্যান্সি কিট প্রস্তুতকারক সংস্থার বিজ্ঞাপন বলছে, ‘সুপারহিরো’ মায়েরা ঘরে-বাইরে সমান পারদর্শী। দিল্লি মেট্রোয় মহিলা যাত্রীদের জন্য আয়োজন করা হচ্ছে সুদোকু ও কুইজ় প্রতিযোগিতার। আবার, হিরের গয়না প্রস্তুতকারক সংস্থা দিচ্ছে বিশেষ ছাড়। কেনাকাটায় ছাড়, বিজ্ঞাপন বা এমন অনুষ্ঠান প্রতি বছরই দেখা যায় মার্চের ৮ তারিখ উপলক্ষে, অর্থাৎ আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবসের সময়ে। কিন্তু সমাজমাধ্যমে গালভরা হ্যাশট্যাগ, কর্পোরেট ক্ষেত্রের কতিপয় কৃতী মেয়েদের সাফল্যের জয়গানের আড়ালে প্রতি বারই চাপা পড়ে যায় অগণিত সাধারণ কর্মরতাদের দাবিগুলি— সম কাজে সম বেতন, পূর্ণ কর্মীর মর্যাদা, সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটি, কাজের যথাযথ সময় নির্ধারণ, কর্মক্ষেত্রে শৌচাগার-রাতের ডিউটিতে বিশ্রামের জায়গা-শিশুদের জন্য ক্রেশ, সুরক্ষিত গণপরিবহণ, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি রোখা, মেয়েদের বিরুদ্ধে অপরাধের যথাযথ তদন্ত, ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার তৈরি ইত্যাদি। যে সব কারণে বিশ্ব জুড়ে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মেয়ে চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন, নারী দিবসের আলোচনায় সেগুলি কবে উঠে আসবে? কবে সে সবের সমাধানে ইতিবাচক পদক্ষেপ, নীতি নির্ধারণের পথে হাঁটবে সরকার বা অসরকারি সংস্থাগুলি? ক্রমশ জোরালো হচ্ছে সেই প্রশ্ন।
বহু আন্দোলনের পরেও একই কাজে পুরুষদের সমান বেতন পান না মেয়েরা। মনস্টার স্যালারি ইনডেক্সের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে মেয়েরা পুরুষদের থেকে ২৮ শতাংশ বেতন কম পান। এমনকি, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্র, যা অনেকটাই প্রগতিশীল বলে ধরা হয়, সেখানেও এই ফারাক প্রায় ২৬ শতাংশ। আর অংসগঠিত ক্ষেত্রে এই বৈষম্য আরও বেশি। সেখানে পুরুষ কর্মীদের চেয়ে মেয়েরা কার্যত অর্ধেক মজুরি পান বলে অভিযোগ। আবার, জরুরি এবং সামাজিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও ‘স্বেচ্ছাকর্মী’ হিসেবে নামমাত্র সাম্মানিক পান অঙ্গনওয়াড়ি, মিড-ডে মিল কর্মী, আশাকর্মীরা।
এর পাশাপাশিই রয়েছে সন্তানের জন্মের পরে কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হওয়ার দিকটি। সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটি পান না সবাই। বহু ছোট সংস্থা সন্তানসম্ভবা কর্মীকে বরখাস্ত করে, যাতে কোনও সুযোগ-সুবিধা দিতে না হয়। কাজের জায়গায় শিশুর জন্য ক্রেশ না থাকার কারণে কাজ ছেড়ে দেন প্রায় ৫০ শতাংশ মহিলা, বলছে অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রিপোর্ট। বিশ্বের মধ্যে ভারতে কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের যোগদানের হার অন্যতম কম
(২০২৩ সালে ২৪ শতাংশ)। তার অন্যতম কারণই হল শিশুর দেখাশোনার দায়িত্ব কার্যত একা সামলে চাকরি করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রসঙ্গে দিল্লির একটি স্টেশনে শিশু-সহ কর্তব্যরত আরপিএফ কনস্টেবলের ছবি ভাইরাল হওয়ার কথা তুলছেন তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী দেবজিতা দত্ত। মূলত মাতৃত্বের জয়গান গেয়ে সমাজমাধ্যমে পোস্ট দেন অনেকে। দেবজিতা বলছেন, ‘‘এক জন কর্মরত মা হয়ে আমার মনে হয়েছিল, কতটা পরিকাঠামোর
অভাব থাকলে, কতটা বাধ্য হলে তবে কেউ এ ভাবে শিশুকে নিয়ে ডিউটি করতে আসেন? তিনি কি ওই ভাবে ঠিক মতো দায়িত্ব পালন করতে পারবেন? আইনশৃঙ্খলার অবনতির পরিস্থিতিতে শিশুটির সুরক্ষা কে নিশ্চিত করবে? যদি শিশুটির কিছু হয়, তখন কিন্তু দায়ী করা হবে মাকেই।’’ এই সমস্যার দিকটি কম আলোচিত হওয়া আসলে জনমানসে সচেতনতার অভাবেরই প্রতিফলন বলে মত তাঁর।
এ রাজ্যের শ্রমজীবী মেয়েরা ও প্রান্তিক-লিঙ্গ যৌনতার মানুষদের কাজের ক্ষেত্রে সমস্যার দিকগুলি নিয়ে কাজ করছে নারী দিবস উদ্যাপন মঞ্চ। তাদের তরফে সমাজকর্মী রত্নাবলী রায় বলেন, ‘‘মেয়েদের শ্রমের একটা অদৃশ্যায়ন ঘটছে। প্রাণান্তকর পরিশ্রম করেও সংসার চালানোর উপযুক্ত টাকা রোজগার করতে পারছেন না। শ্রমজীবী মেয়েদের সঙ্কটগুলি দূর করার উদ্দেশ্যে অনেকেই আন্দোলন চালাচ্ছেন। তবে সেগুলি প্রায়ই বিচ্ছিন্ন বা সমান্তরাল ভাবে চলছে। শ্রমজীবী প্রান্তিক লিঙ্গ যৌনতার মানুষ ও শ্রমজীবী মেয়েদের পরস্পর আলোচনার মঞ্চ তৈরি করা দরকার।’’ নারী দিবসে বিভিন্ন সভায় সাধারণ শ্রমজীবী মেয়েদের কথা তুলে আনবে মঞ্চ। এর পাশাপাশি আর জি কর-কাণ্ড নিয়ে এখনও যে ধোঁয়াশা, সংশয় রয়েছে, তা কাটিয়ে উপযুক্ত বিচারের দাবিও তুলছে তারা।
ইতিহাস বলছে, ১৯০৮ সালে নিউ ইয়র্কে ১৫০০০ শ্রমজীবী মহিলা পথে নেমেছিলেন ভোট দেওয়ার অধিকার ও সম কাজে সম বেতন চেয়ে, কাজের দীর্ঘ সময় কমানোর দাবিতে। সে দিনের প্রতিবাদীদের মতোই আজকের মেয়েরা নারী দিবসে অন্তঃসারশূন্য বার্তার বদলে
চান সদর্থক পদক্ষেপ, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের দায়বদ্ধতা। তাঁরা চান, নারী দিবসে এই বিষয়ে আলোচনা শুরু হোক এবং তা চলুক বাকি ৩৬৪ দিনও।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)