Advertisement
E-Paper

অবাধে ঢুকছে বাংলাদেশি তাঁত, সঙ্কটের মুখে শান্তিপুর

অনুপ্রবেশের আঁচড় পড়েছে মিহি তাঁতের শাড়িতে। শান্তিপুর স্বভাবসুলভ নীচু স্বরের জায়গা। সূত্রাগড় থেকে নবপল্লি, সরু তস্য সরু রাস্তা-গলির ভাঁজে ভাঁজে সেই নরম অনুযোগই কিন্তু মাঝে মধ্যে কড়া-পাড়ের মতো রুখু হয়ে উঠছে।

রাহুল রায়

শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৪ ০৩:৩০
লড়াইয়ের মুখে। —নিজস্ব চিত্র।

লড়াইয়ের মুখে। —নিজস্ব চিত্র।

অনুপ্রবেশের আঁচড় পড়েছে মিহি তাঁতের শাড়িতে।

শান্তিপুর স্বভাবসুলভ নীচু স্বরের জায়গা। সূত্রাগড় থেকে নবপল্লি, সরু তস্য সরু রাস্তা-গলির ভাঁজে ভাঁজে সেই নরম অনুযোগই কিন্তু মাঝে মধ্যে কড়া-পাড়ের মতো রুখু হয়ে উঠছে।

স্থানীয় তাঁতি উপেন বিশ্বাস নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না, “আমাদের শেষ করে দিল জানেন তো, গত এক বছরে সস্তায় বাংলাদেশি শাড়ির বাজার আমাদের প্রাণে মেরে দিল!”

পাওয়ার লুম-এর ‘খবরদারি’ ছিলই। অভিযোগ, এ বার, সেই তালিকায় সংযোজন ঘটেছে বাংলাদেশি শাড়ির দাপট। যার ফলে শান্তিপুরি তাঁত-এর বাজার প্রায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। উঠে দাঁড়াতে তাঁতিরা হাত পেতেছিলেন ব্যাঙ্কের দুয়ারে। কিন্তু বেসরকারি এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছে, অসংগঠিত তাঁতিদের ঋণে দিতে তারা তেমন আগ্রহী নয়। ফলে ওই জোড়া ফলার আক্রমণে শান্তিপুরের তাঁত ব্যবসায়ীদের দিশেহারা দশা।

বাংলাদেশি শাড়ির অনুপ্রবেশের দুয়ার কোথায়? তাঁত ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বছর খানেক ধরে নদিয়ার গেদে সীমান্ত দিয়ে হু হু করে ঢুকছে বাংলাদেশের তাঁত। তাঁত ব্যবসায়ী তপন বিশ্বাস বলেন, “একটু খেয়াল করে দেখলেই বুঝবেন শান্তিপুরি তাঁতের সঙ্গে তার ফারাক কোথায়। সেই নক্সা, বুটি, মিহি পাড় কিছুই পাবেন না। পাবেন পাওয়ার লুমে বোনা মোটা তাঁত। তবে দামে সস্তা। আর তাতেই বাজার হারাচ্ছে আমাদের অপেক্ষাকৃত দামী শান্তিপুরের তাঁত।” শান্তিপুরের স্টেশন রোড বরাবর ফুটপাথে ঢেলে বিকোচ্ছে সেই শাড়ি। স্থানীয় আটপৌরে মানুষ জন ২০০-৩০০ টাকায় কিনছেন তা। কলকাতা থেকে আসা পাইকাররাও সে শাড়ি কিনে নিয়ে গিয়ে দেদার লাভ করছে।

স্থানীয় একটি তাঁত সংগঠনের নেতা রবিন বসাক বলেন, “চোখের সামনে দেখছি আমাদের তাঁতের বাজারটা হারিয়ে যাচ্ছে। দেখেও কিছু করার থাকছে না। মানুষকে তো সস্তার শাড়ি কিনতে বাধা দিতে পারি না।” তিনি জানান, শান্তিপুরে হস্ত চালিত তাঁতে বোনা একটি শাড়ির ন্যূনতম দাম সাড়ে ৩০০ টাকা। তাঁর আক্ষেপ, “সাধারণ মানুষতো অত গভীরে ভাবছেন না। তাঁরা দেখছেন শান্তিপুর থেকে কেনা তাঁত, তা যদি দুশো টাকায় মেলে ক্ষতি কী। তা বাংলাদেশ থেকে আসছে কিনা তা নিয়ে কি মানুষের অত মাথা ব্যাথা রয়েছে?”

স্থানীয় এক শাড়ি ব্যবসায়ীর পাল্টা যুক্তি, “বাংলাদেশ থেকে সস্তার ওই শাড়ি আসছে বছর কয়েক ধরেই। দামে সস্তা হওয়ায় তার একটা বাজারও তৈরি হয়ে গিয়েছে। এ বার তার আমদানি দেদার। লাভও বেশি। আমরাই বা সে শাড়ি বিক্রি করব না কেন!”

কিন্তু স্থানীয় তাঁতিরা সে বাজারে দাঁত ফোটাতে পারছেন না কেন?

ব্যাখ্যাটা দিচ্ছেন স্থানীয় একটি তাঁত-সোসাইটির সভাপতি তপন বিশ্বাস, “শান্তিপুরে প্রায় আশি হাজার অসংগঠিত তাঁত শিল্পির অধিকাংশেরই নিজের তাঁত নেই। মহাজনের কাছে বাঁধা তাঁরা। সামান্য ৬০ থেকে ১০০ টাকা মজুরিতে তাঁত বোনেন। তিন দিনে একটা শাড়ি হয়। দাম পড়ে অন্তত সাড়ে তিনশো টাকা। বাংলাদেশের পাওয়ার লুমে বোনা সস্তার শাড়ির সঙ্গে তাঁরা পাল্লা দেবেন কী করে!”

কিন্তু প্রশ্নটা, সীমান্ত উজিয়ে আসা সস্তার সেই শাড়ি কি শান্তিপুরের আদি অকৃত্রিম তাঁতের নক্সা, বুটির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে, পাওয়ার লুমে সে সুযোগ কোথায়? সাধারণের কাছে অবশ্য দামটাই আসল। স্থানীয় তাঁতিরা আক্ষেপ করছেন, “রুচির কদর আর ক’জন করে!”

পাওয়ার লুমের দাপট শান্তিপুরে অবশ্য নতুন নয়। এক লক্ষ বিশ হাজার টাকা খরচ করে একটা পাওয়ার লুম বসাতে পারলেই কার্যত কেল্লা ফতে। দিনে পাঁচ থেকে ছ’টা শাড়ির উৎপাদন। কিন্তু সে শাড়িতে বাঁধা নক্সা। নেই সাবেক বুটি। ফলে নিশ্চুপে হারিয়ে যাচ্ছে সাবেক হাতে বোনা তাঁত। হস্ত চালিত তাঁজ়ত শিল্পীদের অধিকাংশই অসংগঠিত। ফলে ব্যাঙ্ক থকে ঋণের সুযোগও প্রায় নেই।

এই সমস্যায়র সুরাহায় সম্প্রতি এগিয়েছে এসেছে এবিপি সংস্থা। স্থানীয় তাঁতি এবং বেসরকারি ব্যাঙ্কের কর্তাদের মধ্যে পারস্পারিক আলোচনার একটা সুযোগ করে দিয়েছিল তারা। দিনভর কর্মশালায় সেখানেও ব্যাঙ্ক কর্তারা তাঁতিতেদর পরামর্শ দিয়েছেন, ‘সংঘবদ্ধ হোন’। অর্থাৎ অসংগঠিত উপায়ে ব্যবসা না করে তাঁরা যেন কোনও ‘সোসাইটি’ বা সমবায়ে নাম নথিভূক্ত করেন। তাহলে অন্তত ‘বহিরাগত’দের দাপট সত্ত্বেও লাভের ভাগ কিঞ্চিৎ বেশি হবে। এমনকী ব্যাঙ্কের ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনাও সুগম হবে।

শান্তিপুরে এমন সোসাইটির সংখ্যা অবশ্য সাকুল্যে ১৬টি। সদস্য সংখ্যা মেরে কেটে হাজার পাঁচেক। কিন্তু শান্তিপুরে তাঁত বুনে রুজির উপায় খোঁজেন এমন মানুষ প্রায় ৮০ হাজার। তাঁদের দৈনিক আয় ৬০ থেকে ১০০ টাকাতেই থমকে।

পাওয়ার লুম আর বাংলাদেশের দাপটে তাঁরা যাবেন কোথায়?

rahul roy shantipur tant
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy