তেষ্টা মেটানোর তোড়জোড়। রবিবার দ্য ইনস্টিটিউট অব কোম্পানি সেক্রেটারিজ অব ইন্ডিয়া-র অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী। নিজস্ব চিত্র
ঋণ মকুব? অসম্ভব!
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির কাছে ঋণ মকুবের দাবি জানালেও নরেন্দ্র মোদী সরকারের অবস্থান হল, আলাদা করে পশ্চিমবঙ্গের জন্য তা করা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে অন্য রাজ্যগুলিও কেন্দ্রের কাছে একই রকম সুবিধা দেওয়ার দাবি জানাবে।
এত দিন এই কথাই বলে এসেছেন প্রণব মুখোপাধ্যায় ও পি চিদম্বরম। এ বার সেই অবস্থানই নিচ্ছেন অরুণ জেটলি। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর ওয়াই ভি রেড্ডির নেতৃত্বাধীন চতুর্দশ অর্থ কমিশনকে পশ্চিমবঙ্গ, কেরল ও পঞ্জাব এই তিন ঋণগ্রস্ত রাজ্যের সমস্যা খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। চলতি বছরের ৩১ অক্টোবরের মধ্যে কমিশনের রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-অমিত মিত্রকে সেই কমিশনের সুপারিশ পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে, এ কথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন জেটলি। ওই কমিশনের সুপারিশ কার্যকর হবে আগামী বছরের ১ এপ্রিল থেকে।
বরং মমতা-অমিতকে জেটলির পরামর্শ, রাজ্যের নিজস্ব কর বাবদ আয় বাড়ানোর চেষ্টা করুন। অপ্রয়োজনীয় খরচে রাশ টানুন। শুধু জনমোহিনী নীতি দিয়ে কোনও লাভ হয় না। এ দিন কলকাতায় বিজেপির দলীয় সভাতেও এই বিষয়টি তোলেন জেটলি। এবং আক্রমণ করেন তৃণমূল তথা মমতাকে। তিনি বলেন, বাম সরকার রাজ্যের ঘাড়ে ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তৃণমূল সরকারও বিকল্প দিশা দেখাতে পারেনি। রাজ্য সরকার কী ভাবে চলছে, তা কল্পনা করা যায় না। অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য, “শুধু ধার করে একটা রাজ্য চলতে পারে না। তা হলে তো যা আয় হবে, তা ধার শোধ করতেই খরচ হয়ে যাবে।” তাঁর বক্তব্য, “তুমি ধার করে তার পর ভোটে হেরে চলে যাবে। পরে যে সরকার আসবে, তার ঘাড়ে ধার চাপবে। সে ফের ধার করবে, তার পরে যে সরকার আসবে তার ঘাড়ে তা চাপবে। এ ভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপর ধারের বোঝা চাপানো যায় না।” রাজস্ব না বাড়ালে নতুন হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, রাস্তাঘাট, উৎপাদন-শিল্প কী করে গড়ে তোলা যাবে, কর্মসংস্থান এবং উন্নয়নই বা কী করে হবে, সে প্রশ্নও তোলেন অর্থমন্ত্রী।
ঋণের বোঝা কমাতে এখনই সাহায্য করতে না পারলেও জেটলির অবস্থান হল, অনগ্রসর এলাকার উন্নয়ন, উত্তরবঙ্গের উন্নয়ন, সেচ প্রকল্প বা একশো দিনের কাজের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গকে বঞ্চিত করা হবে না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও এর আগে আনন্দবাজারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, উন্নয়নের প্রশ্নে রাজনীতি নয়। গত কাল জেটলির হাতে দাবিদাওয়ার একটি তালিকা তুলে দেন মমতা। যেখানে কোন উন্নয়ন প্রকল্পে রাজ্যের কত টাকা পাওনা রয়েছে, তার বিশদ বিবরণ রয়েছে। জেটলি অমিত মিত্রকে সেই তালিকা নিয়ে দিল্লি এসে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করতে বলেছেন। যে সব মন্ত্রকের থেকে রাজ্যের অর্থ পাওনা রয়েছে, সেই মন্ত্রকের আমলাদেরও ওই বৈঠকে ডাকা হবে। যাতে পশ্চিমবঙ্গের সমস্যার দ্রুত সমাধান করা যায়।
পশ্চিমবঙ্গের ঋণের সমস্যা নিয়ে এই অবস্থানই ছিল প্রণব ও চিদম্বরমের। তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মমতা কেন্দ্রের কাছে তিন বছরের জন্য ঋণ মকুব করার দাবি জানাতে থাকেন। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণববাবু নিজের মন্ত্রকে তিনটি ঋণগ্রস্ত রাজ্যের সমস্যা খতিয়ে দেখতে সচিব পর্যায়ের একটি কমিটিও তৈরি করে দেন। কিন্তু তৎকালীন ব্যয়সচিব সুমিত বসুর নেতৃত্বাধীন সেই কমিটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয়, কেন্দ্র ও রাজ্যের সম্পর্ক মেনে ঋণ বা সুদ মকুব করার পথ খুঁজে পায়নি। দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গের মোট ঋণের মধ্যে খুব সামান্যই কেন্দ্রীয় ঋণ। বাকিটা বাজার থেকে নেওয়া। যেখানে কেন্দ্রের কিছু করণীয় নেই। অনগ্রসর এলাকা উন্নয়ন তহবিলে অর্থ সাহায্য করে এবং বাজার থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয়ে কিছু সুবিধা করে দিয়ে রাজ্যকে সুরাহা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল।
পরে চিদম্বরমও একই অবস্থান নেন। তাঁর আমলেই অর্থ কমিশন তৈরি হয়। কমিশনকে আলাদা ভাবে তিনটি রাজ্যের সমস্যা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তিনি। আশ্বাস দিয়েছিলেন, কমিশনের সুপারিশ মেনেই সিদ্ধান্ত হবে। কেন্দ্রীয় সরকার সেই অনুযায়ীই এই তিনটি রাজ্যকে সাহায্য করবে।
এখন সেই অবস্থানই নিচ্ছেন জেটলি। সংসদে বাজেট নিয়ে বিতর্কে তৃণমূলের নেতারা এই প্রশ্ন তুলেছিলেন। সেখানেও জেটলি চতুর্দশ অর্থ কমিশনের যুক্তি দিয়েছিলেন। অর্থ মন্ত্রকের এক শীর্ষকর্তার ব্যাখ্যা, “এমন নয় যে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপি-র রাজনৈতিক বোঝাপড়া নেই বলে ঋণ মকুব করা হচ্ছে না। পঞ্জাব বা কেরলের ক্ষেত্রেও তা করা হচ্ছে না। পঞ্জাবে কিন্তু এনডিএ-র শরিক শিরোমণি অকালি দলের সরকার চলছে। জেটলি পঞ্জাব থেকেই লোকসভায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে পঞ্জাবকেও কিছু পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে না।”
নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর মমতা নিজে এখনও দিল্লি এসে মোদী বা জেটলির সঙ্গে বৈঠকে বসেননি। পঞ্জাব বা কেরল কিন্তু এ বিষয়ে অনেক এগিয়ে। জেটলি যে দিন অর্থ মন্ত্রকের দায়িত্ব নিয়েছেন, সে দিনই পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ সিংহ বাদল দিল্লি এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। কেরলের কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী উমেন চান্ডিও জেটলির সঙ্গে বৈঠক করেন।
অথচ অন্য দুই রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের মাথায় ঋণের বোঝা অনেক বেশি। ২০১৩-’১৪-এ পশ্চিমবঙ্গের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লক্ষ ৫৪ হাজার কোটি টাকা। সুদ মেটাতে রাজ্যকে ১৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। তুলনায় পঞ্জাবের ঋণের পরিমাণ ১ লক্ষ ২ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। কেরলের ২ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। অমিতের বাজেট অনুমান অনুযায়ী, আগামী বছরে পশ্চিমবঙ্গের ঋণের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ২ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি টাকায়। সুদ মেটাতে রাজ্যকে ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে।
রাজ্যের অর্থ দফতরের কর্তারা বলছেন, ঋণ মকুব করা না হলে মমতার সরকারের সমস্যা বাড়বে। কারণ রাজ্য সরকার পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে খরচে রাশ টানছে না। চিত্রতারকা, শিল্পীদের নিয়ে অনুষ্ঠান, নানা রকমের পুরস্কার দিতে গিয়ে বিপুল খরচ হচ্ছে। তার ফলে পরিকল্পনা খাতে খরচ কমেছে। কোনও উন্নয়ন প্রকল্পে রাজ্য কতখানি খরচ করছে, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কেন্দ্রও টাকা বরাদ্দ করে। রাজ্য ন অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, অর্থ কমিশনও পশ্চিমবঙ্গের ঋণের সমস্যাটিকে গুরুত্ব দিয়েই বিবেচনা করেছিল। তাদের সুপারিশ মেনে স্বল্প সঞ্চয়ের ঋণের উপর সুদের হার কমানো হয়। পশ্চিমবঙ্গের জন্য কেন্দ্রীয় ঋণ মেটানোর সময়সীমা ২০ বছর করে দেওয়া হয়। সেই ব্যবস্থা ২০১১-’১২ অর্থবর্ষ থেকে কার্যকর হয়েছে। যার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার সুরাহা হয়েছে। বাম সরকার এর জন্য আবেদন-নিবেদন করলেও মমতার নতুন সরকারই সেই সুবিধা পেয়েছে। চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশেও মমতার জন্য সুখবর থাকবে বলেই আশা করা যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy