Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

এ বার ‘আক্রান্ত’ খোদ প্রিসাইডিং অফিসারই

রাজ্যে তৃতীয় দফার নির্বাচনে ভোটারদের বুথে যেতে না দেওয়ার পাশাপাশি ছাপ্পা ভোটের অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। বুধবার চতুর্থ দফার ভোটে প্রিসাইডিং অফিসার-সহ বুথের সব ভোটকর্মীকে মারধর করে বের করে দিয়ে ‘অবাধ’ ভোট দেওয়ার অভিযোগ উঠল বাঁকুড়ার সোনামুখীতে। কাঠগড়ায় সেই শাসক দলই। রাজ্যের বাকি ছ’টি কেন্দ্রে কোথাও তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপি, কোথাও বিজেপির বিরুদ্ধে সিপিএম, কোথাও বা সিপিএম-তৃণমূল একে অন্যের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ এনেছে।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৪ ০৩:৫৫
Share: Save:

রাজ্যে তৃতীয় দফার নির্বাচনে ভোটারদের বুথে যেতে না দেওয়ার পাশাপাশি ছাপ্পা ভোটের অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। বুধবার চতুর্থ দফার ভোটে প্রিসাইডিং অফিসার-সহ বুথের সব ভোটকর্মীকে মারধর করে বের করে দিয়ে ‘অবাধ’ ভোট দেওয়ার অভিযোগ উঠল বাঁকুড়ার সোনামুখীতে। কাঠগড়ায় সেই শাসক দলই।

রাজ্যের বাকি ছ’টি কেন্দ্রে কোথাও তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপি, কোথাও বিজেপির বিরুদ্ধে সিপিএম, কোথাও বা সিপিএম-তৃণমূল একে অন্যের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ এনেছে। সিপিএম ৩০১টি বুথে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। তবে এ দিন কিছু বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ছাড়া বড়সড় হানাহানি হয়নি। বিরোধীরা মানছেন, লাগাতার চাপের মুখে নির্বাচন কমিশন কিছুটা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। উপ-নির্বাচন কমিশনার বিনোদ জুৎসি দিল্লিতে বলেছেন, “পশ্চিমবঙ্গে সার্বিক ভাবে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে।”

ভোট শেষ হওয়ার পরে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র স্বীকার করেন, “পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কমিশন কিছু ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিয়েছে। তাও ২৮৮টি বুথে অবাধ ভোট হয়নি।” প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “তৃতীয় দফার চেয়ে এ দিন কিছুটা উন্নতি দেখা গিয়েছে।” প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর প্রতিক্রিয়া, “এখনও অবধি যা ভোট হয়েছে তাতে মারামারি হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তা রুখেই আমরা লড়েছি।”

তৃণমূলের বিরুদ্ধে ওঠা রিগিং বা বুথ দখলের অভিযোগ নস্যাৎ করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মহেশতলার এক জনসভায় এ দিন তিনি বলেন, “আমাদের রিগিং করার প্রয়োজন নেই। মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আমাদের পাশে রয়েছেন।”

দিল্লির সুরেই এ দিন ভোট অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলে জানান রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসার (সিইও) সুনীল গুপ্ত। এ দিন গড়ে ৮১.২৮% ভোট পড়েছে। কোথাও বুথ দখল, ভোট বন্ধ থাকার ঘটনা ঘটেনি। জুৎসি বলেন, “আসানসোল, বিষ্ণুপুর-সহ একাধিক কেন্দ্র থেকে পোলিং এজেন্টকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া, বুথ জ্যাম বা বুথ দখলের কিছু অভিযোগ জমা পড়েছে। পোল ট্র্যাকিং দল ও পর্যবেক্ষকেরা গোটা দিন ঘুরে রিপোর্ট জমা দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার সেগুলি খতিয়ে দেখা হবে।”

বাঁকুড়ার সোনামুখীতেও কমিশনের অনুমতি ছাড়াই তৃণমূল বিধায়ক দীপালি সাহা সাহাপুর প্রাথমিক স্কুলের ২৭ নম্বর বুথে দলবল নিয়ে ঢুকে পড়েন বলে অভিযোগ। বিরোধীদের দাবি, ঢুকেই ভোটকর্মীদের তিনি হুমকি দেন, “কী ভাবে ভোট করছেন? সব সিপিএমের দালাল।বেরিয়ে যান।” বুথের ভিতরের ভিডিওগ্রাফি করছিলেন কমিশনের চিত্রগ্রাহক। বিধায়ক তাঁর হাত থেকে ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। প্রিসাইডিং অফিসার সুখেন্দু রজক বলেন, “বিধায়কের সঙ্গীরা আমাকে ও আমার তিন ভোটকর্মীকে চড় মেরে মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়। তার পরে বুথ থেকে বের করে দেয়। সেক্টর অফিসারকেও তারা মারধর করে।”

কী করছিল ওই বুথের পুলিশ? প্রিসাইডিং অফিসারের দাবি, পুলিশের সঙ্গেও বিধায়ক ও তাঁর সঙ্গীরা ধাক্কাধাক্কি করেন। ওই বুথে ভোট বন্ধ করে দেন সোনামুখীর বিডিও বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য। বাঁকুড়ার জেলাশাসক বিনয় ভারতী রাতে বলেন, “ওই বুথে গণ্ডগোলের খবর পেয়েছি। বিধায়ক ছিলেন বলেও শুনেছি। ওখানে পুনর্নির্বাচন হবে।” দীপালির বিরুদ্ধে এফআইআরও করেছেন প্রিসাইডিং অফিসার। দীপালি অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেন, “আমি ওই বুথে যাইনি।”

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...

বুথে গিয়ে রিগিংয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ উঠল আসানসোলের তৃণমূল প্রার্থী দোলা সেনের বিরুদ্ধেও। এ দিন সকালে জামুড়িয়া পুরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কমিউনিটি সেন্টারে যান তিনি। সিপিএমের অভিযোগ, তৃণমূল প্রার্থী ভোটে বাধা দেওয়ার অভিযোগ তুলে চেঁচামেচি শুরু করেন। তা শুনে তৃণমূল কর্মীরা জড়ো হন। অভিযোগ, ওই ছেলেরা ভোটারদের ইভিএমের কোন বোতাম টিপতে হবে বলে দিচ্ছিলেন। দোলা অবশ্য অল্প ক্ষণের মধ্যে বুথ ছেড়ে চলে যান। তাঁর দাবি, “আমি বুথে গিয়ে দেখি দু’জন ভোটারকে সিপিএমের ছেলেরা ভোট দিতে দিচ্ছে না। তাঁরা যাতে ভোট দিতে পারেন, আমি সেই ব্যবস্থাই করেছি।” পুরুলিয়ার বলরামপুরের ঘাটবাড্ডা গ্রামে স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি মণিকা মাহাতোও বুথে বুথে ঘুরে ভোটের তদারক করেছেন বলে অভিযোগ আসে কমিশনে। তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা রুজু করেছে।

এ দিন ভোটপ্রক্রিয়া দেখতে গিয়ে তৃণমূলের বিক্ষোভের মুখে পড়েন আসানসোল কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়। বেলা ১টা নাগাদ পাণ্ডবেশ্বরে বৈদ্যনাথপুরের নমোপাড়ায় ঢুকতেই এক দল লোক হইহই করে তেড়ে আসে। মুখে স্লোগান, ‘বাবুল সুপ্রিয় দূর হটো। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিন্দাবাদ।’ বাবুল তাঁদের উদ্দেশে বলেন, ‘‘বলো না ভাই ওই কথাটা, আর এক বার বলো। শুনতে চাই।’’ সে কথা শুনে কিছুটা থতমত খেয়ে যায় ছেলেগুলি। ওই দলে ছিলেন তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য জীবন ধীবরও। বাবুলের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আপনি কী করতে এসেছেন? আপনি এলাকার কী চেনেন?” বাবুল বলেন, “চিনতেই তো এসেছি।” দশ মিনিট ধরে তর্কাতর্কির পরে বাবুলের গাড়ি এগিয়ে যায়। তখনও ‘দূর হটো’ স্লোগান চলছে।

তারও আগে সাতসকালে বাবুলকে এক দফা ঘিরে নেয় জনতা। তবে বিক্ষোভ দেখাতে নয়, গান শুনতে। মহিশিলা কলোনিতে বাবুল যেখানে বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন, তার থেকে ৫০০ গজ দূরে একটা স্কুলে ঢুকতেই ভোটার ও মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর উপরে। তখন সকাল ৭টা। বুথ চত্বর মেতে ওঠে কখনও কথার ফুলঝুরিতে, কখনও গানে এ ভাবে ঘণ্টা দেড়েক চলার পরে তৃণমূলের এজেন্টরা আপত্তি তুললে পুলিশ বাবুলকে সরিয়ে নিয়ে যায়। তাঁর বিরুদ্ধে নির্বাচনী বিধিভঙ্গে এফআইআর করে তৃণমূল। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে বাবুল যান এডিএমের কাছে। সেখানেই ছিলেন জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন তিনি গোটা বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন বাবুলকে। এর পরপরই জেলাশাসক জানিয়ে দেন, বাবুলের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সত্যতা নেই। বুথে থাকা কেন্দ্রীয় বাহিনী ও পর্যবেক্ষকের রিপোর্ট তেমনই বলছে।

এ দিন সকালে বাঁকুড়ায় মেজিয়ার শ্যামপুর স্কুলের বুথে পোলিং এজেন্টকে বার করে দেওয়ার অভিযোগ পেয়ে সিপিএম প্রার্থী বাসুদেব আচারিয়া সেখানে গেলে তাঁকেও হেনস্থা করা হয় বলে অভিযোগ। আসে আধাসেনা। বাসুদেববাবুর দাবি, “আমি ন’বারের সাংসদ। এত বার ভোটে লড়েছি। এমন বাজে অবস্থায় কখনও পড়িনি।”

এ দিন অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়েন মেদিনীপুরের সিপিআই প্রার্থী প্রবোধ পণ্ডাও নির্মল হৃদয় আশ্রমের বুথে তিনি পৌঁছলে তাঁর গাড়িতে কেন ‘মেম্বার অব পার্লামেন্ট’ লেখা বোর্ড ঝুলছে, এই অভিযোগে তৃণমূল কর্মীরা প্রার্থীর গাড়ি ঘিরে ধরেন। গাড়ি থেকে ওই বোর্ড খুলে নেওয়া হয়। তবে গোলমাল বেশি ক্ষণ চলতে দেয়নি কেন্দ্রীয় বাহিনী তারা লোকজন সরিয়ে প্রার্থীর গাড়ি বার করে দেন। মেদিনীপুরেরই নারায়ণগড়ে সিপিএম সমর্থকদের হাতে এক তৃণমূল কর্মী প্রহৃত হয়েছেন বলে অভিযোগ। তাঁকে বেলদা গ্রামীণ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE