Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

কৃষি জমি দখল করছে ইটভাটা

শিল্পায়নের নামে কৃষি জমি অধিগ্রহণ করার বিরুদ্ধে একরোখা আন্দোলনই ছিল রাজ্যপাট দখলে তৃণমূলের সেরা বাজি। কিন্তু, ক্ষমতা দখলের পরে কৃষি জমির হাল নিয়ে এমন উদাসীন কেন রাজ্য সরকার? কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রকের সাম্প্রতিক একটি রিপোর্ট সে প্রশ্ন উস্কে দিয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যের আবাদি জমির হাল হকিকত সংক্রান্ত ২০১৩-১৪ সালের ওই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, প্রতি পাঁচ বছরে এ রাজ্যের প্রায় ৪.৮৫ শতাংশ কৃষি জমি হারিয়ে যাচ্ছে।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

রাহুল রায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:৩০
Share: Save:

শিল্পায়নের নামে কৃষি জমি অধিগ্রহণ করার বিরুদ্ধে একরোখা আন্দোলনই ছিল রাজ্যপাট দখলে তৃণমূলের সেরা বাজি।

কিন্তু, ক্ষমতা দখলের পরে কৃষি জমির হাল নিয়ে এমন উদাসীন কেন রাজ্য সরকার?

কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রকের সাম্প্রতিক একটি রিপোর্ট সে প্রশ্ন উস্কে দিয়েছে।

বিভিন্ন রাজ্যের আবাদি জমির হাল হকিকত সংক্রান্ত ২০১৩-১৪ সালের ওই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, প্রতি পাঁচ বছরে এ রাজ্যের প্রায় ৪.৮৫ শতাংশ কৃষি জমি হারিয়ে যাচ্ছে। তবে, সে ব্যাপারে রাজ্য সরকার যে ‘নিষ্ক্রিয়’, কৃষিমন্ত্রকের ওই রিপোর্টে তার-ও উল্লেখ রয়েছে স্পষ্ট।

শিল্প-প্রসারে তবে কি হাত পড়ছে সেই কৃষি জমিতেই?

দিল্লির ওই রিপোর্টে অবশ্য সে কথা বলছে না। উল্টে ক্রমান্বয়ে জমি-হারা রাজ্যে শস্য সঙ্কটের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিয়ে রাখছে। এখন প্রশ্ন, আবাদি জমি হ্রাস পাচ্ছে কেন?

চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তার উত্তর দিচ্ছে, সেন্ট্রাল সয়েল অ্যান্ড ওয়াটার কনজারভেশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (সিএসডব্লুসিআরটিআই) -এর হালের এক সমীক্ষা। ভারী শিল্পের জমি-গ্রাসের উল্লেখ না থাকলেও ওই সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন জেলায় গজিয়ে ওঠা ইটভাটার থাবা পড়েছে চাষের জমিতে। যার ফলে প্রতি বছরই রতুয়া থেকে রায়দিঘি, কয়েক হাজার হেক্টর আবাদি জমি যাচ্ছে ভাটার দখলে। সমীক্ষায় প্রকাশ, ইটভাটার দলদারির সঙ্গেই দক্ষিণবঙ্গের কয়েকটি জেলায় মাছ চাষ এবং শহরাঞ্চলের লাগোয়া এলাকায় আবাসন ব্যবসার কোপও পড়েছে কৃষি জমির উপরে।

ওই সমীক্ষার সমর্থন মিলেছে বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্টেও। ‘গ্রাম-শহরে জমির অবক্ষয়’ সংক্রান্ত বিশ্বব্যাঙ্কের ওই রিপোর্টেও নির্দিষ্ট ভাবেই দেখানো হয়েছে মালদহ, মুশির্দাবাদ, পূর্ব মেদিনীপুর থেকে দুই ২৪ পরগনাসর্বত্রই কৃষি জমির উপরে ইটভাটার দখলদারিতে জমির সব থেকে উপরের স্তরের মাটি বা টপ সয়েল ক্রমেই তার উর্বরতা হারাচ্ছে। ফলে বছর কয়েক পরে ভাটা মালিক তার কারবার গুটিয়ে নিলেও জমি আর ফলনযোগ্য থাকছে না। বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্ট বলছে: এর ফলে হুগলি, রাজ্যের শস্যগোলা বর্ধমানের বেশ কিছু এলাকায় পাঁচ বছর আগেও যে জমিতে বছরে তিন বার ফলন হত তা বন্ধ্যা পড়ে থাকছে।

কৃষি দফতরের কপালে যে বিষয়টি ভাঁজ ফেলেছে কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর কথায় তা স্পষ্ট। তিনি বলেন, “সন্দেহ নেই ব্যাপারটা উদ্বেগজনক।” মন্ত্রী জানান, রাজ্যের আনাচেকানাচে ইটভাটা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে ইতিমধ্যেই পরিবেশ দফতরের সঙ্গে আলোচনা করেছেন কৃষি কর্তারা। সরকারি নথিই বলছে রাজ্যে ইটভাটার সংখ্যা অন্তত ২২০০। রাতারাতি ওই ভাটাগুলি বন্ধ করে দেওয়া অসম্ভব, কবুল করেছেন মন্ত্রী। তা হলে উপায়?

সিএসডব্লুসিআরটিআই-এর তরফে বিশেষজ্ঞ টি শ্রীধরনের নিদান, “উপায় একটাই, সুপ্রিম কোর্টের আইন মেনে কৃষিজমি, ফলের বাগান, বনভূমি দখল করে ইটভাটা গড়া চলবে না।” ২০০২ সালে রাজ্যে কৃষি জমির পরিমাণ ছিল ৫৫,২১৫৭৬ হেক্টর। কৃষিমন্ত্রকের পরিসংখ্যান বলছে, পরবর্তী পাঁচ বছরে তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৫২,৯৬০০৫ হেক্টর। অর্থাৎ পাঁচ বছরে ২,২৫৫৭১ হেক্টর কৃষি জমি ‘হারিয়ে’ গিয়েছে। ২০১২ সালে হ্রাস পেয়েছে আরও আড়াই লক্ষ হেক্টর কৃষি জমি। এই হারে জমি হ্রাস পেলে আগামী আড়াই দশকের মধ্যেই রাজ্যে খাদ্য সঙ্কট অবশ্যম্ভাবী বলে মন্তব্য করেছেন কৃষিমন্ত্রকের কর্তারা।

রাজ্যের কৃষি দফতরের প্রাক্তন কর্তা তথা পরিবেশবিদ স্বদেশরঞ্জন মিশ্রের অভিজ্ঞতা, “ভাটা মালিকদের নগদ টাকার হাতছানিতে তিন থেকে পাঁচ বছরের লিজ-এ জমির মালিক তাঁর চাষ যোগ্য জমি ভাড়া দিচ্ছেন। কিন্তু পাঁচ বছর পরে তিনি যখন জমি ফেরত পাচ্ছেন তখন তা নিছকই একটি বন্ধ্যা পতিত জমি।” তিনি জানান, জমিকে উর্বর রাখার অবশ্যম্ভাবী শর্ত, পটাসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, জিঙ্কসব উপাদানই থাকে জমির উপরিভাগে। ভাটা মালিকরা সেই মাটিই ব্যবহার করেন ইট তৈরিতে। এ ব্যাপারে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন কর্তা পরিবেশবিদ বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, “ফি বছর ২.২১ কোটি কিউবিক মিটার টপ সয়েল ইট ভাটার আগুনে পুড়ছে। ফলে জমির উর্বরা শক্তি অচিরে শূন্য হয়ে পড়ে।”

যা দেখে বিশেষজ্ঞদের কটাক্ষ--শিল্পের জন্য জমি নেই, অথচ ভাটার আগুনে পুড়ছে রাজ্যের কৃষি জমি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

farmland brick kiln rahul roy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE