টাওয়ার গোষ্ঠীর আমানতকারী এবং এজেন্টদের দীর্ঘ লাইন। শুক্রবার আলিপুরে।—নিজস্ব চিত্র।
ঘুটঘুট্টে অন্ধকার থাকতেই উঠতে হয়েছিল সেই ভোর তিনটেয়। বকখালি থেকে নামখানা পৌঁছে খেয়া পেরোতে হবে। এর পরে চার ঘণ্টার বাসযাত্রা শেষে কলকাতা।
শুক্রবার বেলা দশটা নাগাদ সমর প্রামাণিক ও মৃত্যুঞ্জয় সর্দার যখন আলিপুরে এসে পৌঁছলেন, দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পরিষদ অফিসের সামনের লাইনটা তখন প্রেসিডেন্সি জেলের গেট ছাড়িয়ে গিয়েছে। আধ কিলোমিটারেরও বেশি লম্বা লাইন ঠেলে এগোতে এগোতে তাঁদের কাজ মিটল বিকেল সাড়ে তিনটেয়। অর্থলগ্নি সংস্থা টাওয়ার ইনফোটেক লিমিটেডের দুই এজেন্ট তখন সবেমাত্র একটু চা খাওয়ার ফুরসত পেয়েছেন।
সারদা কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই টাওয়ারও কার্যত পথে বসে। এ বার আর্থিক নিয়ামক সংস্থা সেবি-কে ওই অর্থলগ্নি সংস্থার কয়েকটি সম্পত্তি বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু করতে বলেছে হাইকোর্ট। টাওয়ার-এর গ্রাহকদের আমানত ফেরতের জন্য দরখাস্ত জমা দিতে বলে বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেছে সেবি। তাতেই আলিপুর-চত্বরে সাজ-সাজ রব। ঠিক যেন কলকাতার হেভিওয়েট পুজো মণ্ডপে ঠাকুর দেখার লম্বা লাইন। সময়সীমা, ২৫ অক্টোবর। রাজ্যের সব জেলাশাসকের অফিসেই আমানতকারীদের কাগজপত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সেবি।
এর মধ্যে দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রার্থীদের ভিড় দেখলেই তাক লেগে যাবে। মৃত্যুঞ্জয়বাবুরা বলছিলেন, মিন ধরার ভরা মরসুমে সব ছেড়ে কলকাতা আসতে নাজেহাল সুন্দরবন বা বঙ্গোপসাগর প্রান্তের মানুষজন। অন্তত ব্লকে ব্লকে এই জমায়েতের ব্যবস্থা করা গেলে পাড়া-গাঁয়ের গরিব লোকের সুবিধে হতো। আসলে এই পাড়া-গাঁ থেকে আসা মানুষজনের অনেকেরই নামমাত্র অক্ষরজ্ঞান। মৃত্যুঞ্জয়বাবুরা বলছিলেন, নামখানা, সাতমাইলের কম্পিউটার সেন্টারে বাংলায় লেখা ফর্ম ডাউনলোড করিয়ে এক-এক জনের কাগজপত্র জোগাড় করতে বাড়ি-বাড়ি যেতে হয়েছে। দুই এজেন্টের স্মৃতিতে দগদগে, কোম্পানি লাটে ওঠার পরে আমানতকারীদের কাছে মুখঝামটা-ঘাড়ধাক্কা খাওয়ার অভিজ্ঞতা। দু’জনেই গ্রাহকদের টাকা মেটাতে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে হাত দিতে বাধ্য হয়েছেন। মৃত্যুঞ্জয়বাবু বললেন, “এখনও গরিব মানুষগুলোর কাছে নিজের মুখরক্ষার চেষ্টা করছি। বোঝাতে চাই, আমি চোর নই।”
এমন কোনও কোনও এজেন্ট গ্রাহকদের কাগজপত্র নিয়ে হাজির হলেও অনেক থুত্থুড়ে বুড়োবুড়িকে এ দিন সকাল থেকে লাইন দিতে দেখা গিয়েছে। আমতলার গোতলাহাটের এক প্রবীণ যেমন বলছিলেন, ছেলেরা বলছিল নিজে না-গেলে কানাকড়ি জুটবে না, তাই বাধ্য হয়েই বুড়ো হাড়ে আসতে হল।
বাস্তবিক, আলিপুরের ভিড় দেখে বছরখানেক আগে সারদা কমিশনের ডাকে নিউটাউনে ফিনান্সিয়াল হাবের সামনের ভিড়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। তখন প্রায় এক মাস ধরে নিজেদের খেসারতের প্রমাণ দাখিল করতে ওই তল্লাটে হাজির হচ্ছিলেন আমানতকারী বা এজেন্টরা। শুধু সারদাই নয়, রাজ্যে সক্রিয় বিভিন্ন ভুঁইফোড় অর্থলগ্নি সংস্থার গ্রাহক-এজেন্টরাই তখন ঝাঁকে ঝাঁকে নিউটাউনমুখী। সব-খোয়ানো মানুষজনের ভিড়ে প্রায় মেলার পরিবেশ। বাসে-বাসে কন্ডাক্টরদের মুখে জায়গাটার নামই হয়ে গেল ‘চিটফান্ড স্টপ’। আলিপুরে এ দিনের ছবিটা তার থেকে খুব আলাদা ছিল না।
প্রশাসনিক ভবনের একতলা-দোতলায় খান আঠারো কাউন্টারেই গিজগিজে ভিড়। জোরদার পুলিশি প্রহরা। সরকারি কেরানি-বাবুরা যন্ত্রের মতো জমা-পড়া ফর্মে সিরিয়াল নম্বর লিখে এক পাশে ডাঁই করছেন। আর ফোটোকপিতে সিলমোহর দিয়ে হাতে-হাতে ফেরত দিচ্ছেন। একজন কর্মী বললেন, এক-একটা কাউন্টারেই বিকেল সাড়ে তিনটে অবধি ৭০০-৮০০ লোকের চাপ। জেলা প্রশাসনের হিসেব, জড়ো হওয়া আমানতকারী ও এজেন্টের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে।
ওই ভিড়ে মিশে ডায়মন্ড হারবারের পরিচারিকা মমতা প্রামাণিক বা মল্লিকপুরের গৃহবধূ সানজিদা বিবি। সোনারপুরের এক তরুণী ১০ বছরের মেয়েকে নিয়ে দাদার সংসারে থাকেন, কলকাতায় ছোটখাটো কাজ করেন। বলছেন, “প্লিজ আমার আসল নামটা লিখবেন না, এতগুলো টাকা গচ্চা গিয়েছে শুনলে দাদা আস্ত রাখবে না।” পাথরপ্রতিমার ভাইবোন পবিত্র কর ও বিদিশা করের অবস্থা কাঁদো-কাঁদো। বারবার কাউন্টারে জিজ্ঞেস করছেন, দাদা ফর্ম তো নিলেন! কবে টাকা পাব? টেবিলের উল্টো দিক থেকে গম্ভীর জবাব এল, এখন কিচ্ছু বলা যাবে না!
শেষমেশ কবে কপালে শিকে ছিঁড়বে, কেউ জানেন না! তবু খড়কুটো আঁকড়ে ধরার ভঙ্গিতেই শেষ বিকেল অবধি লাইনটা আলিপুরের প্রশাসনিক ভবন-চত্বর দখল করে থাকল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy