Advertisement
E-Paper

খালের পলির চোরাকারবারে মাটি-মাফিয়ারা

টাকায় মাটি, মাটিতে টাকা! সেচ দফতরের খাল সংস্কারে যে মাটি তোলা হচ্ছে, সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী তা বিভিন্ন এলাকায় উন্নয়নের কাজে সরবরাহ করার কথা। কিন্তু সেই নির্দেশকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ওই মাটির দখল নিয়ে মোটা টাকায় বিক্রি করে বিপুল মুনাফা লুটছে এক শ্রেণির লোক।

শুভাশিস ঘটক

শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০১৪ ০৩:৩৮

টাকায় মাটি, মাটিতে টাকা!

সেচ দফতরের খাল সংস্কারে যে মাটি তোলা হচ্ছে, সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী তা বিভিন্ন এলাকায় উন্নয়নের কাজে সরবরাহ করার কথা। কিন্তু সেই নির্দেশকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ওই মাটির দখল নিয়ে মোটা টাকায় বিক্রি করে বিপুল মুনাফা লুটছে এক শ্রেণির লোক। সাধারণ মানুষ তো বটেই, এমনকী পুলিশ ও প্রশাসন যাদের নাম দিয়েছে ‘মাটি-মাফিয়া’।

দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাশীপুর ও ভাঙড় থানা এলাকার মানুষ এখন ওই মাটি-মাফিয়াদের দাপটে তটস্থ।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, সেচখাল থেকে তোলা মাটি একেক লরি আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি করছে মাটি-মাফিয়ারা। সেই জায়গায় লরিভাড়া ও জনমজুরি নিয়ে আটশো টাকা লরি পিছু খরচ হচ্ছে ওই বেআইনি কারবারিদের। অর্থাৎ সহজ হিসেবে প্রতি লরিতে ১৭০০ টাকা মুনাফা। রোজ আড়াইশো থেকে তিনশো লরি মাটি বিক্রি হচ্ছে। ওই কারবারের সঙ্গেই জড়িত এক ব্যক্তি, নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানালেন, গত আড়াই মাসে ভাঙড় ও কাশীপুর থেকে অন্তত ২০ হাজার লরি মাটি বিক্রি করা হয়েছে। কাজেই, অন্তত সাড়ে তিন কোটি টাকা মুনাফা পকেটে পুরেছে মাটি-মাফিয়ারা।

রাজ্যের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বিষয়টি আমার কানেও এসেছে। এই নিয়ে বিস্তারিত খোঁজখবর নিচ্ছি।”

কাশীপুর এলাকার এক নির্মাণ ব্যবসায়ীর বক্তব্য, সাধারণ বাজারদর অনুযায়ী, এক লরি মাটির দাম প্রায় চার হাজার টাকা। কিন্তু মাটি-মাফিয়াদের কাছ থেকে ওই মাটি পাওয়া যাচ্ছে লরি পিছু দেড় হাজার টাকা কমে। কাজেই সস্তায় দেদার বিকোচ্ছে ওই চোরাই মাটি।

এত মাটি আসছে কোথা থেকে?

মে মাসে কলকাতা লাগোয়া বাগজোলা-শোনপুর খাল সংস্কারের কাজ শুরু করেছে সেচ দফতর। কাশীপুর ও ভাঙড় থানা এলাকায় সংস্কার হচ্ছে ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ খালের। সংস্কারের তিনটি পর্যায়। এক, পলি তুলে নাব্যতা বৃদ্ধি। দুই, খালপাড় কংক্রিট দিয়ে বাঁধানো ও সৌন্দর্যায়ন। তিন, খালের উপর সেতুগুলির সংস্কার। প্রথম পর্যায়ের কাজে ড্রেজিং করে মাটি তুলে খালের পাশে স্তূপীকৃত করে রাখা হচ্ছে। আর তার দখল নিচ্ছে মাটি-মাফিয়ারা। পলি তোলার কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদার সংস্থার চোখের সামনে ওই মাটি চুরি হলেও তাঁরা পুলিশ-প্রশাসনের কাছে এখনও কোনও লিখিত অভিযোগ করতে সাহস পাননি। কেন?

ঠিকাদার সংস্থার লোকজন ও স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ওই মাটি-মাফিয়ারা শাসক দলের মদতপুষ্ট। সে জন্যই তাদের দমন করার ব্যাপারে পুলিশ-প্রশাসনের একাংশের কোনও হেলদোল নেই। এবং এ ক্ষেত্রেও অভিযোগের তির ভাঙড়-২ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি আরাবুল ইসলামের দিকে। সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তীর কথায়, “আরাবুল ইসলামের শাগরেদরাই মাটির চোরাই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।” অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে আরাবুলের দাবি , “ভাঙড়ে যা খারাপ কিছু হয়, তাতেই মিথ্যে করে আমার নাম জড়িয়ে দেয় সিপিএম।” তবে এলাকায় খাল সংস্কার করে তোলা সেচ দফতরের মাটি যে চুরি হচ্ছে, সে কথা তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন। আরাবুলের বক্তব্য, “যারা মাটি চুরি করছে, তাদের পুলিশ ধরুক।”

কিন্তু ধরবে কী ভাবে? এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, চিনাপুকুর, শোনপুর, কাঠজ্বালা, মানিকতলা, জামিরগাছি, হাতিশালার মতো তল্লাটে তল্লাটে রাস্তার পাশে টেবিল-চেয়ার নিয়ে বসে আছে মাটি-মাফিয়াদের লোকজন। নাম-ঠিকানা লিখে আড়াই হাজার টাকা জমা দিলেই এক লরি মাটি পৌঁছে যাবে গন্তব্যে। মহল্লায় মহল্লায় ঘুরছে নম্বর বিহীন মোটর সাইকেল। চালকের সঙ্গে আরোহী। কোমরে দেশি পিস্তল। প্রতিটি বাইকে খান চারেক উইকেট। কোথাও মাটির লরি আটকালে ধেয়ে যাচ্ছে ওই সব মোটর বাইক। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে উইকেট দিয়ে বেধড়ক মারধর। এলাকার মানুষের অনেকেরই অভিযোগ, ওই মাটি-মাফিয়াদের পুলিশ এড়িয়ে চলে।

তবে গত ১২ জুলাই শোনপুর এলাকায় মাটির লরির ধাক্কায় এক মোটর সাইকেল আরোহীর মৃত্যুর ঘটনায় পথ অবরোধ করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। অবরোধ হটাতে গিয়ে পুলিশ আক্রান্ত হয়। চোরাই মাটির লরি চলাচলে পুলিশের একাংশের মদত রয়েছে, এই অভিযোগ তুলে পুলিশের উপর ইটবৃ্ষ্টি করা হয়। শুধু তা-ই নয়, পুলিশের দু’টি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ভাঙচুর করা হয় আরও চারটি গাড়ি।

তার পরেই পুলিশ কিছুটা হলেও নড়েচড়ে বসেছে। গ্রেফতার হয়েছে ১৪ জন। আপাতত লরি চলাচলের উপর নজরদারি চলছে। জেলা প্রশাসনের তরফেও বিষয়টি নজরদারি করা হচ্ছে বলে জানান এক কর্তা।

কিন্তু এটা কত দিন চলবে, তা নিয়ে বাসিন্দাদের একাংশ সন্দিহান। কারণ, তাঁদের অভিযোগ, ওই মাটি-মাফিয়াদের একাংশ গত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের হয়ে খেটেছিল। শাসক দলের পক্ষ থেকে অবশ্য ওই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।

soil mafia sediment subhasish ghatak
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy