Advertisement
E-Paper

গ্রামে ফিরতে চেয়ে বহু নেতার দোরেই আজাদ

বন্ধুরা শত্রু হয়েছে কিছু দিন পরপরই। আবার জুটে গিয়েছে নতুন বন্ধু। কখনও বিরোধী-গোষ্ঠীর হামলায়, কখনও পুলিশের তাড়া খেয়ে পাল্টেছেন ডেরা। শেষ দিকে গ্রামে ফেরানোর আর্জি নিয়ে ‘আশ্রয়’ পাল্টাচ্ছিলেন বারবার। কিন্তু আজাদ মুন্সির সেই ইচ্ছে আর পূরণ হল না। রাজ্যে ক্ষমতার হাতবদলের পরে বীরভূমে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব যত প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে, আজাদও তত কোণঠাসা হয়ে পড়েন।

সৌমেন দত্ত

শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:৫৮
মোটরবাইকে আজাদ মুন্সি। —ফাইল চিত্র।

মোটরবাইকে আজাদ মুন্সি। —ফাইল চিত্র।

বন্ধুরা শত্রু হয়েছে কিছু দিন পরপরই। আবার জুটে গিয়েছে নতুন বন্ধু। কখনও বিরোধী-গোষ্ঠীর হামলায়, কখনও পুলিশের তাড়া খেয়ে পাল্টেছেন ডেরা। শেষ দিকে গ্রামে ফেরানোর আর্জি নিয়ে ‘আশ্রয়’ পাল্টাচ্ছিলেন বারবার। কিন্তু আজাদ মুন্সির সেই ইচ্ছে আর পূরণ হল না।

রাজ্যে ক্ষমতার হাতবদলের পরে বীরভূমে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব যত প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে, আজাদও তত কোণঠাসা হয়ে পড়েন। নানুরের তৃণমূল নেতা কাজল শেখের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। তৃণমূলের একটি সূত্রে জানা যায়, কাজলের সঙ্গে বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের মনোমালিন্য সামনে আসা শুরু হতেই আজাদের দল ভাঙতে শুরু করে। যাদের নিয়ে ‘বাহিনী’ গড়েছিলেন, তাদের অনেকেই আজাদকে ছেড়ে যান। তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগও উঠতে শুরু করে।

আজাদের বিরোধীদের অভিযোগ, মঙ্গলকোটের আড়াল গ্রামে কুনুর নদীর পাড়ে মাচা বেঁধে থাকতেন আজাদ। সশস্ত্র ৭-৮ জন পাহারা দিত। নতুনহাটে অজয় নদের পাড়ে ইটভাটা, দেউলিয়া-সহ একাধিক গ্রামে রেশন ডিলারদের কাছ থেকে তোলাবাজি আজাদের দল তোলাবাজি চালাত বলে অভিযোগ। ইটভাটা মালিকদের বর্ধমান জেলার সংগঠন মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে পুলিশ সুপারের কাছে চিঠি লিখেও এ কথা জানিয়েছিল। এই তোলাবাজির বিরুদ্ধে মঙ্গলকোটের স্থানীয় নেতারা একে একে মুখ খোলায় তাঁদের বাড়িতে বোমাবাজি, হামলার অভিযোগ ওঠে আজাদের বিরুদ্ধে। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক তৃণমূল কর্মী ঔরঙ্গজেব শেখ ওরফে কচিকে পিটিয়ে খুনের অভিযোগ ওঠে আজাদের দিকে। নিহতের স্ত্রী মারিয়া বিবি অভিযোগ করেন, তোলাবাজির প্রতিবাদ করায় প্রাণ দিতে হয় তাঁর স্বামীকে।

এর পরে তৃণমূলের একাংশের চাপে পুলিশ নড়েচড়ে বসে। কয়েক বার আজাদের খোঁজে কুনুর নদীর ডেরায় অভিযান চলে। বর্ধমান জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “এক বার আজাদের তিন পাহারাদারকে আমরা ধরে ফেলি। আজাদকেও ঘিরে ধরি। সেই অবস্থায় ও দু’হাতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে নদীর পাড় ধরে পালায়।” স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আজাদ এলাকা ছেড়ে পালানোর পরে তাঁর দলের কয়েক জন বিরোধী গোষ্ঠীতে নাম লেখায়। তার পরে আর গ্রামে আর ফিরতে পারেননি আজাদ।

তৃণমূলের নানা সূত্রে জানা যায়, গ্রাম ছেড়ে কাজল শেখের আশ্রয়ে চলে যান আজাদ। কিন্তু সেখানেও ফের তোলাবাজির অভিযোগ ওঠায় কাজলের সঙ্গে মনোমালিন্য হয় তাঁর। তখন লাখুরিয়া পঞ্চায়েতে অজয় নদের কোলে ঝিলেরা গ্রামের সাইফুল খাঁয়ের সঙ্গে আজাদের ঘনিষ্ঠতা হয়। সেখানে বালির ঘাট চালাতে শুরু করেন আজাদ। ঝিলেরা গ্রামের বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, প্রথম দিকে আজাদ আপদে-বিপদে গরিব মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। মাস কয়েক পর থেকেই বালির ঘাট নিয়ে আজাদের দলে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। আর তার সঙ্গেই পাল্টাতে থাকে আজাদের স্বরূপ।

ঝিলেরা ও আশপাশের কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা অতিষ্ঠ হয়ে তৃণমূল নেতৃত্বের কাছে আজাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান। ২০১২ সালের ১৮ অক্টোবর বিকেলে স্থানীয় আটঘরা ফ্লাড সেন্টারে তৃণমূলের লাখুরিয়া কমিটির বৈঠক হয়। তৃণমূল সূত্রে জানা যায়, ওই বৈঠকের গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রথম অনুচ্ছেদেই আজাদকে দলের সক্রিয় কর্মী উল্লেখ করে লেখা হয়েছিল, ‘আজাদ মুন্সি লাখুরিয়া অজয় নদের বালির ঘাট নিয়ে থাকবেন। গ্রামবাসীদের উপর কোনও খারাপ ব্যবহার করতে পারবেন না।’ তৃণমূল নেতৃত্ব এলাকায় শান্তি বজায় রাখতে ওই বালির ঘাট তাঁকে চালাতে দিলেও সাইফুলের সঙ্গে নানা কারণে গোলমাল বাড়তে থাকে আজাদের। ওই বছরের শেষ দিকে লাখুরিয়ায় আজাদের সামনেই এলাকাবাসী ‘আজাদ-বিরোধী’ শান্তিমিছিল করেন।

এই ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পরেই সাইফুল খাঁ ও আজাদের দলবলের মধ্যে বোমা-গুলির লড়াই হয়। তাতে নানুরের চাষি শেখ শাহজাহান ও লাখুরিয়ার বাসিন্দা অস্টম কৈবর্তের মৃত্যু হয়। পুলিশকে আটকাতে লাখুরিয়া হাইস্কুল থেকে ঝিলেরা গ্রাম পর্যন্ত মোরাম রাস্তার বেশ কয়েক জায়গা কেটে দেয় আজাদ-বাহিনী। পুলিশের তাড়া খেয়ে আজাদ ও তাঁর সঙ্গীরা অজয়ের চরে ঘাঁটি তৈরি করে। তাদের ডেরা হয়ে ওঠে ঝিলেরা থেকে কল্যাণপুর পর্যন্ত অজয়ের উপরে জেগে ওঠা চর। তৃণমূলের এক নেতা বলেন, “আজাদ কাজলের ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন। আর মঙ্গলকোট থাকে অনুব্রতর কব্জায়। ফলে, অনুব্রতর অনুগামীদের বাধায় মঙ্গলকোটে ঢুকতে বারবার বাধা পাচ্ছিলেন আজাদ।” বীরভূমের কিছু তৃণমূল কর্মীর কাছ থেকে জানা গিয়েছে, গ্রামে ফেরার জন্য আজাদ ছটফট করতেন। এক বার পাপুড়ি তো এক বার বাসাপাড়ায় নেতাদের কাছে ছুটে গিয়েছেন। বাসাপাড়ায় এক নেতার আশ্রয়ে থাকার সময়ে দু’একবার কল্যাণপুরের ভিতর দিয়ে মঙ্গলকোটে ঢোকার চেষ্টাও করেন। কিন্তু তাতে বাসাপাড়ার ওই নেতা ‘চাপে’ পড়ে যান। তখন আজাদ ফের কাজলের এলাকায় ফিরে যান। সেখানে কয়েক মাস থাকার পরেও যখন গ্রামে ঢোকার ব্যাপারে কোনও সুরাহা হল না, তখন আজাদ অনুব্রতর খাসতালুক বোলপুরে গিয়ে ওঠেন। তৃণমূল নেতা-কর্মীদের একাংশের দাবি, আজাদ আশা করেছিলেন, অনুব্রত হয়তো তাঁকে মঙ্গলকোটে ফেরাতে পারবেন।

গত ৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বোলপুরে তৃণমূলের জেলা পার্টি অফিস থেকেই নিখোঁজ হন আজাদ। যা ছিল তাঁর খাসতালুক কল্যাণপুরে অজয়ের সেই চরেই ৯ সেপ্টেম্বর মেলে আজাদের দেহ। উত্থান-পতনের মাঝে মাত্র আট বছর। তার মধ্যেই খুন, তোলাবাজি-সহ গোটা ৩৫ মামলা। এ সবের মাঝে পড়ে গ্রামে আর ফেরা হল না মঙ্গলকোটের বছর তেত্রিশের আজাদ মুন্সির।

(শেষ)

saumen dutta mongolkot azad munshi
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy