খাঁটি দুধের জন্য হাবরার পৃথীবা গ্রামের গৌরাঙ্গ ঘোষের নামডাক খুব। দুধে কী যাদু আছে সেই কৌতুহলেই তাঁর গোয়ালে একটি দেশি গরুর বাচ্চা হওয়ার সময় ভিড় করেছিলেন এলাকার লোকজন। একটি সাদা-ধূসর ছোট্ট ছটফটে বাছুর হয় নির্বিঘ্নে। কিন্তু তারপরেই বিপর্যয়। গৌরাঙ্গবাবুর কথায়, ‘‘যে মাধু (গরুর নাম) প্রতিদিন ১০ লিটারের মতো অতিরিক্ত দুধ দিয়েছে, বাছুর হওয়ার পরে সেই গরুর দুধ শুকিয়ে কাঠ। পালান, বাঁট শক্ত হয়ে পাথরের মতো।’’ বরফ ঘসে, পশু চিকিৎসক দেখিয়েও লাভ হয়নি।
এমনটা হল কেন?
ভুল ধরিয়ে দিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের সবং-এর পশু চিকিৎসক বানেশ্বর মান্না। তাঁর কথায়, ‘‘মানুষের মতোই প্রজননের সময় কষ্টে-লজ্জায় থাকে গরুও। তাই বাচ্চা হওয়ার সময় চিকিৎসক আর গোপালক ছাড়া কারও সেখানে থাকা উচিত নয়। এতে গরুর মস্তিষ্কে আঘাত হয়। যার জেরে গরুর আচার-ব্যবহার এবং শারীরিক প্রক্রিয়ায় অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়।’’ বিপত্তির কারণ এটাই।
এই রকম গরু সম্পর্কিত আরও নানা বাস্তব সমস্যার সমাধান জানা গেল গোপালনের কর্মশালায়। সেখানে উপস্থিত ন্যাশনাল ডেয়ারি ডেভলপমেন্ট বোর্ডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর দিলীপ রথ বলেন, ‘‘ বিহারের পর এবার পশ্চিমবঙ্গে গো-পালনের কর্মশালা শুরু হয়েছে। উদ্দেশ্য, দুগ্ধ উৎপাদন থেকে শুরু করে খুচরো বিক্রি পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে নজর রাখা। বিশেষ করে গোপালনের ক্ষেত্রে সঠিক পরিচর্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করা।’’
ভাল দুধ পেতে
পিংলার দুগ্ধ ব্যবসায়ী গোষ্টগোবিন্দ দাস অধিকারী এক-একটি জার্সি গরু থেকে প্রতিদিন ‘জলচক দুগ্ধ উৎপাদন সমিতিকে’ সকালে সাত লিটার এবং বিকালে চার লিটার করে দুধ সরবরাহ করেন। এর জন্য একটি গরুকে প্রতিদিন তিন কিলোর মতো নেপিয়ার বা পেরার মতো বিশেষ সবুজ ঘাস, সব্জি, সব্জির খোসা, কচি পাতা খেতে দেন তিনি। সাত কিলোর মতো গোখাদ্য, যেমন বিচুলি, খইল, খনিজপদার্থ, ভুট্টা, চাল গুঁড়ো খেতে দেন। দিনে ৩০ থেকে ৪০ লিটারের মতো জল দেন। মোটর পাম্প দিয়ে গরুর গোয়াল নিয়মিত পরিষ্কার করেন। দিনে দু’বার, গ্রীষ্মকালে তিন বার গরুকে স্নান করান। গোষ্টগোবিন্দবাবুর কথায়, ‘‘এ ছাড়াও নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ মতো গরুর পরিচর্যা করতে হয়।’’
প্রজননের সময়
গোপালনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল প্রজননের সময় যথার্থ পরিচর্যা মিলেছে কি না। এই সময়ে কী করা উচিত তা নিয়ে উদ্বেগে থাকেন গোপালকেরা। চিকিৎসকদের পরামর্শ মতো একটি গরুর ওজন ৩০০ কিলো ধরে নিয়ে এই সময় যা যা কর্তব্য পালন করা উচিত, তা হল—
• স্বাভাবিক বা কৃত্রিম উপায়ে প্রজননের তিন মাস পরে গরু গর্ভবতী হল কি না তার পরীক্ষা করতে হবে।
• গরু গর্ভবতী হওয়ার ঠিক চার মাস পর থেকে সাত মাস পর্যন্ত (প্রজননের দিন থেকে, গর্ভবতী পরীক্ষার পর থেকে নয়) পাঁচ লিটার ভাল কোম্পানির ক্যালশিয়াম প্রতিদিন ১০০ মিলিলিটার করে খাওয়াতে হবে।
• কৃমির জন্য প্রতিষেধক রাতে খাওয়াতে হবে।
• এই সময় গরুর যদি গলা ফুলে যায় তাহলে ভ্যাকসিন দিতে হবে।
• ন’মাসের সময় পালান (গরুর বাঁট যেখান থেকে নামে) বড় করার জন্য মেটাবলাইডের মতো পাউডার সকালে-বিকালে অবশ্যই খাওয়াতে হবে। এতে দুধের পরিমাণও বাড়বে।
• গরুর বাচ্চা হওয়ার সময় চিকিৎসক আর যিনি গরুর পরিচর্যা করেন, তিনি ছাড়া কেউ যেন না থাকেন গোয়ালে।
• বাচ্চা হওয়ার পর গরুর পালান শক্ত হয়ে যাবে। সেই সময় একটি কাপড়ে বরফ কুচি নিয়ে দু’বেলা মিনিট দশেক ধরে গরুর পালানে আস্তে আস্তে ছোঁয়াতে হবে। কোনও ভাবেই ম্যাসাজ বা মালিশ করা যাবে না। এই ভাবে পরিচর্যা করলে পালান নরম হয়ে দুধ আসবে।
• এরপরেও দুধ না নামলে, ওষুধ খাওয়াতে হবে। বাচ্চা হওয়ার ১০ দিন পরে মা-গরুকে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিনের একটি ওষুধ মাসে ১০ দিন করে খাওয়াতে হবে। এতে গরুর বাঁট পর্যন্ত দুধ আসার জায়গাগুলি পরিষ্কার হবে।
• প্রসবের ১৫ দিন পর কৃমির ওষুধ খাওয়াতে হবে।
• যদি দুধে ফ্যাট কমে যায়, তাহলে ফ্যাট বাড়াবার ওষুধ দিতে হবে। বাছুরকে মায়ের দুধ পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে দিতে হবে।
• ১০ দিন পর মানুষ ওই দুধ খেতে পারবে। তবে ভাল ভাবে ফুটিয়ে নিয়ে খেতে হবে।
• প্রসবের স্থানটি নিয়মিত পরিষ্কার করার পাশাপাশি কড়া নজরে রাখতে হবে।
• বাচ্চা হওয়ার ১০ দিন পর থেকে গরুকে দু’বেলা স্নান করানো যাবে। পর্যাপ্ত জল খেতে দিতে হবে।
• প্রজননকালে গরুকে তিন কেজি ঘাস বা সবুজ সব্জি এবং তিন কেজি গোখাদ্য দিতে হবে। বাচ্চা হওয়ার পর থেকে তিন কেজি ঘাস বা সবুজ সব্জি এবং সাত কেজি পর্যন্ত গোখাদ্য দিতে হবে।