মৃদুমন্দ হেমন্তের হাওয়া আর অল্প শীতের আঁচ। শহর থেকে একটু বেরোলেই হাইওয়ের দু’পাশে হাল্কা আগুনের তাত, কাঠের চুল্লির সারি আর তার উপরে হাতের চেটো রাখা চাদর মুড়ি দেওয়া কিছু মানুষের জটলা। এ সব মিহি আর চোখের পক্ষে আরামদায়ক দৃশ্যাবলি ঋতুরাজের সহ্য হবে কেন? নির্বাচন কমিশনেরও। তা না হলে যে দিন কমিশন ভোটের দিনক্ষণ খোদ রাজধানী থেকে ঘোষণা করল, তার সঙ্গে তাল মিলিয়েই যেন বা আকাশের মেঘে সূর্য তার খরখরে দাঁত ফোটাতে শুরু করল, উষ্ণ গরমধারা ছড়িয়ে পড়ল চরাচর জুড়ে। পাঁচ দফার গরম। উত্তরবঙ্গ থেকে তার উত্তাপ শুরু, পুরুলিয়ায় সেই তাত যখন গিয়ে পৌঁছচ্ছে সূর্য তখন অট্টহাসি হাসছে। নট্ট কোম্পানির ভিলেনের মতোই। কালিদাস হলে অবশ্য বলতেন, ‘এ সব হচ্ছে ত্র্যম্বকের অট্টহাসি’।
কিন্তু হে মহাজীবন, এখন আর কাব্যের সময় নেই। এখন কঠোর কর্কশ গদ্যের শুরু। ভোট এসে গিয়েছে। ভোট প্রচারক হয়ে যেতে হবে উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ। মানুষকে বোঝাতে হবে কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চাই। কেন তাঁকেই চাই। মনে পড়ে যায়, বাংলাদেশের এক প্রাবন্ধিক অনেকটা অনুরূপ শিরোনামে লিখেছিলেন, ‘কেন রবীন্দ্রনাথকে চাই’। ঠিক সে ভাবেই মানুষের কাছে যেতে চাইছি এ কথা বোঝাতে, যদি সাম্প্রদায়িকতা না চান, যদি বাংলা ভাগ না চান, যদি পরিবারতন্ত্র না চান, যদি হার্মাদদের আবার ফেরাতে না চান, তা হলে ভারতবর্ষের হাতে এখন একটাই তাস। একটাই হরতনের টেক্কা। তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থ দেখতে এবং সংখ্যালঘিষ্ঠের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে তামাম ভারতবর্ষে এখন এক জনই পারেন। তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রচারক আমি। শুরু করছি দমদম থেকে। সেই দমদম। যে দমদমকে কিছু দিন আগেও সবাই বলতেন দমদমা। দাওয়াই বোঝাতে তার অনিবার্য বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হতো যে শব্দটি এই কিছুদিন আগেও। এই তো কিছুদিন আগেই বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন ‘অপরাজিত’ উপন্যাসে ‘দমদমার গুলির কারখানাটি’। সেই দমদম। আমার প্রার্থী, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, অদম্য এনার্জির অধিকারী, গত পাঁচ বছরে দমদম লোকসভা আসনের সাতটি বিধানসভা চষে ফেলা বর্ষীয়ান প্রাজ্ঞ অধ্যাপক সৌগত রায়। তাঁকে সামনে রেখে আমাদের চলা শুরু।
জিপে চড়া শুরু হল। হাঁটাও। মনে পড়ল, তিন বছর আগের কথা। আমাকে প্রায় পক্ষীশাবকের মতো আগলে আমার বর্তমান প্রার্থী তখন ঘুরেছেন বিধানসভা নির্বাচনে। প্রতিটি বাড়ির প্রতিটি দরজায় আমি গিয়েছি তখন। কয়েক হাজার বর্গফুট, ৩৯টি ওয়ার্ড, দু’লক্ষের উপর ভোটার, এক লক্ষের কাছাকাছি বাড়ি, অজস্র কলোনি। পুড়ে ঝামা হয়ে গিয়েছিলাম দেড় মাসে। তা-ও ছাড়িনি। ক্রমাগত হেঁটে গিয়েছি। তারপর বিধায়ক হয়েছি। তিন বছরে হেন কোনও ওয়ার্ড নেই, যেখানে যাইনি। হেন কোনও মানুষ নেই, যাঁর সঙ্গে দেখা করিনি। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-রাজনীতি নির্বিশেষে।
তিন বছর পরে আবার দমদমের অলিতে গলিতে ঘুরতে ঘুরতে বিধানসভা নির্বাচনের সেই সব স্মৃতি মনে পড়ছিল। আমি গভীর ভাবে বিশ্বাস করি, সংসদীয় রাজনীতি বস্তুতপক্ষে কী, তা বোঝার জন্য সংসদ বা বিধানসভাই শেষ কথা নয়। পার্টি ক্লাস বা অফিসও যথেষ্ট নয়। কম সে কম কাউন্সিলর নির্বাচনে দাঁড়ালেই তা মালুম পাওয়া যাবে। ওইটেই স্টেজ, ওইটেই শু্যটিং ফ্লোর, ওইটেই উপন্যাসের আদত খসড়া।
প্রচার করতে করতেই বুঝতে পারছিলাম সৌগতদা জিতবেন। বহু মার্জিনে। জিতবেন তাঁর নিজের জন্য তো বটেই। আরও বেশি করে বিরোধীদের মানুষ এই মুহূর্তে চাইছেন না বলে। তাঁরা চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই। তাঁর উন্নয়নের কর্মসূচিকে। কজর্র্গ্রস্ত, পোকায় কাটা একটি রাজ্যকে কী করে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে হয়, সেই ভানুমতীর জাদুবিদ্যাকে অব্যাহত রাখার জন্য। দমদমের প্রতিটি ঘরে আবার সেই স্লোগান উঠেছে, ‘যখনই ডাকি, তখনই পাই। সৌগত রায়কে আবার চাই।’
দেখতে দেখতে আমরা ঘুরে ফেললাম বেদিয়াপাড়া, সুভাষনগর, শেঠবাগান, কুণ্ডুবাগান, দাগা কলোনি, ফকির ঘোষ লেন, প্রাইভেট রোড, মল রোড, ক্লাইভের বাড়ি, সেন্ট্রাল জেল, গোরাবাজার বা দু’নম্বর গেট এয়ারপোর্ট। পেরোলাম ইলেকট্রিক বাল্বের ঝিলিক মারা বাজার, আনাজ ও সব্জির সবুজ গ্যালারি, টাটকা রক্তাক্ত আড় মাছ আর বঁটি নিয়ে বসা হাস্যরত বুশ শার্ট আর লুঙ্গি পরিহিত মাছওয়ালাকে। পেরোলাম উদ্দাম তরুণের ঝাঁক আর হাত নাড়া লাজুক কিশোরীর ভিতু চোখকে, পেরোলাম দু’হাতে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা প্রসন্ন চোখের বৃদ্ধকে। পেরোলাম স্বাস্থ্যবান স্বামীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা উৎসুক চোখের কপালে উপুড় করে ঢালা সিঁদুর পরিহিতা তরুণী বধূকে, পেরোলাম আসলে গোটা দমদমকে। যেখানে চার জংশনের লড়াই।
ভাবতে ভাল লাগছিল, আমরা যে রাস্তা দিয়ে সুসজ্জিত ক্যারাভ্যান নিয়ে যাচ্ছি, মাত্র আড়াইশো বছর আগে সেই কাঁচাপাকা রাস্তা দিয়ে লম্বা কিংখাব পরিহিত ক্লাইভ সাহেবও লোকলস্কর নিয়ে হেঁটেছেন। হয়তো কাদা সামলাতে দু’হাতে জোব্বা ধরে একটু উপর দিকে তুলেছেন গম্ভীর মুখে। তারপর আবার হেঁটেছেন। বা এই রাস্তা দিয়েই গোরাবাজারে ফিরিঙ্গি সেনারা কাঁধে বন্দুক আর তাঁবু নিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে ঢুকেছে ক্যান্টনমেন্টে। মাথায় কাঁটাওয়ালা টুপি, উপরে চাঁদ। দু’পাশে লম্বা গাছ। তার ছায়া পড়ছে পুকুরে। পাশেই শিবমন্দির। ভিতরে লম্ফ জ্বলছে। বা আরও পরে বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় মধ্যরাতে মড়মড় শব্দ করে ট্যাঙ্ক গিয়েছে। বাচ্চারা ঘুমোচ্ছিল। সারি সারি মালগাড়ির ওয়াগনের মতো টানা ট্যাঙ্ক চলে গিয়েছে। সেটা একরকম যুদ্ধ। এটা আর এক রকম।
গত লোকসভা নির্বাচনে সৌগত রায় জিতেছিলেন ২২ হাজার ভোটে। তার মধ্যে দমদম বিধানসভা কেন্দ্রে ছিল ৭০০ ভোটের মার্জিন। তার পরে পুরভোট হল। দমদম বিধানসভার ভিতরে দু’টি পুরসভা। একটির নাম দমদম, অন্যটি দক্ষিণ দমদম। দক্ষিণ দমদমে জোট হল। তৃণমূল জিতে বোর্ড তৈরি করল। দমদমে জোট হল না। তৃণমূল জিতল এবং বোর্ড গঠন করল। দু’বছর পরে বিধানসভা নির্বাচন হল। তৃণমূল জিতল প্রায় ৩২ হাজার ভোটে। সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের হিসেব ধরলে সৌগত রায় এই মুহূর্তে ২ লক্ষের বেশি মার্জিনে এগিয়ে রয়েছেন। মার্জিন কতটা কমবে বা বাড়বে, সেটাই যা দেখার।
আমি আমার সতীর্থ বাকি ছয় বন্ধু বিধায়ককে এক মধুর চ্যালেঞ্জ দিয়েছি। বলেছি, যিনি তাঁর কেন্দ্র থেকে সৌগত রায়কে সর্বাধিক ব্যবধান দেবেন, তিনিই হচ্ছেন চ্যাম্পিয়ন অব চ্যাম্পিয়নস। দ্য রিয়েল হিরো। এ যুদ্ধে জিতলেও ভাল, না জিতলেও ক্ষতি নেই। যিনি জিতবেন, তাঁকে বাকিরা খাওয়াবে। সৌগত রায় বিশেষ অতিথি হিসেবে থাকবেন সেই দিন। খাওয়াটা মনে হচ্ছে দমদমের কপালেই জুটবে। দেখা যাক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy