Advertisement
E-Paper

চড় মারার দায়ে খুনের চেষ্টার মামলা পুলিশের

চড় মারলে খুনের চেষ্টা বলে মামলা দায়ের হয়, অথচ গণধোলাইয়ে তা হয় না! এমনটাই দেখাল রাজ্য পুলিশ! রবিবার পূর্ব মেদিনীপুরের এক জনসভায় তৃণমূল সাংসদ তথা মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে চড় মেরেছিলেন দেবাশিস আচার্য নামে এক যুবক। পাল্টা গণপিটুনি খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাঁকে। সোমবার পুলিশ জানিয়েছে, চড় মারার জন্য ওই যুবকের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার মামলা দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসাধীন দেবাশিসকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:০৭
সিটি স্ক্যানের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ধৃত দেবাশিস আচার্যকে। সোমবার তমলুক জেলা হাসপাতালে।  নিজস্ব চিত্র

সিটি স্ক্যানের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ধৃত দেবাশিস আচার্যকে। সোমবার তমলুক জেলা হাসপাতালে। নিজস্ব চিত্র

চড় মারলে খুনের চেষ্টা বলে মামলা দায়ের হয়, অথচ গণধোলাইয়ে তা হয় না! এমনটাই দেখাল রাজ্য পুলিশ!

রবিবার পূর্ব মেদিনীপুরের এক জনসভায় তৃণমূল সাংসদ তথা মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে চড় মেরেছিলেন দেবাশিস আচার্য নামে এক যুবক। পাল্টা গণপিটুনি খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাঁকে। সোমবার পুলিশ জানিয়েছে, চড় মারার জন্য ওই যুবকের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার মামলা দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসাধীন দেবাশিসকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। কিন্তু দেবাশিসের উপরে যে পাল্টা হামলা, সেটাও কাছ থেকে দেখেছিল পুলিশ। অথচ কিছু অজ্ঞাতপরিচয়ের বিরুদ্ধে অনিচ্ছাকৃত খুনের চেষ্টার মামলা দায়ের করেই দায় সেরেছে তারা। কেউ গ্রেফতার হয়নি।

রবিবার দেবাশিসকে বাঁচাতে গিয়ে নিগৃহীত হয়েছিলেন কয়েক জন পুলিশ কর্মীও। হামলা হয় চণ্ডীপুর থানাতেও। মহিলা পুলিশ কর্মীরা প্রাণ বাঁচাতে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ওই ঘটনায় খুনের চেষ্টার মামলা করেছে পুলিশ। কিন্তু সেখানে আবার অভিযুক্তদের কাউকে চিহ্নিত করা হয়নি। মামলা হয়েছে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। আলিপুর থানার মতো এ ক্ষেত্রেও অভিযুক্তেরা শাসক দলের হওয়ায় পুলিশ হামলাকারীদের কাউকে শনাক্ত করতে চায়নি বলে বাহিনীর নিচুতলার অভিযোগ। পুলিশ যে কার্যত দলদাসে পরিণত হয়েছে, এই ঘটনা সেটাই আরও এক বার প্রমাণ করল বলে জেলা পুলিশের এক ডিএসপি পদমর্যাদার অফিসার সোমবার মন্তব্য করেছেন।

পুলিশ সূত্রের খবর, অভিষেক নিজে থানায় কোনও অভিযোগ দায়ের করেননি। বরং ওই যুবককে ক্ষমা করে দেওয়ার কথাই বলেছেন। চণ্ডীপুর ব্লকের তৃণমূল যুব কংগ্রেস সভাপতি তথা স্থানীয় ঈশ্বরপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান সুনীল প্রধানের অভিযোগের ভিত্তিতেই এ দিন দেবাশিসের বিরুদ্ধে মামলা সাজিয়েছে চণ্ডীপুর থানার পুলিশ। স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক অমিয়কান্তি ভট্টাচার্য বলেন, “ওই সভার জন্য সুনীলবাবুই প্রশাসনের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছিলেন। তাই তিনিই অভিযোগ জানিয়েছেন।”

কিন্তু দেবাশিসের বিরুদ্ধে মারধর, অপরাধমূলক অনধিকার প্রবেশ, অপরাধের হুমকি এবং ষড়যন্ত্রের অভিযোগের সঙ্গে খুনের চেষ্টার অভিযোগও আনা হয়েছে। সেটা কেন? কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ কিছুটা ব্যঙ্গের সুরে বলেন, “অভিষেক বোধহয় ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যান। তাই চড় মারাতেও পুলিশ খুনের চেষ্টার অভিযোগ দিয়েছে!” সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি তথা রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অশোক গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, “চড় মারলে খুনের চেষ্টার মামলা দেওয়া হাস্যকর।” কলকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, “পুলিশের দেওয়া ধারায় বাস্তবতা নেই। চড় মারা নিশ্চয়ই অন্যায়। কিন্তু তাতে খুনের চেষ্টার মামলা হয় না।” কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদারের মন্তব্য, “চড় মারলে খুনের চেষ্টার মামলা সাধারণত দেওয়া হয় না।” এ দিনই বিহারের মুখ্যমন্ত্রী জিতনরাম মাঝিকে জুতো ছোড়ার দায়ে গ্রেফতার হয়েছেন এক যুবক। তাঁকে ৩৫৩ ধারায় মামলা দেওয়া হয়েছে, যার সর্বোচ্চ শাস্তি দু’বছরের কারাদণ্ড।

এখানে তা হলে পুলিশ অন্য আচরণ করল কেন? পুলিশের একাংশই বলছেন, শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা যে ভাবে নাক গলান, তাতে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। এই কাজের পিছনেও শাসক দলের নেতাদের নির্দেশ কাজ করেছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন পুলিশের একাংশ। অরুণাভবাবু ঠাট্টা করে বলেছেন, “রাজ্যে এখন তো আইপিসি (ইন্ডিয়ান পেনাল কোড) চলে না। মমতাপিসি (মমতা পেনাল কোড বা মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছায় তৈরি দণ্ডবিধি) চলে।”

কিন্তু দেবাশিসকে যারা পাল্টা মঞ্চের উপরে ফেলে পেটাল তাদের পুলিশ কেন আড়াল করছে? ভগবতীবাবু বলছেন, “ভিডিও ফুটেজে দেবাশিসকে মারধরে জড়িতদের ছবি স্পষ্ট দেখা গিয়েছে। তবুও পুলিশ অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করল!” একই সুর অরুণাভবাবুর গলাতেও। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার এসপি সুকেশকুমার জৈন অবশ্য দাবি করছেন, “ভিডিও ফুটেজ দেখে অভিযুক্তদের চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া চলছে।” কিন্তু এ ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত লঘু ধারায় অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা দেওয়া হয়েছে। অথচ রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মনে করিয়ে দিচ্ছেন, “লাঠি, বাঁশ দিয়ে মারলে যে মৃত্যু হতে পারে, তা তো জনগণের অজানা নয়।” পুরুলিয়ায় শহরে সোমবার এক জনসভা শেষে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী দাবি করেন, “একটা চড় আর এক হাজার চড়-লাথি, দুটোই অপরাধ। ওই যুবককে যেমন গ্রেফতার করা হয়েছে, তেমনই যারা ওই যুবককে মারধর করল, থানায় ভাঙচুর করল তাদেরও গ্রেফতার করতে হবে।” বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহও বলেন, “দেবাশিস অন্যায় করেছেন। কিন্তু তৃণমূলের যে নেতা-কর্মীরা দেবাশিসের উপর অমানবিক অত্যাচার করেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের নামে খুনের মামলা করার দাবি করছি।”

দেবাশিসকে গণপিটুনির হাত থেকে উদ্ধার না করে পুলিশ যে ভাবে পালিয়ে গিয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ভগবতীবাবু বলেন, “পুলিশের উচিত ছিল, ওই যুবককে গণপিটুনি থেকে উদ্ধার করে হেফাজতে নেওয়া। কিন্তু তা না করে পুলিশ পালিয়ে গিয়েছিল।” যদিও পুলিশের দাবি, তারাই ওই যুবককে উদ্ধার করে। সে সময়ই তাঁদের উপরে ও থানায় হামলা চালান তৃণমূল কর্মীরা। সেই ঘটনায় খুনের চেষ্টার অভিযোগই রুজু হয়েছে। তা ছাড়া সরকারি কর্মীদের কাজে বাধা, মারধর, বেআইনি জমায়েত, সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি করা, আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গের মামলাও করেছে পুলিশ। কিন্তু সেখানেও কোনও অভিযুক্তের নাম নেই। বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুর অভিযোগ, “তৃণমূল কর্মীরা যা খুশি করবে, কিন্তু কাউকে গ্রেফতার করা হবে না। এটাই এখন দস্তুর।”

manhandle row debasish acharyay abhisekh bandyopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy