সংশোধনাগারে বন্দিদের মোবাইল ব্যবহার রুখতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। কিন্তু স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রের খবর, কলকাতার যে তিনটি সংশোধনাগারের বন্দিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মোবাইল ফোন ব্যবহারের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, সেই প্রেসিডেন্সি, আলিপুর ও দমদমে ‘মোবাইল টাওয়ার জ্যামার’ বসানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েই হোঁচট খেয়েছে। কারণ, দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হলেও এখনও বাছাই সংস্থাকে বরাত দিতে পারেনি কারা দফতর।
ওই তিনটি সংশোধনাগারে সব মিলিয়ে ৩৩টি ‘জ্যামার’ বসানো হবে বলে ঠিক করা হয়েছে। রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, তিনটি সংশোধনাগারে ‘জ্যামার’ বসাতে চলতি আর্থিক বছরের বাজেটে ১২ কোটি টাকা বরাদ্দও হয়েছে। সেই অনুযায়ী, এপ্রিলের মধ্যেই যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করে কোনও উপযুক্ত সংস্থাকে বরাত দেওয়ার কথা ক্যালেন্ডারে রয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ওই ‘জ্যামার’ বসানোর কাজ সম্পূর্ণ হবে বলেও উল্লেখ হয়েছে। কিন্তু ঘটনা হল, বাজেটে থাকলেও অর্থ দফতর ওই টাকা এখনও কারা দফতরকে দেওয়ার ব্যাপারে সবুজ সঙ্কেত দেয়নি। অর্থ দফতর থেকে লিখিত অনুমোদন না আসা পর্যন্ত বরাত দেওয়ার ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব নয় বলে কারা দফতর জানিয়েছে। কারা দফতরের একাধিক কর্তার আশঙ্কা, অর্থ দফতর দ্রুত ‘জ্যামার’ বসানোর টাকা দেওয়ার অনুমোদন না দিলে গোটা প্রক্রিয়াটাই ঝুলে যাবে।
সমস্যা আরও আছে। সরকারি সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন যে সংস্থা ওই জ্যামার বসানোর বরাত পাওয়ার উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়েছে, তারাও জানিয়ে দিয়েছে গোটা প্রক্রিয়া যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। বরাত পাওয়ার পরে ‘জ্যামার’ তৈরি করে সরবরাহের জন্য অন্তত ১০ মাস সময় দরকার। জুলাই মাস শেষ হতে চলেছে। এখনও অর্থ দফতরের অনুমোদন মেলেনি। কারা দফতরের সচিব পর্যায়ের এক অফিসার জানান, অর্থ দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনুমোদনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার চেষ্টা চলছে। যদিও, পুজোর আগে অনুমোদন মিলবে কি না তা নিয়ে নিশ্চিত নন সংশ্লিষ্ট কর্তাদের অনেকে। তাই আগামী বছরেও ‘জ্যামার’ বসবে কি না, তা-ও অনিশ্চিত।
এ রাজ্যে সংশোধনাগারের বন্দিদের মধ্যে মোবাইলের রমরমা প্রশাসনের মাথাব্যথার কারণ হয়েছে দীর্ঘদিনই। অতীতে বন্দি মাওবাদীদের একাংশ মেদিনীপুর সংশোধনাগারে বসে বড় মাপের নাশকতা ঘটানোর চেষ্টা করে চলেছেন বলে আঁচ পেয়েছিলেন পুলিশ ও গোয়েন্দারা। তার পরে নিরাপত্তার কারণে মাওবাদীদের সকলকে এক সংশোধনাগারে না রেখে নানা জায়গায় ছড়িয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। সম্প্রতি আবার কাও-কাণ্ড-সহ এ ধরনের একাধিক ঘটনা নিয়ে রাজ্য মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য অভিযোগ জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। সরকারি সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রীও স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন, কোনও বন্দি যাতে জেলে বসে মোবাইল ব্যবহার করতে না পারে, দলমত নির্বিশেষে তা নিশ্চিত করতে সব রকম ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রশাসন সূত্রের খবর, এই পরিস্থিতিতে ‘জ্যামার’ বসানো শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি সংশোধনাগারে ‘ক্লোজড সার্কিট’ টিভিতে নিয়মিত নজরদারি চালিয়ে মোবাইল বাজেয়াপ্ত করার উপরে জোর দিয়েছেন কারা কর্তৃপক্ষ। যে কারারক্ষীরা মোবাইল আদানপ্রদানে মদত দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে। কারা দফতর সূত্রের খবর, চলতি বছরেই ৬০ জন কারাকর্মীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে। যাঁদের মধ্যে ১৪ জনকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে।
কারা দফতরের কর্তাদের একাংশ আবার দাবি করেছেন, ‘জ্যামার’ বসালেই যে সমস্যার চটজলদি সমাধান হয়ে যাবে, তেমন ভাবা ঠিক নয়। যুক্তির সমর্থনে তাঁরা টানছেন ইন্টারনেট থেকে মেলা তথ্য। যেমন, ‘জ্যামার’ থাকলেও করাচি জেল থেকে বন্দিদের একাংশ বাইরের জঙ্গিদের সঙ্গে নিয়মিত কথাবার্তা কী ভাবে বলছে তা নিয়ে পাকিস্তানে তদন্ত চলছে।
প্রকৃতপক্ষে সংশোধনাগারে বেআইনি মোবাইল ব্যবহার রোধের ব্যাপারে বহু দেশই উদ্বিগ্ন। স্কটল্যান্ডেও কারাবন্দিদের মোবাইল ব্যবহার
রোধ করানো নিয়ে নানা পরীক্ষা চলছে। সেখানে কারা-অন্দরে কোনও মোবাইল সংস্থার সিগন্যাল যাতে না মেলে সেই ব্যবস্থা করতে আইনসভায় আইন পাস করানো হয়েছে।
হন্ডুরাসেও সংধোশধনাগারকে মোবাইল-মুক্ত রাখতে আইনসভায় প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। সেই প্রস্তাব অনুযায়ী, হন্ডুরাসের কোনও কারাগারে যাতে সিগন্যাল না মেলে তা নিশ্চিত করার জন্য ৯টি সেলুলার ফোন সংস্থাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংশোধনাগারে মোবাইলের ব্যবহার রুখতে এ বার এই রাজ্য কোনও আইন করার দিকে এগোয় কি না, সেটাই এখন দেখার।
(শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy