Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সিবিআইকে ধন্যবাদ সাংসদের

জেরার ঘরেই দেখা সুদীপ্ত ও কুণালের

বারবার সারদা-প্রধান সুদীপ্ত সেনের মুখোমুখি হতে চাইছিলেন তিনি। অবশেষে সিবিআই সেই সুযোগ এনে দিল সাংসদ কুণাল ঘোষকে। রবিবার সন্ধ্যায় সুদীপ্ত এবং তাঁকে একসঙ্গে বসিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে জেরা করা হয়েছে বলে কুণালের দাবি। সুদীপ্ত অবশ্য এ ব্যাপারে কিছু জানাননি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৪ ০৩:৪০
Share: Save:

বারবার সারদা-প্রধান সুদীপ্ত সেনের মুখোমুখি হতে চাইছিলেন তিনি। অবশেষে সিবিআই সেই সুযোগ এনে দিল সাংসদ কুণাল ঘোষকে। রবিবার সন্ধ্যায় সুদীপ্ত এবং তাঁকে একসঙ্গে বসিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে জেরা করা হয়েছে বলে কুণালের দাবি। সুদীপ্ত অবশ্য এ ব্যাপারে কিছু জানাননি।

সারদা গোষ্ঠীর আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয়ে কিছু তথ্য জানাতে চান বলে বারবার দাবি করছিলেন অন্যতম অভিযুক্ত কুণাল। সেই জন্যই তদন্তকারীদের সামনে মুখোমুখি হতে চাইছিলেন সুদীপ্তের। রবিবার রাতে সল্টলেকে সিবিআইয়ের দফতর থেকে বেরোনোর সময়ে কুণাল সাংবাদিকদের জানান, এ দিন তাঁকে ও সুদীপ্তকে মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করা হয়েছে। এতে তিনি খুশি। কুণাল বলেন, “সিবিআই-কে ধন্যবাদ। আমি তো চেয়েছিলাম, সুদীপ্ত আর আমাকে একসঙ্গে বসিয়ে জেরা করা হোক। সেটাই হয়েছে। কাল (সোমবার) আদালত থেকে জামিন নেব না। সিবিআই যদি আবার আমাকে হেফাজতে নিয়ে জেরা করতে চায়, আরও তথ্য দিয়ে তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করব।” তাঁদের কী কী প্রশ্ন করা হল, তার জবাব দেওয়ার সুযোগ অবশ্য পাননি কুণাল।

তবে সিবিআই সূত্রের খবর, শুধু এ দিনই নয়, গত তিন দিন ধরেই কুণাল ও সুদীপ্তকে মুখোমুখি বসিয়ে দফায় দফায় জেরা করা হয়েছে। জেরায় জানা গিয়েছে, ২০০৯ সালের পর থেকে সংবাদমাধ্যমের ব্যবসায় সারদা যে-বিনিয়োগ করেছিল, তার পরিকল্পনা করেছিলেন কুণালই। দুই বৈদ্যুতিন মাধ্যম, অসমের একটি বাংলা দৈনিক এবং আরও ১৪টি সংবাদপত্র কেনার উদ্যোগ চলছিল। পরোক্ষ ভাবে পুরো সংবাদমাধ্যম ব্যবসার কর্ণধার ছিলেন কুণালই। সংবাদমাধ্যমের ব্যবসায় কর্মী নিয়োগ থেকে শুরু করে টাকা খরচের সিদ্ধান্ত তিনিই নিতেন। তাঁর পরামর্শে সুদীপ্ত অর্থ লগ্নি করেছিলেন মাত্র।

সংবাদমাধ্যমের ব্যবসায় কত টাকা লগ্নি করা হয়েছিল, সেই বিষয়ে সুদীপ্ত স্পষ্ট কোনও তথ্য দিতে পারেননি বলে সিবিআই সূত্রের খবর। তবে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) এবং সিবিআইয়ের প্রাথমিক তথ্য অনুসারে সংবাদমাধ্যমের ব্যবসায় সারদার বিনিয়োগ প্রায় ৫০০ কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তদন্তকারী সংস্থার এক কর্তা জানান, কুণালকে ফের সুদীপ্তের মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করা হবে। সংবাদমাধ্যমের ব্যবসায় লগ্নির সূত্রে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছে টাকা পাঠানো হয়েছিল কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হবে।

সারদার বিপুল পরিমাণ অর্থ কোথায় গিয়েছে, কারা তাতে বেশি লাভবান হয়েছে, সিবিআই-কে সেটাই দেখতে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট। এ ক্ষেত্রে এখন সিবিআইয়ের মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে সারদার দুই ফেরার গাড়িচালক। সিবিআই সূত্রের খবর, সুদীপ্ত এবং তাঁর সঙ্গিনী, সারদার ডিরেক্টর দেবযানী মুখোপাধ্যায়ের গাড়ি চালাতেন ওই দু’জন।

এক তদন্তকারী অফিসার জানান, ওই দু’জনের মাধ্যমে লগ্নিকারীদের কয়েক কোটি সরানো হয়েছে বলে তাঁরা জেনেছেন। সেটা যাচাই করতেই ওই দু’জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার। কিন্তু দুই গাড়িচালকই বেপাত্তা। রাজ্য পুলিশ এবং বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) দীর্ঘ এক বছর সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত চালিয়েছে। তখন কি ওই দুই গাড়িচালককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল?

এক সিট-কর্তা জানান, সারদার বিভিন্ন সংস্থার কিছু গাড়িচালককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁদের মাধ্যমে টাকা পাচার করা হয়েছিল, এমন কোনও তথ্য মেলেনি। রাজ্য পুলিশের তদন্তকারীদের বক্তব্যও প্রায় একই রকম।

অথচ সারদার কিছু পদস্থ কর্তার সঙ্গে সঙ্গে ওই দুই গাড়িচালকও এই তদন্তে তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন বলে জানাচ্ছে সিবিআই। তাদের এক তদন্তকারী জানান, ২০১০ সালে একটি কেন্দ্রীয় অর্থ নিয়ন্ত্রক সংস্থার চিঠি পায় সারদা। তার পরেই সুদীপ্ত আমানতকারীদের টাকা সরানোর ছক কষেন বলে সারদার কিছু কর্তা সিবিআই-কে জানিয়েছেন। সেই অনুযায়ী প্রতি মাসে ৩৫-৪৫ লক্ষ টাকা বস্তায় ভরে কিছু অফিসারের বাড়িতে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। বস্তা-ভর্তি সেই টাকা পৌঁছে দিতেন ওই দুই গাড়িচালক। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগ পেলে সেই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলতে পারে বলে মনে করছে সিবিআই। সারদার একাধিক কর্মী সিবিআই-কে বলেছেন, টাকা সরানো হয়েছিল ২০১৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। ওই বছরেরই এপ্রিলে বন্ধ হয়ে যায় সারদা।

সারদার বিপুল টাকা কোথায় গেল, তার হদিস পেতে লগ্নিকারীদের দেওয়া টাকার বেশ কিছু ‘ভাউচার’ বা রসিদের সন্ধান করছিল সিবিআই। কিন্তু এখনও তা মেলেনি। ওই সব চিরকুট পেলে সারদা কেলেঙ্কারিতে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের যুক্ত থাকার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যেত বলে মনে করছে সিবিআই। খোঁজ মিলছে না সুদীপ্তের কিছু নোটবুক, পেনড্রাইভ, মেমরি চিপেরও। সারদার কর্মীরা সিবিআই-কে বলেছেন, খতিয়ানের বাইরে যে-টাকা দেওয়া হতো, তার হিসেব রাখতেন সুদীপ্ত। তাই ওই সব নথির বিশেষ প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন এক তদন্তকারী অফিসার।

নথি না-মেলায় রাজ্য পুলিশ ও সিটের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে সিবিআই। তাদের এক অফিসার বলেন, “রাজ্য পুলিশ ও সিট এক বছর ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সারদার কর্মীদের। তা সত্ত্বেও তারা অতি প্রয়োজনীয় ওই সব তথ্য পায়নি কেন? কেনই বা ওই সব নথি মিলছে না?” জবাব পেতে রাজ্য পুলিশের কিছু তদন্তকারী অফিসারকেও ফের জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হবে বলে মনে করছে সিবিআই।

সিবিআইয়ের এক কর্তার দাবি, দুই ২৪ পরগনা, আসানসোল থেকে সংগৃহীত আমানতের একটা বড় অংশ সংশ্লিষ্ট এলাকায় সারদার অফিসে জমা না-দিয়ে বস্তায় ভরে সল্টলেকে মিডল্যান্ড পার্কে সারদা-প্রধানের ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হতো বলে সারদার কিছু কর্মী জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন। সারদা-কর্ণধারের মুখোমুখি বসে কোনও কর্মী যখন এই তথ্য দিচ্ছেন, সুদীপ্ত তখন বলছেন, তিনি ওই টাকার কথা জানেন না। উল্টে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মীকেই দোষারোপ করছেন। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের টাকা দেওয়ার বিষয়টিও তিনি কখনও এড়িয়ে যাচ্ছেন, কখনও বা অস্বীকার করছেন।

সারদার এক কর্তাই সিবিআইকে বলেছেন, তিনি এক দিন বস্তা-ভর্তি এক কোটি টাকা মিডল্যান্ড পার্কে সুদীপ্তের ঘরে জমা দিতে গিয়েছিলেন। তখন সেখানে ছিলেন সারদার পদস্থ কর্তা সোমনাথ দত্ত। কিছু পরে সেই টাকার অধিকাংশই নিয়ে বেরিয়ে যান সোমনাথ। সিবিআই বলছে, এই তথ্যের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে সুদীপ্ত ও সোমনাথ তা অস্বীকার করেছেন। ওই টাকা জমা পড়ার হিসেব সারদার খাতাতেও মেলেনি। তাই সুদীপ্তকে আরও জেরা করতে চায় তারা। সুদীপ্ত তদন্তের অভিমুখ ঘুরিয়ে দিতেই বিষয়গুলি অস্বীকার করছেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে সিবিআইয়ের।

সিবিআই সূত্রের দাবি, একটি ক্লাবকে স্পনসরশিপ বাবদ কয়েক কোটি টাকা দেওয়ার যে-হিসেব পাওয়া যাচ্ছে, সেই ক্লাবে তত টাকা পৌঁছয়নি বলেই তদন্তে জানা গিয়েছে। তবে সেই টাকা কোথায় গেল, তা জানতেও জেরা করা হচ্ছে সুদীপ্তকে।

রবিবারেও সারদার কিছু কর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিবিআই। ওই সব কর্মীর মধ্যে আছেন এক মহিলা, যিনি ঢাকুরিয়ায় সারদা অফিসের দায়িত্বে ছিলেন। ২০১১-র মাঝামাঝি দেবযানীর সঙ্গে সুদীপ্তের গোলমাল শুরু হয়। তখন প্রায় সাত মাস অফিসে যাননি দেবযানী। সেই সময় সারদার ব্যাঙ্কের কাজকর্ম দেখভাল করা ছাড়াও সুদীপ্তের কনফিডেন্সিয়াল সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করতেন ওই মহিলা। তাঁকে কয়েক ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে বলে সিবিআই সূত্রের দাবি।

এ দিন দেবযানীর সঙ্গে সল্টলেকে সিবিআইয়ের দফতরে দেখা করতে যান তাঁর মা শর্বরী মুখোপাধ্যায় এবং বোন সর্বাণী মুখোপাধ্যায়। সেখান থেকে বেরিয়ে শর্বরীদেবী জানান, তাঁর মেয়ে ভাল আছেন। তিনি সিবিআই তদন্তে খুশি। একটি সূত্রের খবর, সর্বাণীকে কলকাতার একটি বেসরকারি কলেজে ভর্তি করানোর নামে সুদীপ্তের কাছ থেকে কয়েক লক্ষ টাকা নিয়েছিলেন সোমনাথ। সেই টাকার কিছুটা তিনি সরিয়েছেন বলে অভিযোগ। এই ব্যাপারে সোমনাথকে জেরা করছেন তদন্তকারীরা। সর্বাণী সারদার কর্মী নন। কিন্তু দক্ষিণ কলকাতার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে তাঁর নামে সারদার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টেরও হদিস মিলেছে।

একসঙ্গে সুদীপ্ত ও শুভজিৎকে বসাবে ইডি

নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা

সারদা গোষ্ঠীর কর্ণধার সুদীপ্ত সেনকে সংস্থার অফিসার-কর্মীদের মুখোমুখি বসাচ্ছে সিবিআই। আর সুদীপ্তের সঙ্গে তাঁর ছেলে শুভজিৎ সেনকে বসিয়ে জেরা করতে চাইছে অন্য কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি। শুভজিৎকে নোটিসও দিয়েছে তারা। ইতিমধ্যে ওড়িশার কয়েকটি মামলায় সুদীপ্তকে নিজেদের হেফাজতে নেওয়ার জন্য খুরদা আদালতে আবেদন করেছে ইডি। আদালত তা মঞ্জুরও করেছে। ট্রানজিট রিম্যান্ডে সুদীপ্তকে ওড়িশায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। রথের পরেই ওড়িশায় বাবা-ছেলেকে একসঙ্গে পাওয়া যাবে বলে আশা করছে ইডি। তারা সারদার আরও ৭০টি নতুন অ্যাকাউন্টের সন্ধান পেয়েছে। সেগুলি কয়েক মাস আগেও সক্রিয় ছিল বলে তদন্তকারীদের দাবি। ইডি-র ধারণা, বেনামে সারদার আরও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকতে পারে। এর আগের দফার জেরায় শুভজিৎ ইডি-কে বলেছেন, ওড়িশার লগ্নিকারীদের অনেক টাকা অন্যত্র সরানো হয়েছে। সেটা যাচাই করার জন্য বাবা-ছেলেকে মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করা দরকার বলে মনে করছে ইডি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sarada scam sudipto sen kunal ghosh cbi probe
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE