Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

ঠাকুরবাড়িতে পুলিশ, কোন্দলে অস্বস্তি তৃণমূলে

বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, মতুয়াদের ঠাকুরবাড়িতে পারিবারিক কোন্দলের মাত্রা ততই চড়ছে! এ বার কোন্দল বেড়েছে মতুয়া মহাসঙ্ঘের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে। বিবাদের দু’প্রান্তে মতুয়া ঠাকুরবাড়িরই দু’পক্ষ সদ্যপ্রয়াত কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরের স্ত্রী এবং অন্য দিকে কপিলেরই ভাই মঞ্জুলকৃষ্ণ ও তাঁর দুই ছেলে। বিবাদ ফের গড়িয়েছে থানা-পুলিশ পর্যন্ত। ঠাকুরবাড়িতে বসাতে হয়েছে পুলিশ পিকেটও!

গাইঘাটা থানায় অভিযোগ জানিয়ে বেরিয়ে আসছেন কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরের স্ত্রী মমতাবালা। মঙ্গলবার নির্মাল্য প্রামাণিকের তোলা ছবি।

গাইঘাটা থানায় অভিযোগ জানিয়ে বেরিয়ে আসছেন কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরের স্ত্রী মমতাবালা। মঙ্গলবার নির্মাল্য প্রামাণিকের তোলা ছবি।

সীমান্ত মৈত্র
গাইঘাটা শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৫৭
Share: Save:

বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, মতুয়াদের ঠাকুরবাড়িতে পারিবারিক কোন্দলের মাত্রা ততই চড়ছে! এ বার কোন্দল বেড়েছে মতুয়া মহাসঙ্ঘের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে। বিবাদের দু’প্রান্তে মতুয়া ঠাকুরবাড়িরই দু’পক্ষ সদ্যপ্রয়াত কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরের স্ত্রী এবং অন্য দিকে কপিলেরই ভাই মঞ্জুলকৃষ্ণ ও তাঁর দুই ছেলে। বিবাদ ফের গড়িয়েছে থানা-পুলিশ পর্যন্ত। ঠাকুরবাড়িতে বসাতে হয়েছে পুলিশ পিকেটও!

কপিলকৃষ্ণ ছিলেন মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি এবং বনগাঁর তৃণমূল সাংসদ। তাঁর মৃত্যুতে মহাসঙ্ঘের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে মতুয়া সম্প্রদায়ের উপরে প্রভাব ধরে রাখতেই সচেষ্ট হয়েছে দুই শিবির। আপাতদৃষ্টিতে এই বিবাদ পারিবারিক হলেও রাজনীতির সঙ্গে তার সম্পর্ক একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কপিলকৃষ্ণের মৃত্যুতে বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন আসন্ন। রাজ্য জুড়ে একের পর এক ঘটনায় শাসক দল যখন কোণঠাসা, মতুয়া ভোটই হতে পারত বনগাঁয় তৃণমূলের তাস। মতুয়া মহাসঙ্ঘের নিয়ন্ত্রণ হাতে রাখতে পারলে তৃণমূলের টিকিট পাওয়ার দৌড়েও এগিয়ে থাকা যাবে, এই অঙ্কেই ঠাকুরবাড়ির অন্দরের বিবাদকে ব্যাখ্যা করছেন মতুয়াদের একাংশ।

একই সঙ্গে তাঁদের বড় অংশ ঠাকুরবাড়িতে এমন কাজিয়ায় বিরক্তও। কেউ কেউ মনে করছেন, মতুয়া ভাবাবেগের সঙ্গে রাজনীতি জড়িয়ে গিয়ে বিষয়টির তিক্ততা যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে মতুয়া সম্প্রদায়ের উপরে সার্বিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ কমে আসছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই। আর তারই জেরে বিজেপি এ বার মতুয়া ভাবাবেগেও ভাগ বসাতে পারে। যে হেতু মতুয়াদের নাগরিকত্ব-সহ মূল দাবিদাওয়ার সঙ্গে আদর্শগত ভাবে বিজেপি-র মিলই বেশি। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে তৃণমূল নেতৃত্বও এখন দূরত্ব রেখে চলছেন ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে।

গত কয়েক দিন ধরে গাইঘাটায় দু’টি প্রচারপত্র হাতে হাতে ঘুরছে। একটিতে ‘সর্বভারতীয় মতুয়া মহাসঙ্ঘে’র নামে ৪-৫ নভেম্বর কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। যা প্রচারিত হচ্ছে প্রয়াত কপিলের স্ত্রী মমতাবালার নামে। আবার ‘সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘে’র তরফে মঞ্জুলকৃষ্ণের বড় ছেলে সুব্রত ঠাকুরের নামে ৬ নভেম্বর সঙ্ঘের কমিটি গঠনের কথা জানানো হয়েছে। দু’ধরনের লিফলেট পেয়ে বিভ্রান্ত মতুয়া ভক্তেরাও!

এরই মাঝে সোমবার রাত ১২টা নাগাদ কিছু অনুগামীকে নিয়ে গাইঘাটা থানায় হাজির হন মমতাবালা। মঞ্জুলের দুই ছেলে সুব্রত ও শান্তনুর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগে জানান, দলবল নিয়ে দু’ভাই চড়াও হয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে। মতুয়া ভক্তদের নিয়ে ঠাকুরবাড়িতে তাঁর মঙ্গল ও বুধবারের ধর্মীয় অনুষ্ঠান বানচাল করতেই সোমবার সন্ধ্যায় শ’দেড়েক দুষ্কৃতীকে নিয়ে মঞ্জুলের দুই ছেলে সেখানে চড়াও হন বলে তাঁর অভিযোগ। মহিলা মতুয়া ভক্তদের গালিগালাজ করা হয়। প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয় মমতাবালা ও তাঁর দুই মেয়েকে। তিনি যাতে নিরাপদে শ্বশুরবাড়িতে থাকতে পারেন এবং ভক্তদের নিয়ে ধর্মাচরণ করতে পারেন, তার জন্য নিরাপত্তার দাবি জানান মমতাবালা। রাত দেড়টা নাগাদ তাঁকে পুলিশি নিরাপত্তায় পৌঁছে দেওয়া হয় ঠাকুরবাড়িতে। পুলিশ পিকেটের মধ্যেই এ দিন ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়েছে।

মমতাবালা বলেন, “আমাকে খুনের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। শ্বশুরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হবে বলেও শাসানো হচ্ছে। নিরাপত্তার অভাব বোধ করছি।” তাঁর বড় মেয়ে চন্দ্রলেখার বক্তব্য, “সোমবার সন্ধ্যায় মেয়েদের নোংরা ভাষায় গালিগালাজ করা হয়েছে। মতুয়া ভক্তদের রান্নাবান্নার জন্য উনুন ভেঙে দিয়ে গিয়েছে ওরা। আমাদের মহারাষ্ট্রে চলে যেতে বলা হচ্ছে।” প্রত্যাশিত ভাবেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সুব্রত ও তাঁর বাবা মঞ্জুল। সুব্রত বলেন, “গোটাটাই অপপ্রচার। মুখ্যমন্ত্রী ও পুলিশের কাছে এর পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি জানাচ্ছি।” তাঁর আরও বক্তব্য, “কেউ কেউ ঠাকুরবাড়িকে দ্বিখণ্ডিত করতে চাইছে। ঠাকুরবাড়িকে ঢাল করে স্বার্থসিদ্ধি করতে চাইছে।”

এই সঙ্গেই বিবাদ কদর্য চেহারাও নিয়েছে। জ্যেঠিমা মমতাবালা সম্পর্কে সুব্রতের মন্তব্য, “শুনেছি উনি তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণি পাস। আসলে বিদ্যা না থাকলে বুদ্ধিও হয় না! কেউ কেউ ওঁকে ভুল বোঝাচ্ছে।” রাজ্যের মন্ত্রী মঞ্জুল বলেছেন, “সস্তার প্রচার পেতে অপবাদ দেওয়া হচ্ছে। আমাদের দায় পড়েনি কাউকে তাড়াব।” মমতাবালাদের পাল্টা চাপে রাখতে মঞ্জুল এমনও বলেছেন, “মতুয়া ভক্তদের অনেকে বলছেন, শেষ সময়ে দাদার (কপিল) ঠিকমতো চিকিৎসা হয়নি। ওঁর মৃত্যু নিয়ে রহস্য আছে! খতিয়ে দেখার দাবি উঠছে।”

পারিবারিক এই কোন্দলের চোটে উপনির্বাচনে ঠাকুরবাড়ির কাউকে আদৌ টিকিট দেওয়া হবে কিনা, তা-ও এখন ভাবনাচিন্তা করে দেখা হচ্ছে তৃণমূলে। তবে দলের একাংশের মতে, কপিলের জীবদ্দশাতেই ভাই মঞ্জুলের সঙ্গে তাঁর তিক্ততা যে পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তাতে এখন এমন ঘটনা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। যদিও তাতে অস্বস্তি থাকছে তৃণমূলেরই। দু’পক্ষকে সঙ্গে নিয়েছিল তো তারাই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE