Advertisement
E-Paper

তিথির হেরফেরে একাকার আনন্দ-বিষাদ

দশমী, কিন্তু দশমী নয়! আবার এটাও ঠিক যে, দু’-দু’দিন দশমী! এ বার পুজোর তিথি-নির্ঘণ্ট নিয়ে জনমানসে বিভ্রান্তি রয়েছে। আজ, শুক্রবার দশমী— জানাচ্ছে বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা। কিন্তু দৃকসিদ্ধ পঞ্জিকার মতে, বৃহস্পতিবারেই নবমী আর দশমী পরপর। পঞ্জিকাকারদের দু’টি শিবিরের এই দুই বিধানে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত।

শিবাজী দে সরকার ও কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৫ ০১:৪৭
সিঁদুর খেলা। উত্তর কলকাতায় দাঁ-বাড়ির পুজোয়। বৃহস্পতিবার প্রদীপ আদকের তোলা ছবি।

সিঁদুর খেলা। উত্তর কলকাতায় দাঁ-বাড়ির পুজোয়। বৃহস্পতিবার প্রদীপ আদকের তোলা ছবি।

দশমী, কিন্তু দশমী নয়! আবার এটাও ঠিক যে, দু’-দু’দিন দশমী!

এ বার পুজোর তিথি-নির্ঘণ্ট নিয়ে জনমানসে বিভ্রান্তি রয়েছে। আজ, শুক্রবার দশমী— জানাচ্ছে বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা। কিন্তু দৃকসিদ্ধ পঞ্জিকার মতে, বৃহস্পতিবারেই নবমী আর দশমী পরপর। পঞ্জিকাকারদের দু’টি শিবিরের এই দুই বিধানে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত। তাঁরা দেখছেন, সময়ের মাপে মহোৎসবে এ বার আনন্দভৈরবীর তুলনায় বিষাদের পালা-ই যেন বেশি জায়গা পেয়েছে।

বৃহস্পতিবার দুপুর পেরোতেই তাই ঢাকের বাজনায় বিসর্জনের ছন্দ। ‘ঠাকুর থাকবে কত ক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন...। বেলা গড়াতেই বহু বাড়ির ঠাকুর ধরেছে গঙ্গার পথ। অনেক বাড়ি, আবাসন তো বটেই, এমনকী কিছু বারোয়ারি পুজোর প্রতিমাও এ দিন ভাসান দেওয়া হয়েছে। তার বিপরীতে মহানগরের অনেক মণ্ডপ আলো করে রয়েও গিয়েছে প্রতিমা।

বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা অনুযায়ী আজ, শুক্রবার দশমী হলেও কলকাতার পথেঘাটে কিন্তু দশমীর আমেজ তেমন থাকবে না। কারণ, মহরমের জন্য শুক্র ও শনিবার প্রতিমা বিসর্জনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে রাজ্য সরকার। তাই রাস্তা জুড়ে আলো আর বাজনার স্রোতে দুর্গা বিসর্জনের ছবি দেখা যাবে না এই দু’দিন। ভাসানের বিষাদ-সুর নিশ্চয়ই বাজবে মনে, কাজকর্মে, জটলাতেও। কিন্তু সপরিবার দুর্গাকে থাকতে হবে মণ্ডপবন্দি হয়েই। সেই সমস্যা এড়াতে মনের কষ্ট মনে পুষে রেখে অনেকেই জলযাত্রায় পাঠিয়ে দিয়েছেন ঠাকুরকে।

নবমী-দশমীর বিভ্রান্তির মধ্যে এ দিন দুপুর থেকেই গা এলিয়ে দেন বহু পুজো কমিটির কর্মকর্তারা। আগের ক’টা দিনের মতো সকাল হতেই রাস্তায় রাস্তায় মানুষের ঢলও তেমন ছিল না। গুটিগুটি পায়ে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরেছেন কিছু দর্শক। তবে তাঁদের চলনে-বলনেও যেন উৎসব শেষের এলায়িত ভঙ্গি। উত্তর কলকাতার একটি মণ্ডপের বাইরে দেখা গেল, চেয়ার পেতে গা এলিয়ে গল্পে মশগুল পুজো কমিটির কিছু সদস্য। তাঁদেরই এক জনের কথায়, ‘‘শরীরটা আর দিচ্ছে না। গত ক’দিন তো কার্যত বাড়িমুখোই হইনি!’’

বেলা ১টা। দক্ষিণ কলকাতার একটি মণ্ডপের বাইরে বেলা ১১টাতেই দুপুরের খাবারের তালিকা নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। পাশের পাড়ার মণ্ডপ তখন স্বেচ্ছাসেবকহীন। জানা গেল, মহাষ্টমীর জনজোয়ার সামলে এ দিন সকালে বাড়ি গিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক তরুণ-তরুণীরা। দুপুরে জনতার ঢল না-নামায় পুজো কমিটির কর্তারাও আর ডেকে পাঠাননি ওঁদের। এক কর্তা বললেন, ‘‘ষষ্ঠী থেকে ভিড় সামলেছে। এ বার ওরা একটু জিরিয়ে নিক।’’

দুপুর থেকেই এ দিন শহরের বিভিন্ন পুজোয় ‘গেট টুগেদার’ শুরু হয়ে যায়। কোথাও খিচুড়ি, বেগুনি, পনিরের তরকারি, পায়েসের ঢালাও আয়োজন। কোথাও আবার পাড়ার লোকেরা একসঙ্গে রুই-পমফ্রেটের পঙ্‌ক্তিভোজে মেতেছেন। নবমীতে ‘ছাপান্ন ভোগ’ হয় উত্তর কলকাতার একটি পুজোয়। সেই পুজোর সামনে বিরাট বাড়ি জুড়ে পুরি, কচুরি, আলুর দম, দইবড়া, জিলিপি ইত্যাদিতে মজেছেন কমিটির সদস্য-অতিথিরা।

নবমীর দুপুরের এই ঢিলেঢালা মেজাজটা অবশ্য বেশি ক্ষণ স্থায়ী হয়নি। সূর্য পাটে ঢলতেই উৎসবের পোশাকে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন লোকজন। নগরের রাস্তায় কিছুটা ফিকে হয়ে গেল বিষাদের সুর। পাড়ার পঙ্‌ক্তিভোজ শেষ করে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা পুজো-কর্তা সবে বাড়ির পথ ধরেছিলেন। খবর এল, মণ্ডপে ভিড় শুরু হয়ে গিয়েছে। সামাল দেওয়ার লোক নেই। বাড়ি যাওয়া বাতিল করে মোবাইলে স্বেচ্ছাসেবকদের ছুটে আসার তাগাদা দিতে দিতে মণ্ডপের দিকে ছুট লাগালেন কর্তাটি।

বিকেল ৪টে। সবে পুজোর ডিউটি শুরু করেছিলেন এক পুলিশ অফিসার। ভিড় না-দেখে ফোনে এক পরিচিতকে বলছিলেন, ‘‘নবমী-দশমীর বিভ্রান্তিতে আজ মনে হয় লোকজন তেমন হবে না।’’ সন্ধ্যা ৬টায় দেখা গেল, গড়িয়াহাটের কাছে ওয়াকিটকি হাতে গাড়ি আর ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন সেই অফিসারই। পুলিশ বলছে, সন্ধ্যা পেরোতে না-পেরোতেই সুরুচি সঙ্ঘ, হরিদেবপুর, সেলিমপুর, বাবুবাগান, হিন্দুস্থান পার্ক, একডালিয়ায় জনজোয়ার শুরু হয়ে যায়। ফলে গাড়ি চলাচল থমকে যায় ওই সব এলাকায়। দেশপ্রিয় পার্কে ‘ভিউ কাটার’ লাগালেও অর্থাৎ প্রতিমা ঢেকে দেওয়া হলেও লোকজন পর্দার ফাঁক দিয়েই উঁকিঝুঁকি মেরেছেন সমানে। দক্ষিণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধীরে ধীরে ভিড়ের ঢল নামে উত্তরেও। নবমী নিশিতেও ভিড় টেনেছে বাগবাজার সর্বজনীন। উল্টোডাঙা স্টেশন, শ্যামবাজার মোড় থেকে দলে দলে লোক রওনা দিয়েছেন মণ্ডপে। কেউ গিয়েছেন হাতিবাগানের পুজোয়, কেউ বা তেলেঙ্গাবাগান, করবাগান, পল্লিশ্রী দেখে এগিয়ে গিয়েছেন মানিকতলার দিকে।

সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। কুমোরটুলি পার্কের মণ্ডপে দলে দলে লোক ঢুকছেন। ভিড় সামলাতে পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবী হ্যাম রেডিও অপারেটরের দল হিমশিম খাচ্ছে। আহিরীটোলা এলাকার এক মণ্ডপ থেকে অন্য মণ্ডপে জনতার ঢল আছড়ে পড়ছে। বিভিন্ন বাড়ির প্রতিমা নিয়ে গঙ্গামুখী গাড়িও তখন নেমে পড়েছে রাস্তায়। ভিড় ও গাড়ি সামলাতে পুলিশের পাশাপাশি ফের ব্যস্ত হয়ে উঠলেন পুজো-কর্তারা। সপ্তমী, অষ্টমীতে সকাল ১০টা থেকেই গাদাগাদি ভিড় নিয়ে শিয়ালদহে ঢুকছিল বিভিন্ন লাইনের লোকাল। এ দিন সকালে সেই দৃশ্য চোখে পড়েনি। সন্ধ্যায় কিন্তু শিয়ালদহে ফের সেই পুজোপাগল জনতার স্রোত। সেই ভিড় আছড়ে পড়েছে সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার, কলেজ স্কোয়ার, মহম্মদ আলি পার্কে।

বিকেল থেকে ভিড় উপচে পড়ে মেট্রোতেও। বিশেষ করে নেতাজি ভবন, যতীন দাস পার্ক, কালীঘাট, রবীন্দ্র সরোবর, টালিগঞ্জ স্টেশনে ভিড় উগরে দিয়েছে মেট্রো। সেই ভিড় পাড়ি দিয়েছে ভবানীপুর, চেতলা, গড়িয়াহাট, নিউ আলিপুর, হরিদেবপুর, বেহালার দিকে। এ বারেই প্রথম পুজোর ডিউটিতে নামা এক সার্জেন্টকে দেখা গেল, বেহালার ভিড় সামলাতে গিয়ে ঘেমেনেয়ে একশা। ওই এলাকায় বড়িশা, নূতন দল, বেহালা ক্লাব, জনকল্যাণের মতো পুজোর পাশাপাশি নতুন নতুন পুজো উঠে এসেছে। সব মিলিয়ে শহরের ভিড়ের একটা বড় অংশ পাক খাচ্ছে সেখানে। ঠাকুরপুকুরের এসবি পার্ক কিংবা ঠাকুরপুকুর ক্লাবের মণ্ডপও ভিড় টেনেছে বিস্তর।

বিকেলে পুজোর ডিউটিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন গড়িয়া মিতালি সঙ্ঘের কর্তা। ক্লাবের এক সদস্যের কাছ থেকে ফোন পেয়ে জানতে পারলেন, মণ্ডপে ভিড় জমতে শুরু করেছে। গাড়ি নিয়ে কর্তাটি সোজা ছুটলেন কালীঘাট থানার দিকে। পথেই ফোন করে জানতে শুরু করলেন, ‘‘বাদামতলা আষাঢ় সঙ্ঘ ও ৬৬ পল্লিতে ভিড়ের সংখ্যা কত?’’ গড়িয়া মিতালি দেখে ভিড় ঢুকেছে নাকতলা উদয়ন, বাঁশদ্রোণী খেয়ালি সঙ্ঘের দিকে। নেতাজি জাতীয় সেবাদলের সামনে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন গৌরাঙ্গ দাস। সামনে এক বাঁশিওয়ালাকে পেয়ে ‘শিশু’ হয়ে উঠলেন তিনি। ১০ টাকায় ভেঁপু কিনে বন্ধুদের কান ঝালাপালা করে দিলেন!

রাত ১২টাতেও পার্ক সার্কাস ময়দানের ফুচকাওয়ালার সামনে তরুণীর মেলা। যাদবপুর মোড়ে ভিড় পার করাতে ব্যস্ত পুলিশ। মাঝরাতেও কালীঘাট মেট্রোর কাউন্টারে রেলকর্মী দম ফেলার সময় পাচ্ছিলেন না!

নবমী আর দশমীর এমন গলা জডাজড়ি করা রাত খুব কমই মেলে। উৎসব শেষের আনন্দ আর বিষাদ উপচে পড়ল সেই রাত্রির পাত্রে।

abpnewsletters
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy