Advertisement
E-Paper

দুই পড়শির মামলায় ঝুলছে সারদার রায়

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জমা দেওয়া হলুদ খাম খুলে অসমের এক রাজনৈতিক নেতার নাম উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্ট জানতে চেয়েছিল, ওই ব্যক্তিকে কেন গ্রেফতার করা হল না? সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন রাজ্যের কৌঁসুলি। তাঁর আর্জি, খামের বাকি নামগুলো যেন আদালতকক্ষে পড়া না-হয়। বিচারপতিরা আর্জি মানলেন। সারদা-মামলায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার শীর্ষ আদালতে যে গোপন রিপোর্ট জমা দিয়েছে, তা ঘিরে জল্পনা তুঙ্গে।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:২৭

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জমা দেওয়া হলুদ খাম খুলে অসমের এক রাজনৈতিক নেতার নাম উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্ট জানতে চেয়েছিল, ওই ব্যক্তিকে কেন গ্রেফতার করা হল না? সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন রাজ্যের কৌঁসুলি। তাঁর আর্জি, খামের বাকি নামগুলো যেন আদালতকক্ষে পড়া না-হয়। বিচারপতিরা আর্জি মানলেন।

সারদা-মামলায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার শীর্ষ আদালতে যে গোপন রিপোর্ট জমা দিয়েছে, তা ঘিরে জল্পনা তুঙ্গে। কোন কোন রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের কর্তারা সারদা সংস্থার থেকে আর্থিক ভাবে লাভবান হয়েছেন, রাজ্যের কাছে সে সংক্রান্ত তথ্য চেয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। আজ খামে ভরে তা জমা দেওয়া হয়। সেই তালিকা থেকে অসমের রাজনীতিক মাতঙ্গ সিংহের নামটি শুধু পড়েছিলেন বিচারপতিরা। রাজ্যের আর্জির জেরে বাকি নামগুলো আপাতত আড়ালেই থাকল।

ক্লিক করুন....

মামলার শুনানি আজ শেষ হয়ে গেলেও, রায় অবশ্য হয়নি। তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ২৩ এপ্রিল, অর্থাত্‌ পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয় দফার ভোটের আগের দিন পর্যন্ত। কেন?

কারণ, সারদা-কাণ্ডে সিবিআই-তদন্ত হবে কি না, পড়শি দুই রাজ্য ওড়িশা ও অসমের বক্তব্য শুনে তা ঠিক করা হবে বলে সুপ্রিম কোর্ট আজ ইঙ্গিত দিয়েছে। অসম ইতিমধ্যে সারদা-কাণ্ডে সিবিআই-তদন্তের সুপারিশ করেছে। ওড়িশায় সারদা-সহ বিভিন্ন অর্থলগ্নি সংস্থার প্রতারণার তদন্তে সিবিআই চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয়েছে। এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য সরকারের বক্তব্য শুনতে চেয়েছে। আবার একাধিক রাজ্যে সারদা সংস্থার জাল ছড়িয়ে থাকায় ওড়িশা পুলিশের সমস্যা হচ্ছে কি না, সুপ্রিম কোর্ট তা-ও জানতে চেয়েছে। শীর্ষ আদালত আজ জানিয়েছে, দুই রাজ্যের কাছ থেকে এ সব ব্যাপারে মতামত পাওয়ার পরেই সারদা-কাণ্ড নিয়ে তারা চূড়ান্ত রায় দেবে।

আর তারই শুনানি হবে আগামী ২৩ এপ্রিল। এ দিনের শুনানিতে সারদা-কাণ্ডের ‘সুবিধাভোগী’ কয়েক জনের নাম উঠে এলেও তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতা বলতে শুধু মাতঙ্গ সিংহ। বৈদ্যনাথন আদালতকে জানান, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এক পদস্থ কর্তা, কোম্পানি নিবন্ধকের এক কর্তা এবং শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবি-র তিন কর্তার নাম এসেছে। রাজ্যের অভিযোগ, এক দালাল মারফত প্রায় দু’বছর ধরে তাঁদের মাসে-মাসে ৭০ লক্ষ টাকা দেওয়া হতো। সেবি-র কর্তাদের জেরা করা হয়েছে। আরবিআই অফিসারটি ইতিমধ্যে অবসর নিয়েছেন, তাঁরও বয়ান নেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ চার বছর ধরেও টাকা নিয়েছে বলে রাজ্যের দাবি।

আজকের শুনানিতে তৃণমূলের ধৃত সাংসদ কুণাল ঘোষের নামও উঠেছে। রাজ্য পুলিশের তদন্তে অভিযুক্ত কুণালবাবুর তরফে আদালতকে জানানো হয়, তাঁকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জবানবন্দি দিতে দেওয়া হচ্ছে না, এবং তিনি নিজেও সিবিআই-তদন্ত চান। বিচারপতি জানান, কুণাল চাইলে সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়েই সব জানাতে পারেন। সারদা সংস্থার আর এক কর্তা সোমনাথ দত্তের তরফেও এ দিন অভিযোগ তোলা হয়, পুলিশ তাঁকে হেনস্থা করছে। সারদা সংস্থায় কুণালবাবুর বেতন কত ছিল, বিচারপতিরা তা জানতে চাইলে তাঁর কৌঁসুলি বলেন, “মাসে ১৫ লক্ষ টাকা।” সারদায় যোগ দেওয়ার আগে কত বেতন ছিল? আদালতের প্রশ্ন শুনে জবাব আসে, “এক লক্ষ টাকা।” বিচারপতি বিস্মিত হয়ে বলেন, “এক লক্ষ থেকে একেবারে ১৫ লক্ষ!”

পাশাপাশি বিচারপতিরা আজ জানতে চেয়েছিলেন, সারদার মতো অর্থলগ্নি সংস্থার কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কাদের হাতে? সেবি, কোম্পানি নিবন্ধক বা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কেন ঠিক সময়ে পদক্ষেপ করেনি? সেবি যুক্তি দেয়, সারদা যে প্রক্রিয়ায় অর্থ সংগ্রহ করছিল, তা সেবি-র আওতায় পড়ে না। দেখভালের দায়িত্ব ছিল রাজ্য সরকারের। রাজ্যের কৌঁসুলির পাল্টা যুক্তি, রাজ্য জানানোর পরে সেবি সারদার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিল। এমনকী, ২০১৩-র ২৩ এপ্রিল সেবি সারদার বিরুদ্ধে নির্দেশও দিয়েছে। দু’পক্ষের চাপান-উতোর শুনে বিচারপতি ঠাকুরের মন্তব্য, “এ তো মনে হচ্ছে, আপনারা ঘুমোচ্ছিলেন, কেউ এসে আপনাদের জাগিয়ে দিয়েছে! আপনারা ঘুম থেকে উঠে একটা নির্দেশ দিয়েছেন। যারা টাকা লুঠ করছিল, তাদের থেকে আপনাদের অপরাধও তো কম নয়!”

কোম্পানি নিবন্ধক ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছেও তাদের ভূমিকা জানতে চায় আদালত। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানায়, সারদা আসলে আইনত ভাবে চিট ফান্ড চালানোর আড়ালে বেআইনি ভাবে টাকা তুলছিল। শুনে বিচারপতি ঠাকুর বলেন, “রিজার্ভ ব্যাঙ্কেরই দায়িত্ব ছিল আড়ালটা সরিয়ে দেওয়ার। তদন্তে আপনারা হয় সাক্ষী হবেন, নয়তো অভিযুক্ত হবেন।”

তবে সেবি বা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দায়িত্ব এড়িয়েছে কি না, সেটা যে মামলার বিচার্য বিষয় নয়, শীর্ষ আদালত তা স্পষ্ট করে দিয়েছে। আসল প্রশ্ন হল, রাজ্য পুলিশ সার্বিক ভাবে তদন্ত করছে কি না। সারদার আর্থিক কেলেঙ্কারির নেপথ্যে থাকা ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের’ ফসল কারা ওঠাল, তার ঠিকঠাক তদন্ত হল কি না, সুপ্রিম কোর্ট সেটাই বুঝতে চাইছে। রাজ্য সরকারের উদ্দেশে বিচারপতি ঠাকুরের প্রশ্ন, “কেন এক অবসরপ্রাপ্ত রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফিসারের বিবৃতি নিয়েই পুলিশ হাত গুটিয়ে বসে রইল? হতে পারে, ওই ব্যক্তি আসলে হিমশৈলের চুড়ো! আরও উঁচু দরের কর্তারাও জড়িত থাকতে পারেন!” বৈদ্যনাথন বলেন, “রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ওই কর্তা গোটা পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি কতটা বেআইনি কাজ করেছেন, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।” বিচারপতির মন্তব্য, “এই সব বিষয়ই তদন্ত হওয়া উচিত।”

এবং এর পরেই রাজ্যের কাছে সুপ্রিম কোর্ট শেষ বারের মতো জানতে চায়, সারদা-কাণ্ডে কেন সিবিআই-তদন্ত হবে না?

রাজ্যের কৌঁসুলি যুক্তি দেন, এ যাবত্‌ সুপ্রিম কোর্টের সব রায়েই বলা হয়েছে, রাজ্য সরকারের তদন্তে গাফিলতি থাকলে তবেই সিবিআইকে ভার দেওয়া হয়। তাঁর দাবি, এ ক্ষেত্রে রাজ্যের তদন্তে কোনও গাফিলতি মেলেনি। বৃহত্তর ষড়যন্ত্র, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির ব্যর্থতা, রাজনৈতিক যোগাযোগ নিয়ে তদন্ত হয়েছে, ফরেন্সিক তদন্তও হয়েছে। কাউকে আড়াল করার চেষ্টা হয়নি। হাইকোর্ট তদন্তে নজরদারি করেছে। উপরন্তু সিবিআইয়ের ‘নিরপেক্ষতা’ সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে বৈদ্যনাথনের বক্তব্য, “গত কালই গোপালকৃষ্ণ গাঁধী সিবিআইয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে সিবিআই’কে ডিপার্টমেন্ট অফ ডার্টি ট্রিকস হিসেবে অভিহিত করেছেন। মায়াবতী, মুলায়ম, লালুপ্রসাদের বিরুদ্ধে তদন্তে সিবিআই বহু বার আদালতে অবস্থান বদলে ফেলেছে। এমনকী, সিবিআই-প্রধান নিজেই বলছেন, তিনি আরও স্বাধীনতা চান!”

এমতাবস্থায় সিবিআইকে ডাকলে পুরো তদন্ত প্রক্রিয়া বিলম্বিত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন রাজ্যের কৌঁসুলি। অন্য দিকে পাল্টা যুক্তিতে সিবিআই-তদন্তের আবেদনকারীদের কৌঁসুলি বিকাশ ভট্টাচার্য প্রশ্ন তোলেন, “সারদা-কাণ্ডে যারা লাভবান হয়েছে, তাদের নাম কেন গোপন রাখা হচ্ছে? মানুষ জানুক, কারা তাঁদের টাকা লুঠ করেছে।”

বিকাশবাবুর অভিযোগ, “আসলে সারদার মিডিয়া সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে। কুণাল ঘোষ সেই কাজ করেছিলেন বলেই তাঁকে সাংসদ করা হয়েছিল। এখন সুদীপ্ত সেন গ্রেফতার হয়ে যাওয়ার পরেও বেশ কিছু সংবাদ মাধ্যম চলছে। লাভবানরাই সেগুলো চালাচ্ছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে।”

এ সবের বিশদ তদন্তের স্বার্থেই সিবিআই’কে ডাকা জরুরি বলে যুক্তি পেশ করেন বাদীপক্ষের কৌঁসুলি।

সুদীপ্তর ছেলে, বৌ গ্রেফতার
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা

সারদা কাণ্ডে এ বার সুদীপ্ত সেনের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী ও প্রথম পক্ষের ছেলেকে গ্রেফতার করল কেন্দ্রীয় সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। ‘প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং’ আইনে বুধবার দুপুরে বেহালার অজন্তা সিনেমা হলের কাছ থেকে সুদীপ্ত সেনের ছেলে শুভজিত্‌ সেনকে (৩৪) ধরা হয়। আর বাগুইআটির একটি ফ্ল্যাট থেকে ধরা পড়েন সুদীপ্তর স্ত্রী পিয়ালী সেন (৪৫)। সুদীপ্তর প্রথম স্ত্রী মধুমিতাকে খোঁজা হচ্ছে বলেও ইডি জানিয়েছে। বাগুইআটির ফ্ল্যাটে দুই ছোট ছেলেমেয়ের সঙ্গে পিয়ালী থাকতেন। তাঁর কাছ থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি পাওয়া গিয়েছে। পুলিশের দাবি, প্রধানত ব্যাঙ্কের লকার সংক্রান্ত বেশ কিছু কাগজপত্র রয়েছে পিয়ালীর কাছে। শুভজিত্‌ ও পিয়ালী দু’জনেই সারদা গোষ্ঠীর অন্যতম ডিরেক্টর ছিলেন। বিরোধী দলগুলি এর আগে এঁদের দু’জনকে গ্রেফতারের দাবি তুলেছিল। বুধবার রাত পর্যন্ত এই দু’জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আরও কিছু তথ্য ও নথি পাওয়ার চেষ্টা করেন ইডি অফিসারেরা।

sarada supreme court sudipta sen
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy