মহিষদার বাড়িতে শক্তিপদ অধিকারী।—নিজস্ব চিত্র।
ঘরের ছেলে পর হয়েছে।
গাঁ ছেড়ে টলিউডি চাঁদের পাহাড়ে চড়তে যাওয়া তবু ঠিক ছিল। তা বলে একেবারে তৃণমূলে!
যাকে বলে, ধর্মসঙ্কটে পড়ে গিয়েছে মহিষদার অধিকারী পরিবার। গোটা বাংলা যাঁকে ‘দেব’ বলে চেনে, তিনি যে সেই বাড়ির ছেলে। ডাকনাম রাজু, ইস্কুলের নাম দীপক অধিকারী।
ঘাটাল লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থীর নাম ঘোষণা হতেই ফাঁপরে পড়ে গিয়েছেন অধিকারীরা। যাঁর কাকা সিপিএমের জোনাল সম্পাদক, যে গাঁয়ের বহু লোক এখনও মার্কস-লেনিন-জ্যোতি না জপে জল খান না, সেই ছেলেই কি না...। আবার দিদির দলে ভিড়েছে বলে একেবারে ফেলেও তো দিতে পারেন না!
পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুর থেকে কিলোমিটার পাঁচেক দূরে মহিষদা এককালে সিপিএমের শক্ত ঘাঁটি ছিল। সিপিএমের রাজ্যস্তরের নেতা তরুণ রায়, দাপুটে নেতা হীরালাল ভুঁইয়ারা এই গ্রামেরই মানুষ। মঙ্গলবার রাতেই কানাঘুষোয় বাড়িতে খবর গিয়েছিল, রাজু তৃণমূলের প্রার্থী হতে পারে। বুধবার দুপুরে খবরটা পাকা হওয়ার পরে বেশ কিছু ক্ষণ প্রতিক্রিয়াই জানাতে পারেননি দেবের জ্যাঠা, সিপিএমের কেশপুর জোনাল সদস্য শক্তিপদ অধিকারী। পরে কিছুটা সামলে নিয়ে গম্ভীর মুখে বলেন, “দলকে নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ। তবে পরিবারের সম্মানটা আগে। সেটা তো দেখতেই হবে।”
কর্তা যখন এ কথা বলছেন, তাঁর স্ত্রী দুর্গা অধিকারীর মুখে রা নেই। কিন্তু ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকা হাসিটুকুই বলে দেয়, ভাইপোর প্রতি স্নেহ ভোটের বাক্সে ঝরে পড়ল বলে! সকালেই মেদিনীপুর থেকে গ্রামের বাড়িতে এসেছেন তাঁর ছেলে সুজিত অধিকারী। তিনি পরিষ্কার বলে দেন “রাজনীতির অত কূটকচালিতে থাকতে চাই না। পরিবারের সম্মানই বড় কথা।” তাঁর স্ত্রী কৃষ্ণার কথায়, “রাজু বড় হয়েছে। যা ভালো বুঝেছে, করেছে।” সুজিতের দুই ছেলে কৌশিক আর শৌভিক তো জানিয়েই দেয়, তারা কাকুর সঙ্গে প্রচারে যাবে।
এ নয় গেল ঘরের কথা। কী বলছে মহিষদা?
বাসস্টপে দাঁড়িয়ে গ্রামের সঞ্জয় মেটারী, অশোক চক্রবর্তীরা হইহই জুড়ে দেন, “গ্রামের ছেলে ভোটে দাঁড়িয়েছে। সবাই তাকেই ভোট দেব। এতে আর এত ভাবার কী আছে?” নাম না জানিয়ে এক মহিলা আবার বলেন, “এত দিন তো সিপিএমকেই ভোট দিয়ে এসেছি। দেব সিপিএমের হয়ে দাঁড়ালেই খুশি হতাম। আবার গ্রামের ছেলে হিসেবে ওকেই ভোট দিতে ইচ্ছে করছে। যাই হোক, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরছে অবশেষে।”
দোকান-বাজারেও দিনভর একই আলোচনা। এক দল যখন আবেগে থইথই, গম্ভীর মুখে কেউ-কেউ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, গত বিধানসভা ভোটে কেশপুর বিধানসভায় সিপিএম প্রার্থী ৩০ হাজারেরও বেশি ভোটে জিতেছিলেন। সেই কেশপুর, ১৯৯৬ সালে লং রেঞ্জ রাইফেল, হাত কামান আর টানা আড়াই বছর ধরে চলতে থাকা হানাহানির দৌলতে যা দিনের পর দিন সংবাদ শিরোনামে এসেছে। কিন্তু ‘পাগলু’ বা ‘খোকাবাবু’র মহিষদা তত নাম বা দুর্নাম কোনওটাই কুড়োয়নি। গাঁয়ের ছেলের দৌলতে এই প্রথম তার গায়ে প্রচারের আলো।
কী বলছে সেই ঘাটাল?
আইনজীবী দেবপ্রসাদ পাঠক বন্দ্যোপাধ্যায় একগাল হেসে বলেন, “দেব জনপ্রিয় অভিনেতা। ওঁর বহু সিনেমা দেখেছি। আশা করি, জিতলে সিনেমার নায়কের মতোই ও দুর্নীতি রুখে উন্নয়নের কাজ করবে।” কলেজ-ছাত্রী সোমা মণ্ডলের কথায়, “আমি দেবের অন্ধ ভক্ত। সকাল থেকে লাইন দিয়ে ওকে ভোট দেব।”
দীপক অধিকারীর বিরুদ্ধে যিনি দাঁড়িয়েছেন, সিপিআইয়ের সেই জেলা সম্পাদক সন্তোষ রাণাও দেব-ভক্ত। তিনি বলেন, “চাঁদের পাহাড় আমার দেখা হয়নি। তবে দেবের সিনেমা আমার খুবই ভাল লাগে।” তার পরেই তিনি মনে করিয়ে দেন, “কিন্তু এটা ব্যক্তির সঙ্গে লড়াই নয়, রাজনীতির লড়াই। মানুষ যাঁকে পছন্দ করবেন, তিনিই জিতবেন।”
ভালবাসা চাঁদের পাহাড় থেকে গড়িয়ে ঘাটালের মাটিতে নামবে তো? দেব নিরুত্তর।
(সহ প্রতিবেদন: অভিজিৎ চক্রবর্তী)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy