Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ধরা পড়ে তড়িঘড়ি সাক্ষী হতে চান সুদীপ্তর ‘গুরু’

গা ঢাকা দিয়ে ছিলেন এত দিন। সিবিআইয়ের জালে পড়তেই তড়িঘড়ি এ বার সাক্ষী হতে চাইছেন সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের ‘গুরু’! হাওড়ার শিবনারায়ণ দাস। সিবিআইকে লেখা চিঠিতে তাঁঁকে ‘গুরু’ বলেই উল্লেখ করেছিলেন সুদীপ্ত। জানিয়েছিলেন, শিবনারায়ণের হাত ধরেই অর্থলগ্নি ব্যবসায় নেমেছিলেন তিনি। এই শিবনারায়ণ মাঝে যুক্ত হন সারদার সঙ্গে। পরে একটা সময় আবার সরে এসে নিজেই অর্থলগ্নি সংস্থা গড়েন।

আলিপুর আদালতে শিবনারায়ণ দাস। রবিবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী

আলিপুর আদালতে শিবনারায়ণ দাস। রবিবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:২০
Share: Save:

গা ঢাকা দিয়ে ছিলেন এত দিন। সিবিআইয়ের জালে পড়তেই তড়িঘড়ি এ বার সাক্ষী হতে চাইছেন সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের ‘গুরু’! হাওড়ার শিবনারায়ণ দাস। সিবিআইকে লেখা চিঠিতে তাঁঁকে ‘গুরু’ বলেই উল্লেখ করেছিলেন সুদীপ্ত। জানিয়েছিলেন, শিবনারায়ণের হাত ধরেই অর্থলগ্নি ব্যবসায় নেমেছিলেন তিনি। এই শিবনারায়ণ মাঝে যুক্ত হন সারদার সঙ্গে। পরে একটা সময় আবার সরে এসে নিজেই অর্থলগ্নি সংস্থা গড়েন। ইডি সূত্রের খবর, কয়েক জন্য সাক্ষীর বয়ান খতিয়ে দেখে তারা মনে করছে, শিবনারায়ণের ওই সংস্থা ও তার সহযোগী সংস্থার খাতায় গিয়ে জমা পড়েছে সারদার বেশ কিছু টাকা।

রবিবার আলিপুর আদালতে শিবনারায়ণকে পেশ করার পরে তাঁকে দশ দিনের জন্য নিজেদের হেফাজতে চেয়েছিল সিবিআই। ভারপ্রাপ্ত মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট সোমনাথ কুণ্ডু পাঁচ দিনের জন্য তাঁকে সিবিআই হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন।

শিবনারায়ণের আইনজীবীরা এ দিন আদালতে জানিয়েছেন, এই মামলায় তাঁদের মক্কেল সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হতে পারেন। যা শুনে তদন্তকারীদের একাংশ বলছেন, উনি যে সারদা কেলেঙ্কারির সম্পর্কে সব থেকে বেশি জানেন, সেটাই বেরিয়ে এসেছে তাঁর আইনজীবীদের কথায়। এক তদন্তকারীর বক্তব্য, “জালে ফেঁসেছেন, এটা বুঝেই এখন সাক্ষী হতে চাইছেন শিবনারায়ণ।”

যদিও এ ব্যাপারে আরও একটি প্রশ্ন উস্কে দিয়েছেন সিবিআইয়ের আইনজীবী পার্থসারথি দত্ত। রবিবার আদালতে তিনি অভিযুক্তকে অভিহিত করেন ‘হিরো অব দ্য হ্যামলেট’ নামে। শেক্সপিয়রের গল্পে হ্যামলেট এক ট্র্যাজিক হিরো, যে কিনা অনেকটাই পরিস্থিতির শিকার। তবে কি শিবনারায়ণের পিছনে আরও কিছু মাথা রয়েছে, এমনটাই বলতে চেয়েছেন সিবিআইয়ের আইনজীবী? পার্থসারথিবাবু বেশি ব্যাখ্যায় না গিয়ে শুধু জানান, সারদা কেলেঙ্কারির মূল ‘সূত্রধর’ বোঝাতে গিয়েই এই শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন তিনি।

সারদার টাকা কোথায় গেল এবং এই কেলেঙ্কারির পিছনে মূল ষড়যন্ত্রকারী কারা মূলত এই দু’টি প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজে চলেছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) ও সিবিআই। শিবনারায়ণকে হাতে পাওয়ার পরে এ বার ওই দু’টি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ক্ষেত্রে আরও এক ধাপ এগোনো যাবে বলেই আশা করছেন তদন্তকারীরা। সিবিআই অফিসারদের দাবি, সারদা কেলেঙ্কারির পিছনে অন্যতম ‘নাটের গুরু’ বা ‘সূত্রধর’ এই শিবনারায়ণ। এ বিষয়ে বেশ কিছু তথ্যও পেয়েছেন তদন্তকারীরা। সারদার টাকা পাচারেও তাঁর ভূমিকা রয়েছে বলে সন্দেহ করছেন তদন্তকারীরা। ইডি এ নিয়ে তদন্ত করবে বলে খবর।

আগামী পাঁচ দিনে শিবনারায়ণকে জেরা করে সিবিআই যে প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজবে, সেগুলির প্রথমটিই হল, সারদার টাকা পাচারে ও গোটা কেলেঙ্কারিতে শিবনারায়ণের কী ভূমিকা ছিল? তদন্তকারীরা এ-ও বোঝার চেষ্টা করবেন, শাস্তি কমাতেই কি তড়িঘড়ি সাক্ষী হতে চাইছেন শিবনারায়ণ? নাকি এর পিছনে অন্য অঙ্ক রয়েছে। এত দিন তাঁর গা ঢাকা দিয়ে থাকার পিছনে কি কোনও মহলের চাপ ছিল? সারদার টাকা পাচারের চক্রে শিবনারায়ণ ছাড়াও আর কারা রয়েছে?

তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, শিবনারায়ণ ও তাঁর নিজের সংস্থা ‘সিলিকন প্রোজেক্টস ইন্ডিয়া লিমিটেড’-এর সঙ্গে শুধু সারদা নয়, আরও কয়েকটি বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার যোগসাজশ খুঁজে পেয়েছেন তদন্তকারীরা। কী রকম?

সিবিআই সূত্রের খবর, সঞ্চয়িতার পরে এ রাজ্যে অর্থলগ্নি সংস্থার কারবারের অন্যতম মাথা এই শিবনারায়ণই। প্রথমে তিনি ছিলেন প্রয়াগ নামে একটি সংস্থায়। পরে সেখান থেকে সারদায় যোগ দেন। ২০০৮ সালে সুদীপ্তর সঙ্গে মিলে সারদা রিয়েলটি তৈরির পর সেই সংস্থায় যোগ দেন শিবনারায়ণ-ঘনিষ্ঠ কয়েক জন কর্মীও। সারদায় ৩ বছর ডিরেক্টর থাকার পরে ২০১১ সাল নাগাদ ‘সিলিকন প্রোজেক্টস ইন্ডিয়া লিমিটেড’ নামে নিজের সংস্থা খোলেন শিবনারায়ণ। সেই সংস্থা খোলার টাকা তিনি সারদা থেকে নিয়েছিলেন কি না, তা এখনও অস্পষ্ট সিবিআইয়ের কাছে।

তবে ইডি সূত্রের খবর, শিবনারায়ণ গ্রেফতার হওয়ার পরে কয়েক জন সাক্ষীর বয়ান পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, ২০১২ সালের শেষের তিন মাসে বিপুল টাকা সারদা থেকে সিলিকনে গিয়েছে। হাওড়ার অন্য একটি অর্থলগ্নি সংস্থাতেও গিয়েছে সারদার টাকা। সেই সংস্থাটির সঙ্গে আবার সিলিকনের আর্থিক যোগসূত্র পেয়েছেন তদন্তকারীরা। ইডি-র তদন্তকারীরা বলছেন, শুধু সরাসরি নয়, ঘুরপথেও সিলিকনে সারদার টাকা গিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ইডি অফিসারদের সন্দেহ, সারদার টাকা পাচারের সঙ্গে রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন ছোট অর্থলগ্নি সংস্থা জড়িত। বিষয়টি সিবিআইকেও জানানো হবে বলে ইডি সূত্রের খবর।

সিবিআই সূত্রে বলা হচ্ছে, টাকা পাচারের তথ্যটি গোচরে না এলেও সারদার কেলেঙ্কারির পিছনে মূল সূত্রধর যে শিবনারায়ণ, সেটা আগেই জেনে গিয়েছিলেন তদন্তকারীরা। নিয়ম মেনে তিন বার নোটিসও পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তলবে সাড়া দেননি শিবনারায়ণ। সিবিআইয়ের এক অফিসার বলেন, “নিজের কীর্তি ভাল ভাবেই জানতেন উনি। এলেই যে জালে জড়াবেন, তা আঁচ করেই আমাদের সামনে হাজির হননি।”

শিবনারায়ণ এত দিন কোথায় গা ঢাকা দিয়েছিলেন, তা-ও খতিয়ে দেখছে সিবিআই। প্রাথমিক ভাবে তদন্তকারীদের ধারণা, হাওড়াতেই একটি গোপন ডেরায় ছিলেন তিনি। তবে নিজের মর্জিতে, নাকি কোনও মহলের চাপে, সেটাই জানার চেষ্টা চলছে এখন। শিবনারায়ণের সঙ্গে হাওড়ার দু’জন প্রভাবশালী তৃণমূল নেতার ঘনিষ্ঠতার কথা তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন। ওই দু’জনের কেউ তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলেন কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। শনিবার বিকেলে সাঁতরাগাছি ট্যাক্সিস্ট্যান্ড থেকে প্রায় নাটকীয় ভাবে সশস্ত্র অবস্থায় পাকড়াও করা হয় শিবনারায়ণকে। তাঁর কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া গুলিভরা রিভলভারটির লাইসেন্স রয়েছে কি না, তা-ও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

সিবিআইয়ের কৌঁসুলি পার্থসারথি দত্ত এ দিন আদালতে জানান, সারদার অর্থলগ্নি কারবারে শিবনারায়ণের প্রত্যক্ষ মদত ছিল। অসদুপায়ে প্রচুর আমানত জোগাড় করেছিলেন তিনি। যদিও শিবনারায়ণের আইনজীবীরা দাবি করেন, তাঁদের মক্কেল বাজার থেকে যে টাকা তুলেছিলেন, তার কিছুটা ফেরতও দিয়েছেন। ফলে প্রতারণার মামলা তাঁর বিরুদ্ধে খাটে না। শিবনারায়ণের পক্ষে এ দিন সওয়াল করেছেন ৩ জন আইনজীবী। নীলাঞ্জন সরকার, বরুণ সোম ও নন্দন লাহিড়ী। সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সের সিবিআই দফতর থেকে এ দিন একটি কালো এসইউভি গাড়িতে চাপিয়ে শিবনারায়ণকে আলিপুর আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে তাঁকে নিয়ে ট্যাক্সিতেই বিধাননগরে ফেরেন সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE