হাবরার বিডিও নিগ্রহের ঘটনার পরে উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসকের কাছে নিজেদের নিরাপত্তার দাবি তুললেন জেলার নিচুতলার অফিসারদের একটি অংশ। জেলাশাসকের কাছে তাঁদের অভিযোগ, ওই ঘটনার পর থেকে তাঁরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন। যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা না হলে নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত অফিসারদের মনোবল ধাক্কা খাবে বলেও মঙ্গলবার জেলাশাসককে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন নিগৃহীত বিডিও-র সহকর্মীদের একাংশ।
আদর্শ নির্বাচনী আচরণবিধি পালন নিয়ে এ দিন সরকারি কর্মীদের বৈঠক ডেকেছিলেন জেলাশাসক। বৈঠকের পর সরকারি অফিসারদের একটি প্রতিনিধি দল জেলাশাসকের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলেন। সে সময়েই তাঁরা নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি তোলেন বলে জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর। জেলাশাসক সঞ্জয় বনসল ওই বৈঠকের পরে বলেন, “অফিসারদের একাংশের দাবি মেনে তাঁদের জন্য যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে। নির্বাচনী প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই অফিসারেরা নিরাপত্তা পাবেন।”
নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত অফিসারেরা এ দিন বিডিও দীনবন্ধু গায়েনের নিগ্রহকারীদের শাস্তির আর্জিও জানান। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, দীনবন্ধুবাবুর সহকর্মীরা জেলাশাসককে বলেন, দোষীদের শাস্তি না হলে নির্বাচনের কাজ সুষ্ঠু ভাবে করা যাবে না। তবে এ ব্যাপারে তাঁরা জেলাশাসকের উপরেই ভরসা রাখছেন বলেও জানান। জেলাশাসকও তাঁদের জানান, এ ব্যাপারে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন তিনি। বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের কাছেও পাঠানো হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের এক মুখপাত্র জানান, ভোটের কাজে যুক্ত কর্মী-অফিসারদের নিরাপত্তা দেওয়ার কাজ রিটার্নিং অফিসার বা জেলাশাসকদের। উত্তর ২৪ পরগনার ক্ষেত্রেও প্রাথমিক দায়িত্ব জেলাশাসকের। সেই দায়িত্ব পালন করা হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ভবিষ্যতে যাতে নির্বাচনের কাজ নিয়ে বিতর্ক না হয় সে ব্যাপারেও এ দিনের বৈঠকে অফিসারদের সতর্ক করে দিয়েছেন জেলাশাসক। তাঁর নির্দেশ, অভিযোগ পেলে চটজলদি ব্যবস্থা না নিয়ে আগে তদন্ত করতে হবে। প্রয়োজনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নিতে হবে, তা হলে অযথা বিতর্কের সৃষ্টি হবে না।
যে ঘটনার জেরে এত কাণ্ড, সেটি গত ২৫ মার্চের। ওই দিন সরকারি জায়গা থেকে রাজনৈতিক ব্যানার ও পোস্টার খোলার সময়ে হাবরা ২-এর বিডিও দীনবন্ধু গায়েনের উপর তৃণমূল কর্মীরা হামলা চালায় বলে অভিযোগ। ওই ঘটনায় স্থানীয় বিধায়ক ধীমান রায় জড়িত ছিলেন বলে দীনবন্ধুবাবু অভিযোগ করেছেন কি করেননি, বিতর্ক তাই নিয়েই। আগে জানা গিয়েছিল, দীনবন্ধুবাবু পুলিশের কাছে দু’টি অভিযোগপত্র জমা দিয়েছিলেন। প্রথমটি ২৬ মার্চ ই-মেল মারফত, যাতে ধীমানবাবুর নাম ছিল। পরেরটি ২৮ মার্চ অশোকনগর থানায় গিয়ে লিখিত আকারে, সেখানে ধীমানবাবুর নাম ছিল না। এ নিয়ে শোরগোল শুরু করে বিরোধী দলগুলি। তাদের বক্তব্য ছিল, চাপে পড়েই বিধায়কের নাম অভিযোগ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
কোন অভিযোগটি সত্য, জানার জন্য সোমবার পৃথক তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। এ দিন জেলাশাসক জানান, হাবরার বিডিও দু’টি নয়, একটি অভিযোগই করেছিলেন। তদন্তের পরে এই তথ্যই পাওয়া গিয়েছে বলে তাঁর দাবি। মঙ্গলবার সাংবাদিক সম্মেলন করে তিনি বলেন, “প্রথমে এক বার অভিযোগ লেখা হলেও তা পুলিশের কাছে জমা দেওয়া হয়নি। ২৮ মার্চ-ই অশোকনগর থানায় অভিযোগ করেন বিডিও।” ওই অভিযোগ অনুযায়ীই জেলা প্রশাসন আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে বলে মঙ্গলবার তিনি জানিয়েছেন। পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরীও মঙ্গলবার বলেন, “অভিযোগ পাওয়া মাত্র আমরা কয়েক জনকে গ্রেফতার করি। ঘটনার তদন্তও চলছে। এর বেশি কিছু বলা যাবে না।”
কিন্তু বিডিও-দের অন্য একটি অংশ মনে করছেন, দীনবন্ধুবাবু প্রথমে যে অভিযোগটি লিখেছিলেন, সেটাই ঠিক ছিল। কিন্তু প্রশাসনের কর্তাদের একাংশের চাপে অভিযোগ বদল করা ছাড়া তাঁর আর কোনও উপায় ছিল না। ওই সহকর্মীদের বক্তব্য, এ ভাবে চাপের মধ্যে পড়ে অভিযোগ বদলে ফেলা হলে, ভবিষ্যতে তাঁদের পক্ষে নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে।
তবে দীনবন্ধুবাবুদের সহকর্মীদের একাংশ এ-ও বলছেন যে, তিনি তাড়াহুড়ো করে প্রথম অভিযোগে বিধায়কের নাম না-লিখলেই পারতেন। বিধায়কের মতো প্রভাবশালী কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর আগে অনেক আটঘাট বাঁধার প্রয়োজন পড়ে। দীনবন্ধুবাবু সেটা করলে পরে তাঁকে আর পিছিয়ে আসতে হতো না।
কিন্তু বিডিও কি সত্যিই চাপে পড়ে অভিযোগ থেকে বিধায়কের নাম বাদ দিয়েছেন? এ ব্যাপারে দীনবন্ধুবাবু এ দিন বলেন, “যা জানাবার জানিয়ে দিয়েছি। এ সব নিয়ে কথা বলতে ভাল লাগছে না।” বিধায়ক ধীমান রায়ও এ দিন বলেন, “বিডিও-র সঙ্গে ফোনে কথা হওয়ার পরে জানতে পারি ওঁর ক্ষোভ রয়েছে। পরে আবার ফোন করে কথা বলি। তখন তিনি ভাল ভাবে কথা বলেন। বিষয়টি মিটেও যায়।”
বিধায়ক বিষয়টি মিটে গিয়েছে বলে দাবি করলেও দীনবন্ধুবাবুর বিরুদ্ধে বেছে বেছে তৃণমূলের পোস্টার-ব্যানার খোলার অভিযোগ অবশ্য তুলে নিচ্ছেন না দলের নেতারা। তৃণমূলের জেলা পর্যবেক্ষক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ঘটনার পরে অভিযোগ করেছিলেন, “উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবেই হাবরা-অশোকনগর এলাকায় বেছে বেছে তৃণমূলের পোস্টার-প্ল্যাকার্ড সরাচ্ছিলেন বিডিও দীনবন্ধু গায়েন।” সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে এ দিন জেলাশাসক বলেন, “এমন অভিযোগ ঠিক নয়। সরকারি এলাকা থেকে পোস্টার, প্ল্যাকার্ড তোলার নির্দেশ নির্বাচন কমিশন আগেই দিয়েছিল। দল না সরালে সরকারি ভাবে সে সব সরাবার সময় ভিডিও রেকর্ডিং-ও করা থাকছে।” এর জবাবে জ্যোতিপ্রিয়বাবু এ দিন বলেন, “আমরাও সিডি-ক্যাসেটের মাধ্যমে দেখিয়ে দেব, শুধু আমাদের ব্যানার-পোস্টারই বেছে বেছে খোলা হয়েছিল।”
তৃণমূলের পাশাপাশি বিষয়টি নিয়ে বিরোধীরাও যে বিতর্ক জিইয়ে রাখছেন, এ দিন তা সিপিএম নেতারাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন। জেলার সিপিএম নেতা নেপালদেব ভট্টাচার্য বলেন, “জেলাশাসকের অফিস ও পুলিশ থানাগুলি তো এখন তৃণমূলের অফিস হয়ে গিয়েছে। সে জন্যই এমন ভোলবদল। এত বড় এক জন অফিসারের যদি শেষে এই হাল হয়, তা হলে সাধারণ মানুষের কী অবস্থা হয়েছে, তা তো বোঝাই যাচ্ছে!”
আশ্বাসের বার্তা
• নির্বাচনী-পর্বে অফিসারেরা পুলিশি নিরাপত্তা পাবেন
• অফিসাররা নিরাপত্তা পেলেন কি না, দেখবে কমিশন
• ঝামেলা এড়াতে আট ঘাট বেঁধে কাজ করার পরামর্শ
• দীনবন্ধুর অভিযোগের আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ