Advertisement
E-Paper

নির্মল-সাক্ষী সঙ্গতই কি গতি রুখেছে তদন্তের

শাসকদলের চিকিৎসক-নেতা তথা বিধায়ক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কথা দিয়েছিলেন হাসপাতালের কর্তৃপক্ষও। ওঁদের মুখের কথা মুখেই রইল, এনআরএস হস্টেলের আবাসিকদের নাম-ঠিকানা এখনও হাতে পেল না পুলিশ। ফলে সেখানে গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনার ছ’দিন বাদেও ঠিকঠাক তদন্ত শুরু করা গেল না। রবিবার কাকভোরে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রাবাসে এক যুবককে পিটিয়ে মারা হয়।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:২৭

শাসকদলের চিকিৎসক-নেতা তথা বিধায়ক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কথা দিয়েছিলেন হাসপাতালের কর্তৃপক্ষও। ওঁদের মুখের কথা মুখেই রইল, এনআরএস হস্টেলের আবাসিকদের নাম-ঠিকানা এখনও হাতে পেল না পুলিশ। ফলে সেখানে গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনার ছ’দিন বাদেও ঠিকঠাক তদন্ত শুরু করা গেল না।

রবিবার কাকভোরে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রাবাসে এক যুবককে পিটিয়ে মারা হয়। নৃশংস ঘটনাটিতে আবাসিকেরা জড়িত কিনা, সে প্রশ্ন ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। পুলিশ জানিয়েছে, দোষীদের চিহ্নিত করতে গেলে সর্বাগ্রে যেটা দরকার, তা হল আবাসিকদের বিবরণ-সহ নামের তালিকা। তৃণমূলের চিকিৎসক সেলের প্রধান তথা বিধায়ক নির্মল মাজি বলেছিলেন, সে তালিকা অবিলম্বে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হবে। কলেজের অধ্যক্ষা মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিশ্রুতি ছিল, শুক্রবারই তিনি তালিকা জমা দেবেন তদন্তকারীদের কাছে। কিন্তু এ দিনও পুলিশ তালিকা পায়নি। এমতাবস্থায় পুলিশের অভিযোগ, এনআরএস-কর্তৃপক্ষ এ ভাবে তদন্ত-প্রক্রিয়ায় দেরি করিয়ে যেমন সাক্ষ্য-প্রমাণ নষ্ট করতে চাইছেন, তেমন হস্টেলও ধীরে ধীরে খালি করিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

অর্থাৎ, এনআরএস-কর্তৃপক্ষ কার্যত দোষীদের আড়াল করতে চাইছেন বলে পুলিশের একাংশে সন্দেহ দানা বেঁধেছে। কলেজের অধ্যক্ষা মঞ্জুদেবী এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে চাননি। ঘটনার তদন্তে অধ্যক্ষা সোমবার সাত সদস্যের যে কমিটি গড়েছিলেন, এ দিন রাত পর্যন্ত তারও রিপোর্ট জমা পড়েনি। পুলিশ-সূত্রের খবর: কর্তৃপক্ষের তরফে বিশেষ সহযোগিতা না-পেয়ে তদন্তকারীরা হস্টেলে গিয়ে কিছু ছাত্রের সঙ্গে কথা বলে প্রাথমিক কিছু তথ্য জোগাড় করেছেন। জানা গিয়েছে, এনআরএসের বয়েজ হস্টেলটিতে শ’খানেক ঘর, আবাসিক শ’চারেক। এমবিবিএস প্রথম বর্ষের পড়ুয়া থেকে ইন্টার্ন এঁরাই মূলত থাকেন। থাকেন ক্যান্টিনের কিছু কর্মচারীও। “কারা কোন তলায় কোন ঘরে থাকেন, এমন নানা তথ্য বিস্তারিত না-পেলে তদন্ত শুরু করা সম্ভব নয়।” বলছেন এক পুলিশ-কর্তা।

গুরুত্বপূর্ণ সেই তালিকা সরবরাহে এ হেন ‘গড়িমসি’র মধ্যে বিরোধীরা অন্য গন্ধ পাচ্ছে। তাদের অভিযোগ, হবু ডাক্তারদের আড়াল করতে শাসকদল তৃণমূল কলকাঠি নাড়ছে। স্বাস্থ্যভবনের আনাচে-কানাচেও এর প্রতিধ্বনি। আর গোটা বিষয়টির পুরোভাগে উঠে আসছে তৃণমূলের দুই চিকিৎসক নেতার নাম। এক জন নির্মল মাজি। অন্য জন সাক্ষীগোপাল সাহা, যিনি কিনা এনআরএসের-ই চিকিৎসক। নির্মলের বক্তব্য, হত্যাকাণ্ডের পরে তিনি এক বারও এনআরএসে যাননি। “তা হলে আমার বিরুদ্ধে দোষীদের আড়াল অভিযোগ উঠছে কী করে?” প্রশ্ন তাঁর। যার উত্তরে সাক্ষীগোপাল প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন। কী রকম?

নীলরতন-সূত্রের দাবি: নেপথ্যে থেকে নির্মলবাবু পুরো বিষয়টা নিয়ন্ত্রণ করছেন তাঁর একদা ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ সাক্ষীগোপালবাবুরই মাধ্যমে। নির্মলের ক্ষমতার কেন্দ্র যেমন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তেমন সাক্ষীগোপাল স্বাস্থ্য দফতরের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন তাঁর স্ত্রী শিউলি সাহার সুবাদে। প্রসঙ্গত, তৃণমূল বিধায়ক শিউলিদেবী তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের অতি ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। এনআরএসের চিকিৎসক মহলের একাংশের মতে, নির্মল-সাক্ষীকে মিলিয়ে দিয়েছে নীলরতন-কাণ্ড। তৃণমূলপন্থী এক ডাক্তারের কথায়, “দলের সাংগঠনিক ক্ষতি রুখতে দু’জনের এখন হাতে-হাত!”

নীলরতন-কাণ্ডের সূত্রে সাক্ষীর নাম উঠছে কী ভাবে?

মেডিক্যাল কলেজটির শিক্ষক-চিকিৎসকদের একাংশের অভিযোগ, গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনার পরে ওই চিকিৎসক নেতা ছাত্রদের অভয় দিয়ে বলেছিলেন, “যতক্ষণ আমি আছি, পুলিশ কারও কিচ্ছু করতে পারবে না।” এনআরএস হস্টেলের আবাসিক দ্বিতীয় বর্ষের এক পড়ুয়ার দাবি, “ঘটনার পর দিনই সাক্ষীদা এসেছিলেন। বলে গিয়েছেন, কারও ঘাবড়ানোর কিছু নেই। সব উনি সামলাবেন।” বস্তুত নীলরতনের সাক্ষী-ঘনিষ্ঠ এক ছাত্রনেতাই জানিয়েছেন, তদন্তে দেরি করিয়ে, তালিকার জন্য পুলিশকে অপেক্ষায় রেখে হস্টেল ধীরে ধীরে ফাঁকা করিয়ে দেওয়া সবই হয়েছে পরিকল্পনামাফিক। উল্লেখ্য, ছাত্রাবাসে গণপিটুনিতে নিহত কোরপান শা তৃণমূলেরই সমর্থক ছিলেন। তাঁর বাড়ি উলুবেড়িয়ার খৈজুরিতে, যা উলুবেড়িয়া দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। আর গায়ে লাগানো উলুবেড়িয়া উত্তর কেন্দ্র থেকে নির্মলবাবু নির্বাচিত হয়েছেন। “নির্মলদা এখন উলুবেড়িয়া সামলাচ্ছেন। সাক্ষীদা এনআরএস।” মন্তব্য ওই ছাত্র নেতার।

সাক্ষী-নির্মল যুগলবন্দিতে কাজও হচ্ছে বলে এনআরএসের টিএমসিপি মহলের পর্যবেক্ষণ। পড়ুয়াদের একাংশের অভিমত, নিহতের পরিবারের তরফে বেশি নাড়াচাড়া না-হলে ব্যাপারটা ধীরে ধীরে ধামাচাপা পড়ে যাবে। সাক্ষীগোপালবাবুর কী বক্তব্য?

এ দিন তিনি বলেন, “হস্টেলে যা হয়েছে, ভাল হয়নি। আমরা চাই, দোষীরা ধরা পড়ুক। কড়া সাজা পাক।” তা হলে তিনি হস্টেলে গিয়ে ছাত্রদের ‘অভয়’ দিলেন কেন? কেনই বা পুলিশকে আবাসিক-তালিকা দেওয়া হচ্ছে না? সাক্ষীর ব্যাখ্যা, “এমন কিছু মোটেই হয়নি। বরং আমরা নিশ্চিত করতে চেয়েছি, দোষীরা যাতে শাস্তি পায়। এবং নির্দোষদের যেন হয়রান করা না হয়।” কিন্তু তদন্ত ঠিকঠাক না-হলে ভাবে বোঝা যাবে, কে দোষী? কে-ই বা নির্দোষ?

এর সদুত্তর সাক্ষীগোপালবাবুর কাছে মেলেনি। এনআরএসের চিকিৎসকদের বড় অংশের অভিযোগ: কাগজে-কলমে তিনি ‘মেডিক্যাল অফিসার’ হলেও আদতে কাজকর্ম বিশেষ করেন না। উল্টে কলেজের বিবিধ প্রশাসনিক ব্যাপারে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেন। “আড়ালে থাকা সাক্ষীগোপাল একাধারে হাসপাতাল সুপার, হস্টেল সুপার ও অধ্যক্ষ।” কটাক্ষ এক চিকিৎসকের। এনআরএস-সূত্রের খবর: সাক্ষীগোপালের প্রতাপ রুখতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্যভবনে একাধিক বার অভিযোগ করেছেন। স্বাস্থ্যভবনও তাঁকে ঘাটানোর সাহস পায়নি।

সাক্ষীগোপালবাবু অবশ্য এ সব অভিযোগে কর্ণপাত করছেন না। উল্টে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, “জানি না, কারা আমার নামে এ সব রটাচ্ছে!” তাঁর দাবি, “আমি সব সময়ে কলেজের উন্নয়নের চেষ্টা করেছি। আমাদের নেতা নির্মলদাও তা-ই করেন।”

NRS case murder
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy