Advertisement
E-Paper

প্রার্থী জানেন তিনি দেব

অনেকেরই ধারণা, বড় কোনও অঘটন না ঘটলে ঘাটাল কেন্দ্র থেকে জিতে লোকসভায় শ্রীমান দীপক অধিকারীর পদার্পণ হয়তো সময়ের অপেক্ষা। তাঁদের অনুমান শেষ পর্যন্ত সত্যি হলে কে জিতবেন? তৃণমূল প্রার্থী দীপক অধিকারী, না কি টলিউডের হার্ট থ্রব নায়ক দেব?

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৪ ০৩:০৩

অনেকেরই ধারণা, বড় কোনও অঘটন না ঘটলে ঘাটাল কেন্দ্র থেকে জিতে লোকসভায় শ্রীমান দীপক অধিকারীর পদার্পণ হয়তো সময়ের অপেক্ষা। তাঁদের অনুমান শেষ পর্যন্ত সত্যি হলে কে জিতবেন? তৃণমূল প্রার্থী দীপক অধিকারী, না কি টলিউডের হার্ট থ্রব নায়ক দেব?

প্রশ্নটা স্বয়ং দেবকেও ভাবায়। ঝকঝকে, বুদ্ধিমান, শিক্ষিত, সুভদ্র যুবক নিজের কাছেই জানতে চান, ‘এই যে আমাকে ঘিরে এত ভিড়, এত উচ্ছ্বাস, উন্মাদনা, ছুটে এসে আমাকে ছোঁওয়ার চেষ্টা এ কি আমি শুধুই তৃণমূলের প্রার্থী বলে? অভিনেতা দেব যদি দলমত নির্বিশেষে মানুষের ভালবাসা পেয়ে থাকে, এটা কি তারও প্রকাশ নয়?’

লোকসভা কেন্দ্র হিসাবে ঘাটাল তৃণমূলের নিষ্কন্টক ফুলবাগান বলা যাবে না। ২০০৯ পর্যন্ত বারবার এখানে বাম প্রার্থী জিতেছেন। যখন এই কেন্দ্রের নাম ছিল পাঁশকুড়া, তখন টানা জিততেন সিপিআই নেত্রী গীতা মুখোপাধ্যায়। তারপরে পাঁশকুড়া থেকে ঘাটাল হওয়া পর্যন্ত এই কেন্দ্রের সাংসদ ছিলেন গুরুদাস দাশগুপ্ত। মাঝে একবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে পাঁশকুড়া থেকে বিক্রম সরকার জিতলেও সিপিআই আবার তা দখল করে নেয়। গতবার ঘাটালে গুরুদাসবাবুর জয়ের ব্যবধান ছিল দেড়লক্ষ। সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে ২০১১-র তীব্র মমতা-ঝড়েও দুটি দখলে রেখেছিল বামেরা। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে তৃণমূল বাকি পাঁচটিতে জেতে, যার একটিতে কংগ্রেস। অর্থাৎ এখন তৃণমূল বিধায়ক আছেন চারজন, কংগ্রেসের এক এবং বামের দুই। বিধানসভার নিরিখে তৃণমূল ও কংগ্রেস জোটের কাছে এই লোকসভা এলাকায় বামফ্রন্ট পিছিয়ে ছিল ২৭ হাজার ভোটে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে একা লড়াই করে গোটা লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল বামেদের চেয়ে ৩৭ হাজার ভোটে এগিয়ে। দলে নিজেদের কোঁদলের কথাও কানাঘুষো চাউর আছে।

এমতাবস্থায় চাঁদের পাহাড় থেকে দেবকে টেনে এনে সোজা ভোটের ময়দানে নামিয়ে দেওয়া যে কী কুশলী চাল, সেটা তৃণমূলের অন্তর্যামীই জানেন! প্রার্থী তালিকা প্রকাশের আগের সন্ধ্যায় একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে হাজির দেবকে দেখে হঠাৎ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়! ঘাটালের, নির্দিষ্টভাবে বললে কেশপুরের, ভূমিপুত্র দেবকে তিনি নিজে প্রার্থী হতে রাজি করান।

দুপুরের রোদ মাথায় নিয়ে খোলা ম্যাটাডোরে দাঁড়িয়ে রোড শো। পঞ্চাশ ফুট অন্তর একটি করে ভিড়ের দলা। খোকা-খুকু-বাড়ির বউ-পাড়ার দাদা-মাসিমা-ঠাকুমা সকলেরই দাবি, গাড়িটা একটু থামুক। একবার তোমায় দেখি। বৃষ্টির মতো উড়ে আসতে থাকে কিলো কিলো গাঁদা ফুলের পাপড়ি। ফিরতি ভালবাসায় সেই ফুল ভিড়ের দিকে ছুড়ে দিতে থাকেন দেব। কুড়িয়ে নিতে কাড়াকাড়ি। রাধানগরের ভিড়ে ওই যে মহিলা ফুল ছুড়লেন, কে উনি? দেবের পাশে দাঁড়ানো এক তৃণমূল নেতা জানিয়ে দেন, উনি সিপিএমের প্রাক্তন পঞ্চায়েত প্রধান।

“মমতাদির জন্য আমার একটা লাইফ টাইম অভিজ্ঞতা হচ্ছে কিন্তু! আমি তো বলব, অভিনেতার চেয়ে নেতা হওয়া বেশি কঠিন! কারণ রাজনীতির লোকেদের তো কোনও বাঁধা স্ক্রিপ্ট নেই। মন না চাইলেও সবসময় হাসতে হয়, শরীর না চললেও কথা বলতে হয়, হাত মেলাতে হয়। ভোট চাইতে যেখানে যাব না, সেখানেই লোক বলবে, দেব এল না! তাই যতক্ষণ পারো, লোকের কাছে পৌঁছতে হবে। সিনেমার সেটে এত খাটনি নেই!” অকপট দেব।

লোকসভায় প্রার্থী করার পরে দেবকে রাজ্যের অন্যান্য জেলাতেও প্রচারে পাঠিয়েছেন মমতা। তৃণমূলের তারকা-প্রচারকের তালিকার উপর দিকে রাখা হয়েছে তাঁর নাম। দেব বলেন, “মানুষ ভালবেসে আমাকে ঘিরে ভিড় করেন, এটা নতুন কিছু নয়। তবে তৃণমূলের প্রচারে গিয়েও যখন তা একই রকম দেখছি, তখন মনে হচ্ছে, রাজনীতির ভেদাভেদ বোধহয় আমার ক্ষেত্রে খাটে না।” তারই জোরে ঘাটালের তারকা-প্রার্থী বলতে পারেন, “এই ভালবাসাই আমাকে জিতিয়ে দেবে।”

এটাই অস্বস্তি বাড়িয়েছে সিপিআই প্রার্থী সন্তোষ রাণা এবং কংগ্রেস প্রার্থী মানস ভুঁইয়ার। রাজ্যের অন্যত্র মোদী-হাওয়ায় পদ্ম যেভাবে মাথা নাড়ছে, এখানে পরিস্থিতি তেমন নয়। রূপনারায়ণের সেতু পেরিয়ে কোলাঘাটে ঢুকলে তা বরং অনেকটাই মৃদু মনে হয়। তাই আসরে বিজেপি থাকলেও ভোট কাটাকাটির অঙ্কে হিসাব না-ও মিলতে পারে। লড়াই এখানে মূলত ত্রিমুখী। সিনেমার হিরো দেবের জনপ্রিয়তার সঙ্গে সিপিআই ও কংগ্রেসের। দেবের ভোট কংগ্রেস কতটা ভাঙতে পারবে এবং দেব তাঁর ‘স্টারত্ব’ দিয়ে কতটা বাম ও কংগ্রেস ভোট টেনে আনতে পারবেন, ঘাটালের জয়-পরাজয় অনেকটাই নির্ভর করছে তার উপর।

নির্বাচনী রাজনীতিতে তিন দশকের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ‘আগ মার্কা’ কংগ্রেসি মানসবাবু এই লোকসভা এলাকায় সবংয়ের পুরনো বিধায়ক। মমতার মন্ত্রিসভায় সেচমন্ত্রী হয়েছিলেন। সরকার ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরে মমতার বিরুদ্ধে তাঁর উষ্মা স্বাভাবিক। তারই একটা ভাগ তিনি এখন খরচ করছেন দেবের জন্য। দাসপুরের বেলতলা মাছবাজারে অনাড়ম্বর পথসভায় মানসের কটাক্ষ: “আমি অতি সামান্য রাজনৈতিক কর্মী। স্টার নই। অভিনয় জানি না। রাজনীতির ভাষাতেই রাজনীতি করতে চাই।” দেবের জনপ্রিয়তার সঙ্গে লড়তে নেমে চাপ হচ্ছে বলেই কি এসব কথা? মানসবাবু প্রথমে উত্তেজিত: “এইসব অরাজনৈতিক প্রশ্নের কোনও জবাবই আমি দেব না। হারজিত মানুষের হাতে। তাঁরা ঠিক করবেন।” তারপরেই যুক্তি: “কীসের চাপ? কেন চাপ? রাজনীতিটা কি অভিনয়ের জায়গা! তৃণমূল নেত্রী সিনেমা-থিয়েটার-গানবাজনার স্টারদের ভোটে নামিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক দীনতার পরিচয় দিচ্ছেন।” প্রায় একই সুরে সিপিআই প্রার্থী সন্তোষ রাণাও বলেন, “দেব অতি মিষ্টি ছেলে। নিজে যেচে আমার বাড়িতে গিয়েছিল। ওর সিনেমা আমিও দেখতে পারি। কিন্তু নির্বাচন হল রাজনৈতিক বিষয়।

ঘাটাল বামেদের শক্ত ঘাঁটি। তৃণমূলের নীতি ও কর্মধারার বিরুদ্ধে মানুষ রায় দেবে। সেখানে দেব আলাদা কেউ নন।” কেশপুরে সিপিএম আঞ্চলিক অফিসের অল্প দূরে মহিষদা গ্রামে দলের জোনাল কমিটি সদস্য শক্তি অধিকারীর একচালা বাড়ি। শক্তিবাবু দেবের বড় জেঠু। ১৯৬৫ থেকে পার্টি করছেন। তা বলে জনপ্রিয়তার ঢেউ রাজনীতির রুক্ষ মাটিকে ভেজাতে পারবে না, তেমন দাবি তাঁর নেই। এই প্রবীণ সিপিএম নেতার বক্তব্য: “দেব আমার ভাইপো না হলেও বলতাম, মানুষ যেভাবে ওকে ঘিরে আছে সেটা ভোটে ছাপ ফেলতে পারে।”

দেব আপাতত ওসব নিয়ে ভাবিত নন। তাঁর একটাই চাহিদা: “আমাকে সামনে দেখে চারজন ঝকঝকে যুবক-যুবতীও যদি রাজনীতিতে আসেন, মনে করব একটা কাজ করলাম।”

dev ellection
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy