Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

পদ্মের গন্ধে প্রত্যাশা অসীম

তিন সিনিয়র সিটিজেন। ৬৫-৬৮-৭০। লক্ষ্য এক। লোকসভা। দমদমের নির্বাচনে এটাই বেশ নজর কাড়ে। রাজনীতিতে তারুণ্যের উত্থান চেয়ে সব দলই এখন বাজার মাত করে। কার প্রার্থী-তালিকায় কমবয়সীর সংখ্যা কত বেশি তা দেখিয়ে গর্বের ফানুস ওড়ানো হয়। অথচ বৃহত্তর কলকাতার এই শহুরে কেন্দ্রে তিন প্রধান দলের প্রার্থী-তালিকায় বার্ধক্যের জয়গান!

দেবাশিস ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৪ ০৩:১০
Share: Save:

তিন সিনিয়র সিটিজেন। ৬৫-৬৮-৭০।

লক্ষ্য এক। লোকসভা।

দমদমের নির্বাচনে এটাই বেশ নজর কাড়ে। রাজনীতিতে তারুণ্যের উত্থান চেয়ে সব দলই এখন বাজার মাত করে। কার প্রার্থী-তালিকায় কমবয়সীর সংখ্যা কত বেশি তা দেখিয়ে গর্বের ফানুস ওড়ানো হয়। অথচ বৃহত্তর কলকাতার এই শহুরে কেন্দ্রে তিন প্রধান দলের প্রার্থী-তালিকায় বার্ধক্যের জয়গান!

এঁদের মধ্যে অনুজতম তৃণমূলের সৌগত রায় এখন ৬৫। সিপিএমের অসীম দাশগুপ্ত তাঁর চেয়ে তিন বছরের বড়। আর বিজেপির তপন শিকদার ৭০ ছুঁয়ে ফেলেছেন। পেশাদার রাজনীতিকদের ভাগ্যিস চাকরি করে খেতে হয় না!

অসীমবাবুকে প্রার্থী করার ভাবনাটা প্রথম খেলেছিল গৌতম দেবের মগজে। তার পরেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ফোন: “অসীম, তোকে এ বার লোকসভায় লড়তে হবে। কী রে, আপত্তি নেই তো?”

উপরতলার প্রতি তাঁর দ্ব্যর্থহীন আনুগত্য সর্বজনবিদিত। যত দিন মন্ত্রিত্ব করেছেন, ‘মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ’ ছাড়া পদক্ষেপ করেননি। তা সে জ্যোতি বসুই হোন, বা বুদ্ধবাবু। এ বার দলনেতার নির্দেশ। অসীম দাশগুপ্ত দমদম লোকসভা কেন্দ্রে সিপিএমের প্রার্থী হয়ে গেলেন।

গত বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল-ঝড়ে সিপিএমের বহু মহীরূহ পতনের এক শিকার অসীম দাশগুপ্ত। তাঁর হেরে যাওয়া খড়দহ বিধানসভা আসনটি এই লোকসভার মধ্যেই। ফের কেন দলীয় নেতৃত্ব তাঁর কথা ভাবলেন? শিষ্ট বিনয়ে বিগলিত হয়ে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীর জবাব: “আমি কিছুই জানি না। ওটা বুদ্ধদেব, বিমান বসু, গৌতম দেবরা হয়তো বলতে পারবেন।”

এবং বললেন গৌতম দেব: “অসীমদার নাম দলে আমিই তুলেছিলাম। পার্টিকে বোঝালাম, যদি নির্বাচনের পরে এমন কোনও পরিস্থিতি হয় যে আমাদের সরকারে যেতে হচ্ছে, তা হলে দু’এক জন উপযুক্ত মন্ত্রী তো দরকার! অসীমদা মন্ত্রী হিসাবে একদম ফিট চয়েস! আর যদি পার্টিকে বিরোধী আসনেই বসতে হয়, তা হলেও লোকসভায় অসীম দাশগুপ্তের মতো বিদ্বান সাংসদ থাকলে প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর বক্তৃতা মন দিয়ে শুনতে হবে। সেটাও আমাদের রাজনৈতিক লাভ।”

উত্তর চব্বিশ পরগনার জেলা পার্টিতে এর পরেও কেউ কেউ নাকি জানতে চেয়েছিলেন, অসীম দাশগুপ্ত দিল্লি চলে গেলে ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে সিপিএম ক্ষমতায় ফিরলে পরে অর্থমন্ত্রী কে হবেন? গৌতম তাঁদের জানিয়ে দেন, “তখন অর্থমন্ত্রী খুঁজে নেওয়া যাবে। আপাতত অসীমবাবুকে এমপি করাটাই জরুরি।”

দমদম লোকসভায় গত বার কুড়ি হাজারে কান ঘেঁষে জিতে এ বারেও আসনটি অনায়াসে পেয়ে গিয়েছেন তৃণমূলের সৌগত রায়। ২০১১-র বিধানসভা ভোটের নিরিখে সেই ব্যবধানও এখন প্রায় দশ গুণ বেড়েছে। তবে সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্রমবর্ধমান মোদী-হাওয়া। এমন এক নির্মম জমিতে অসীম দাশগুপ্তকে ঠেলে নামিয়ে দেওয়ার পিছনে তাঁকে কেন্দ্রে মন্ত্রী করার তাগিদ কতটা কাজ করেছে, সেটা বোঝা মুশকিল। তবে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ জেলা সিপিএমের পক্ষে এটা যে নিরাপদ প্রকল্প, তাতে অনেকেরই সন্দেহ নেই। কারণ দলের মেঠো নেতা বা লড়াকু সংগঠক বলতে যা বোঝায়, অসীমবাবু তা নন। ফলে দলের অন্দরে তাঁর গায়ে কোনও গোষ্ঠীর তকমা নেই। বিধানসভায় পরাজয়ের পরে নিজস্ব লেখাপড়া এবং অল্পবিস্তর তাত্ত্বিক আলোচনার মধ্যেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। তাই রয়ে-ক্ষয়ে যেখানে যেটুকু লাল ঝান্ডা মাথা তুলে আছে, অসীম দাশগুপ্ত তাদের কাছে হয়তো তুলনায় নির্বিষ!

এ হেন পরিস্থিতিতে কেউ যদি বলেন, সিপিএম মনের সুখে ঘি ঢেলে স্বপ্নের পোলাও রাঁধতে চাইছে, স্বভাবমার্জিত অসীমবাবু তাঁকে জোর করে নিরস্ত করবেন না। তথাকথিত তৃতীয় ফ্রন্টের অস্তিত্ব যে এখনও বায়বীয়, তা-ও তিনি মেনে নিতে রাজি। তা বলে ভোটের ময়দানে পা দিয়ে মানুষের মনের ভাষা পড়তে পারছেন না, তেমন কথা কিছুতেই তিনি মানবেন না।

তাঁর দাবি, “আমি বেশিটাই হেঁটে ঘুরছি। মানুষের দরজায় নিজে পৌঁছতে চাইছি। কারণ তাতে তাঁদের সঙ্গে সংযোগের সুবিধা হয়। গত বিধানসভা ভোটের সময় যেমন নিজেই বুঝেছি, অবস্থা ভাল নয়। এ বার বুঝতে পারছি, লোক কী ভাবে আমাকে সাদরে গ্রহণ করছেন।”

মনের কথা মুখে না-বলা পেশাদার রাজনীতিকদের সাধারণ ধর্ম। তাই অসীমবাবুকে প্রার্থী করার পোশাকি যুক্তিতে গৌতম দেব যতখানি প্রকাশ্য, প্রার্থী নিজে যতটা সলজ্জ, বিজেপি-র ভোট কাটাকাটির প্রসঙ্গ আলোচনায় কেউই ততটা সরব নন। তবে দমদম কেন্দ্রে ঘুরে হাওয়ায় এ বার পদ্মের নড়াচড়া টের পাচ্ছে সকলেই। জেতার অঙ্কে না-হোক, তৃণমূলের যাত্রাভঙ্গের অঙ্কে পদ্ম কী ভাবে কতটা বিকশিত হয়, কে বলতে পারে! গৌতমবাবুদের প্রত্যাশাও তাই অসীম ছুঁয়ে যায়। তাঁরা মনে মনে হিসেব কষছেন, তৃণমূল এবং বিজেপি-র মধ্যে বাম-বিরোধী ভোট কাটাকাটিতে যদি তৃতীয় পক্ষ সিপিএমের পাথর-চাপা বরাত খোলে! গোষ্ঠী কোঁদলের বাইরে থাকা অসীম দাশগুপ্তকে বেছে নেওয়ার এটিও বড় কারণ।

এখন রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন ৬৮ বছরের এই ‘যুবক’। সকালে বেরিয়ে দুপুরে অল্প সময় সল্টলেকের বাড়িতে ফেরা। আবার বিকেল থেকে রাত সাড়ে দশটা। প্রায় আড়াই মাস এমনটাই চলছে।

সময় বুঝে ফস করে জ্বলে উঠেছেন ইদানীং অনেকটা স্তিমিত হয়ে যাওয়া বিজেপি-র তপন শিকদারও। দমদম লোকসভা কেন্দ্রে ১৯৯৮ থেকেই তপনবাবু একচেটিয়া বিজেপি প্রার্থী। শেষ বার জিতেছিলেন ১৯৯৯-তে। নিন্দুকেরা সেই জয়কে সে দিনের ডাকসাইটে সিপিএম মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর ‘সৌজন্য’ বলে খাটো করতেও চেয়েছিল। কিন্তু সেই সময় যেমন তাঁর অনুকূলে বাজপেয়ী-হাওয়া ছিল, এ বার তেমন মোদী। উত্তর কলকাতার রাজবল্লভপাড়ায় তাঁর ছোট্ট ফ্ল্যাটে বসে তপনবাবু তাই আত্মবিশ্বাসী: “আমার নজরে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বলে কেউ নেই। আমি জিতব। তার পরে অন্যান্য দলের প্রার্থীরা যিনি যেখানে থাকেন, থাকবেন।”

সত্তর ছোঁওয়া বয়স, অসুস্থতা, এক বার বিজেপি ছেড়ে চলে যাওয়া ইত্যাদি নানা কারণে বিজেপি-র উঁচুতলার দৌড়ে অতীতের রাজ্য সভাপতি তপন শিকদার কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিলেন। বর্তমান রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার ঘনত্ব নিয়েও নানা সময় প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু সে সব ‘অপপ্রচার’ বলে উড়িয়ে দিয়ে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তপনবাবুর দাবি, “রাজ্যে দলের প্রার্থী বাছাই কমিটিতে আমিও সদস্য। সেখানে দমদমের জন্য শুধু আমার নামটিই পাঠানো হয়েছিল।”

কয়েক দিন আগে অবশ্য মর্মান্তিক গুজব রটেছিল তপন শিকদারের শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে। বিজেপি প্রার্থীর মতে, তাঁর ভোট-ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বুঝেই ওই ‘ঘৃণ্য কৌশল’ নিয়েছিল তৃণমূল। হয়তো ঠিক, হয়তো ভুল তাঁর ওই পর্যবেক্ষণ। কিন্তু মাথার উপর তপন-তাপ এড়ানো যে কঠিন, এই ধরনের কু-প্রচারে তারই ইঙ্গিত মেলে।

“দমদমের হাওয়া মমতায় ভরা। এখানে বিজেপিকে হারাতে ওই সব কৌশল লাগে নাকি!” কটাক্ষ সৌগত রায়ের নির্বাচনের অন্যতম সেনাপতি এবং রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর। তাঁর পাল্টা যুক্তি: “কোনও প্রার্থীর মৃত্যু হলে সেই কেন্দ্রে ভোটই স্থগিত হয়ে যায়। নিশ্চিত জেতার আসনে হঠাৎ এমন উদ্ভট গুজব রটিয়ে তৃণমূলের কী লাভ! এটা আসলে বিজেপি-র দলীয় কোঁদলের ফল।”

লাভ-ক্ষতির হিসেব আরও প্রাঞ্জল করে বোঝাতে তৎপর বরানগরের তৃণমূল বিধায়ক তাপস রায়: “এই কেন্দ্রে সাতটি বিধানসভাই আমাদের। দু’টি ছাড়া সব পুরসভায় তৃণমূল। ফলাফল তো পরিষ্কার। এর পরেও গুজব ছড়াতে হবে!”

দমদমের আড়াই নম্বর গেটে তৃণমূলের প্রধান নির্বাচনী কার্যালয় থেকে ধোপদুরস্ত ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বেরোচ্ছিলেন সৌগত। দুপুর পর্যন্ত রোড শো করেছেন। একটু পরেই তাঁর কেন্দ্রে মিঠুনের সভা। যেতে যেতে বলে গেলেন, “মোদী এতগুলি কেন্দ্রে সভা করলেন, অথচ দমদমে এলেন না। কেন? কারণ তিনিও জানেন, এটা তৃণমূলের জায়গা। এখানে এসে লাভ নেই!”

তবু নিজের আসন ধরে রাখতে সৌগত ছুটছেন। সকাল থেকে রাত গলদঘর্ম দৌড়। ভোটের ময়দানে ৬৫ বছরের শরীরটাকে বিশ্রাম দেওয়ার সুযোগ কম। আসলে মরসুমটা যে কালবৈশাখীর! দুপুরে খটখটে রোদ, বিকেলের ঝড়ে হঠাৎ সব ওলটপালট।

তাই সাবধানের মার নেই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

vote pathe debasish bhattacharyay dumdum
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE