Advertisement
E-Paper

পরিচয় যাচাই না করেই ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্ধ প্রহার

কাকভোরে ‘চোর-চোর’ চিৎকার শুনে নিজের নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন জনা কয়েক আবাসিক। খোঁজাখুঁজি করে দেখা যায়, শৌচাগারে এক অচেনা যুবক লুকিয়ে রয়েছে। লালবাজার সূত্রের দাবি, যুবকটির পরিচয় যাচাই না-করে তৎক্ষণাৎ সেখানেই তাকে পেটানো শুরু হয় বলে জেরায় জানিয়েছেন কোরপান-হত্যায় ধৃত চার হবু চিকিৎসক।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:৪২

কাকভোরে ‘চোর-চোর’ চিৎকার শুনে নিজের নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন জনা কয়েক আবাসিক। খোঁজাখুঁজি করে দেখা যায়, শৌচাগারে এক অচেনা যুবক লুকিয়ে রয়েছে।

লালবাজার সূত্রের দাবি, যুবকটির পরিচয় যাচাই না-করে তৎক্ষণাৎ সেখানেই তাকে পেটানো শুরু হয় বলে জেরায় জানিয়েছেন কোরপান-হত্যায় ধৃত চার হবু চিকিৎসক। তদন্তকারীরা বলছেন, সোমবার গ্রেফতার হওয়া ওই চার জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ঘটনায় আরও কয়েক জনের ভূমিকা স্পষ্ট হয়েছে। এ-ও জানা গিয়েছে, মারের চোটে লোকটি যে মরতে বসেছে, ডাক্তারির জ্ঞান থাকার সুবাদে প্রহারকারীরা তা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন। তা সত্ত্বেও মরণাপন্নকে ফেলে রেখে তাঁরা নিজেদের পিঠ বাঁচানোর পরিকল্পনা ছকতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

গত ১৬ নভেম্বর ভোরে এনআরএস মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রাবাসে মানসিক ভারসাম্যহীন যুবক কোরপান শাহকে থামে বেঁধে পিটিয়ে খুন করা হয়। পুলিশ প্রথমে এনআরএসে ডাক্তারির প্রথম বর্ষের ছাত্র তথা ওই হস্টেলের আবাসিক জসিমুদ্দিনকে গ্রেফতার করে। হস্টেল ক্যান্টিনের দুই কর্মীও গ্রেফতার হন। তাঁদের কাছে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সোমবার ধরা হয়েছে আরও চার হবু ডাক্তারকে। এঁরা হলেন জাভেদ আখতার, অনুরাগ সরকার, ইউসুফ জামাল ও অরিজিৎ মণ্ডল। কোরপান খুনের তদন্তভার এখন পুরোদস্তুর লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের হাতে। তদন্তকারীরা বলছেন, জাভেদ-অনুরাগদের জিজ্ঞাসাবাদ করে হত্যাপর্বের পুরো বিবরণ বিস্তারিত প্রকাশ পেয়েছে। কী রকম

জেরায় পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ জানিয়েছে, ১৬ নভেম্বর ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ জসিমুদ্দিনের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তিনি দেখেন, তাঁর ঘরের দরজার সামনে একটি অচেনা লোক দাঁড়িয়ে। তিনি ‘চোর চোর’ বলে চেঁচিয়ে ওঠেন। চিৎকার শুনে অনুরাগ, ইউসুফ-সহ কয়েক জন সিনিয়র ছাত্র নিজেদের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। এ দিক-সে দিক খানাতল্লাশি চলে। শেষে দেখা যায়, হস্টেলের চারতলার টয়লেটে একটি অপরিচিত লোক লুকিয়ে আছে। সে-ই কোরপান। উলুবেড়িয়ার বাসিন্দা যে যুবকটির মানসিক সুস্থিতি ছিল না বলে পরে জানা গিয়েছে।

কিন্তু সেই ভোরে হবু ডাক্তারেরা এত শত বিচারের ধার ধারেননি। পুলিশের দাবি, কোনও রকম জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই শুরু হয়ে যায় লাথি-ঘুষি-চড়ের বৃষ্টি। আরও কিছু ছাত্র চলে আসেন। তাঁদের হাতে উঠে আসে বাঁশ, কাঠের টুকরো, বেঞ্চের ভাঙা পায়া ইত্যাদি। নির্মাণকাজের দৌলতে হস্টেলের আনাচে-কানাচে সে সবের অভাব পড়েনি।

এবং পুলিশের দাবি, শৌচাগারের সামনে পিটিয়েই কোরপানকে রেহাই দেওয়া হয়নি। “প্রথম দফায় মারধরের পরে কয়েক জন আবাসিক চেয়েছিলেন, লোকটিকে ছেড়ে দেওয়া হোক। বাকিরা কান দেননি।” বলেন লালবাজারের এক অফিসার। তাঁকে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হয় চারতলার আর এক প্রান্তে ক্যারম ঘরের সামনে। সেখানে থামের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফের শুরু হয় প্রহারপর্ব। ঘণ্টাখানেক ধরে মার খেতে খেতে কোরপান নেতিয়ে পড়েন।

তদন্তকারীরা বলছেন, কোরপানকে নৃশংস ভাবে পেটানো হয়েছিল। কোমরের হাড় ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। প্রহারকারীরা ভালই জানতেন, বাঁশ-কাঠ দিয়ে এ ভাবে মারলে মৃত্যু হতে পারে। শেষে কোরপান সংজ্ঞা হারালে ওঁরা ক্ষান্ত দেন। এক তদন্তকারীর কথায়, “লোকটা যে মরতে বসেছে, লক্ষণ দেখে সেটা আঁচ করতে ডাক্তারি-পড়ুয়াদের অসুবিধে হয়নি। তাই তড়িঘড়ি ওঁরা নিজেদের ঘরে ফিরে যান।”

পুলিশের দাবি, ঘরে ফিরে অভিযুক্তেরা আলোচনা করে পরবর্তী পরিকল্পনা ছকে ফেলেন। এক ছাত্রের ফোন থেকে এন্টালি থানায় খবর দেওয়া হয়। পরিকল্পনামাফিক গোড়ার দিকে পুলিশের সামনেও তাঁরা বিভ্রান্তিকর কথা-বার্তা বলেছিলেন। প্রায় সকলেরই জবাব ছিল, ‘কিছু দেখিনি, কিছু জানি না।’ পুলিশ-সূত্রের খবর, এখন ছবিটা স্পষ্ট হওয়ার পরে ধৃতেরা বলছেন, গত ক’মাসে হস্টেলে অনেকের মোবাইল ফোন চুরি হয়েছিল। অত ভোরে অচেনা এক জনকে দেখে ধরেই নেওয়া হয়, সে চোর। তাই কোনও রকম জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই পিটুনি চালু হয়ে যায়।

অভিযুক্তদের গ্রেফতারে করতে এত দেরি হল কেন?

পুলিশের নিচুতলার ব্যাখ্যা: এন্টালি থানা ও লালবাজারের উপরে ‘বাইরের চাপ’ ছিল। উপরন্তু তেমন যুতসই প্রমাণও মিলছিল না। অবশেষে হস্টেলে কর্মরত কয়েক জন নির্মাণ-শ্রমিক ও ক্যান্টিন-কর্মীদের একাংশের কাছে পাওয়া তথ্যের জোরে জসিমুদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয়। তার পরে তদন্ত কিছুটা গতি পেয়েছে। জসিমুদ্দিনের স্বীকারোক্তির সূত্র ধরেই চার সিনিয়র ছাত্রকে পাকড়াও করা হয়েছে। তাঁরা আবার আরও কয়েক জনের নাম জানিয়েছেন।

“এ বার তাঁদের জালে ফেলার পালা।” মন্তব্য এক তদন্তকারীর।

korpan shah
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy