Advertisement
E-Paper

পরিশ্রম ও কৌশলের বুনটেই জোয়ার আনলেন বাবুল

প্রথম প্রস্তাবটা এসেছিল বাবা রামদেবের কাছ থেকে। বিজেপি-র এক কেন্দ্রীয় নেতাকে ওই ‘যোগগুরু’ বলেছিলেন, গায়ক বাবুলকে রাজনীতির ময়দানে নামালে ভাল হবে। বেশ পরিশ্রমী, লড়াইয়ের আগে হার মানে না। প্রস্তাব পাওয়ামাত্র কলকাতায় ফোন করে ওই বিজেপি নেতা জানতে চেয়েছিলেন, বাবুলকে যদি পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রার্থী করা যায় তো কেমন হয়? রাজ্য নেতৃত্বের জবাব ছিল, ভালই হবে।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৪ ০৩:০৮
তখনও ফল অজানা। গণনা কেন্দ্রে আসানসোলের দুই প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয় ও দোলা সেন। শুক্রবার সকালে সব্যসাচী ইসলামের তোলা ছবি।

তখনও ফল অজানা। গণনা কেন্দ্রে আসানসোলের দুই প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয় ও দোলা সেন। শুক্রবার সকালে সব্যসাচী ইসলামের তোলা ছবি।

প্রথম প্রস্তাবটা এসেছিল বাবা রামদেবের কাছ থেকে। বিজেপি-র এক কেন্দ্রীয় নেতাকে ওই ‘যোগগুরু’ বলেছিলেন, গায়ক বাবুলকে রাজনীতির ময়দানে নামালে ভাল হবে। বেশ পরিশ্রমী, লড়াইয়ের আগে হার মানে না। প্রস্তাব পাওয়ামাত্র কলকাতায় ফোন করে ওই বিজেপি নেতা জানতে চেয়েছিলেন, বাবুলকে যদি পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রার্থী করা যায় তো কেমন হয়? রাজ্য নেতৃত্বের জবাব ছিল, ভালই হবে।

কার্যত ওই দিনই আদতে উত্তরপাড়ার বাসিন্দা সুপ্রিয় বড়াল ওরফে বাবুল সুপ্রিয়কে দলের টিকিট দেওয়ার বিষয়টি এক রকম পাকা করে ফেলেন বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।

কিন্তু কোথায়? বিজেপি সূত্রের খবর, প্রস্তুতিপর্বের একদম গোড়ায় গত ১৯ মার্চ নয়াদিল্লিতে এক বৈঠকে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ ও সংগঠন-সম্পাদক অমলেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের কাছে দলের সর্বভারতীয় সভাপতি রাজনাথ সিংহ জানতে চান, কোথায় বাবুলকে প্রার্থী করলে ভাল হবে? তখনই সিদ্ধান্ত হয়, আসানসোলে পাঠানো হবে বাবুলকে। সময় নষ্ট না করে ওই দিনই তা ঘোষণা করে দেন রাজনাথ। লড়াইয়ের সেই শুরু। বিরোধীদের এক টানা আক্রমণ সামলে, মামলা-মোকদ্দমা হজম করে বাবুল সুপ্রিয় আসানসোলের সাংসদ হলেন। আজ, শনিবার নয়াদিল্লিতে বাবুলকে ডেকে পাঠিয়েছেন বিজেপি-র কেন্দ্রীয় সংগঠন সম্পাদক রামলাল। তাঁকে কয়েকদিন দিল্লিতে থাকার প্রস্তুতি নিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

জেতার পিছনে কেবল যে প্রার্থীরই পরিশ্রম ছিল, তা নয়, ছিল সঙ্ঘ পরিবারেরও সুপরিকল্পিত কৌশল। গায়ক বাবুলের জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্ঘ পরিবারের নিখুঁত সাংগঠনিক শক্তির মিশেলের কারণেই শেষ পর্যন্ত বাজিমাত করতে পেরেছে বিজেপি। সেই খনি-এলাকায়, যেখানে বিধায়ক তো দূরের কথা, নিজের জোরে জেতা একটা পঞ্চায়েতও বিজেপি-র নেই।

কী ভাবে ঘুঁটি সাজিয়েছিল সঙ্ঘ পরিবার? এক বিজেপি নেতা বলেন, “বাবুল আসানসোলে পা দেওয়ার আগেই সঙ্ঘ পরিবার কেন্দ্রটি বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে ‘দত্তক’ সঁপেছিল। এর পরে ভোট পরিচালনার দায়িত্বে পরিষদের বাংলা-ওড়িশা-সিকিম ও আন্দামানের দায়িত্বে থাকা শচীন্দ্রনাথ সিংহকে, যিনি ৩২ বছর আসানসোলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের তরফে দায়িত্ব সামলেছেন। ভোট যুদ্ধ চালাতে তিনিই ছিলেন প্রার্থীর ‘ব্যাক অফিসের’ দায়িত্ব। শচীন্দ্রনাথবাবু অবশ্য কৃতিত্ব নিতে নারাজ। তাঁর বক্তব্য, “বাবুলের পরিশ্রম, দলগত প্রয়াস, সর্বোপরি মোদী-ঝড়েই এই জয়।”

সঙ্ঘের এক মুখপাত্র জানান, মূলত তিনটি বিষয় সামনে রেখে আসানসোলে লড়াইয়ে নেমেছিল বিজেপি। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বুঝেছিলেন, গায়ক-প্রার্থীর জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে প্রচারে ঝড় তুলতে হবে। বিশেষ করে কমবয়সি ছেলেমেয়েদের টানতে এগিয়ে দিতে হবে বাবুলকেই। এক বিজেপি নেতা বলেন, “নতুন মুখের শ’দেড়েক সর্বক্ষণের কর্মী নামানো হয়েছিল আসানসোলে। ১২ জন সংখ্যালঘু কর্মীও ছিলেন। তাঁরাই গ্রামে গ্রামে ঘুরে ছোট ছোট সভা করে প্রার্থীর তরফে প্রচার চালিয়েছেন। পিছনে ছিল অবশ্যই সঙ্ঘ পরিবার।”

আসানসোলের জনতাকে কাছে টানতে ১০ এপ্রিল রামনবমী উপলক্ষে আসানসোলের ৭ বিধানসভা এলাকায় অরাজনৈতিক শোভাযাত্রার আয়োজন করে বিজেপি। তাতে অভূতপূর্ব সাড়া মেলে। ১৫ এপ্রিল, পয়লা বৈশাখে আসানসোলের বিভিন্ন স্থানে প্রীতি সম্মেলন করা হয়। পালে হাওয়া তুলতে এর পরেও মোদী গুজরাত থেকে আসানসোলে পাঠিয়েছিলেন সাধ্বী নির্মলাকে। তাঁর প্রচার কয়লা-শহরের গুজরাতি ও মারোয়াড়িদের মধ্যে জবরদস্ত প্রভাব ফেলেছিল বলে মত বিজেপি-র। বাবুলের লড়াই যে জমে উঠেছে, তার খবর রাখছিল নরেন্দ্র মোদীর টিমও। তাই প্রচারের ঝাঁঝ বাড়াতে ধানবাদের প্রাক্তন সাংসদ পশুপতিনাথ সিংকে আসানসোলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ওড়িশা বিজেপি-র সংগঠন সম্পাদক প্রসন্নভাইও লোকলস্কর নিয়ে পৌঁছন বাবুলের কেন্দ্রে। তাঁর মূল কাজ ছিল মোদী-ঝড় শেষ দিন পর্যন্ত ধরে রাখা। সেই ঝড়ই সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে বলে মনে করছেন সঙ্ঘ কর্তারা।

মাস দেড়েক আগে এই শহরে যে লড়াই শুরু করেছিলেন বাবুল, তারই ইতি টানতে শুক্রবার সকালে হাজির হন সেন্ট ভিনসেন্ট স্কুলের গণনা কেন্দ্রে। এসেই যাঁর মুখোমুখি পড়লেন, গত ক’দিনে তাঁর কাছ থেকে কোনও ‘সুবচন’ শোনেননি বাবুল। মহিলার পরনে সাদা সালোয়ার-কামিজ। পায়ে চপ্পল। তৃণমূল প্রার্থী দোলা সেনকে দেখে এগিয়ে গেলেন বাবুল। কথা শুরু করলেন দোলাদেবী। বাবুলকে বলেন, “প্রচারে আমি আপনাকে খারাপ কিছু বলিনি। তবে রাজনীতিতে নতুন তো, একটু চড়া কথা শুনে ভেঙে পড়বেন না। মাথা ঠান্ডা রাখুন। আর হ্যাঁ, আমি কিন্তু আপনার গানের ভক্ত।....”

বাবুল হাসছেন। খানিক নীরবতা। স্মার্ট বাবুলকে অবাক করেই দোলা শুরু করলেন, “মনে হচ্ছে একটু চাপে পড়ে গিয়েছেন। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি জিতলে একটা অনুষ্ঠান করব। আপনাকে গাইতে হবে।”

দমবার পাত্র নন বিজেপি প্রার্থী। তাই দোলাদেবীর প্রস্তাব ফিরিয়ে বাবুলের আর্জি, “আমি জিতলে আমার জলসাতেও আপনাকে গাইতে বলব। পিছিয়ে যাবেন না কিন্তু!”

এর ক’ঘণ্টার মধ্যেই স্পষ্ট হয়েছে, কার জলসায় কে গাইবেন। বাবুল বলেন, “দলের রাজ্য সভাপতি দুটো কেন্দ্রের একটা বাছতে বলেছিলেন। একটা ছিল আমার ‘হোম গ্রাউন্ড’ শ্রীরামপুর, দ্বিতীয়টা আসানসোল। আমি না হয় ‘হোম গ্রাউন্ড’ ছেড়ে ‘অ্যাওয়ে’ ম্যাচ খেললাম। জিতলাম। এর আনন্দই আলাদা।”

নাগাড়ে ৪০ দিন ৪২ ডিগ্রি গরম মাথায় নিয়ে খনি-খাদানে ঘোরার মাঝে এলাকা জুড়ে যে পদ্ম-গন্ধী হাওয়া উড়ছে, তা আঁচ করেছিলেন বাবুল নিজেও। ঘনিষ্ঠদের বলেছিলেন, প্রার্থী নিয়ে শাসকদলে যে ক্ষোভ আছে, তার জেরে যে অন্তর্ঘাত হতে পারে, তা-ও আঁচ করেছিলেন তিনি। সেলিব্রিটির এমন পর্যবেক্ষণ দেখে তাজ্জব হয়েছিলেন স্থানীয় নেতারাও। বিজেপি-র বর্ধমান জেলা সভাপতি নির্মল কর্মকারও স্বীকার করছেন, “বাবুল অসম্ভব বুদ্ধিমান। ওঁর বুদ্ধি, পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের কাজ অনেকটাই সহজ করে দিয়েছিল। তাই ওঁকে নিয়ে প্রচারে বেরিয়েও বিড়ম্বনার আঁচ পোহাতে হয়নি আমাদের।”

সুপ্রিয় বড়ালের সেই আঁচই ছড়িয়ে পড়ল আসানসোলের খনি-খাদানে।

মন্ত্রিত্ব, পদ ছাড়তে নির্দেশ মলয়কে

আসানসোল কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী দোলা সেনের হারের পরে দলবিরোধী কাজের অভিযোগে মলয় ঘটককে জেলা সভাপতি ও রাজ্য মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে বলা হয়েছে। সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মাধ্যমে তাঁকে এই বার্তা পাঠানো হয়েছে। তৃণমূল সূত্রে খবর , আসানসোলে দোলা সেন প্রার্থী হওয়ায় ওখানে যে দলবিরোধী কাজ চলছে, সে ব্যাপারে তৃণমূল নেতৃত্বের কাছে খবর আসছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও আসানসোলে গিয়ে একজোট হয়ে কাজ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতি না বদলানোয় মলয়বাবুকে সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব।

jagannath chattopadhyay rahul roy babul supriya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy