Advertisement
E-Paper

বোমা উদ্ধার করতে গিয়ে জখম ওসি

যেখানে দাঁড়িয়ে পুলিশকে বোমা মারতে দলের কর্মী-সমর্থকদের নির্দেশ দিয়েছিলেন অনুব্রত মণ্ডল, বীরভূমের সেই পাড়ুইয়েই আক্রান্ত হল পুলিশ। যদিও তৃণমূল নয়, অভিযোগের তির বিজেপির দিকে। সেই বিজেপি, যারা আগাগোড়া দাবি করে আসছে, এ রাজ্যে সংগঠন বাড়াতে গিয়ে তারা দুষ্কৃতীদের দলে ঠাঁই দেবে না। ঘটনাচক্রে, শুক্রবার দুপুরে বোমা উদ্ধার করতে গিয়েই আক্রমণের মুখে পড়ে পুলিশ।

মহেন্দ্র জেনা ও দয়াল সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:২৫
আহত পুলিশকর্তাকে সিটি স্ক্যানের জন্য সিউড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।  ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।

আহত পুলিশকর্তাকে সিটি স্ক্যানের জন্য সিউড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।

যেখানে দাঁড়িয়ে পুলিশকে বোমা মারতে দলের কর্মী-সমর্থকদের নির্দেশ দিয়েছিলেন অনুব্রত মণ্ডল, বীরভূমের সেই পাড়ুইয়েই আক্রান্ত হল পুলিশ। যদিও তৃণমূল নয়, অভিযোগের তির বিজেপির দিকে। সেই বিজেপি, যারা আগাগোড়া দাবি করে আসছে, এ রাজ্যে সংগঠন বাড়াতে গিয়ে তারা দুষ্কৃতীদের দলে ঠাঁই দেবে না।

ঘটনাচক্রে, শুক্রবার দুপুরে বোমা উদ্ধার করতে গিয়েই আক্রমণের মুখে পড়ে পুলিশ। মঙ্গলডিহি পঞ্চায়েতের চৌমণ্ডলপুর গ্রামে সেই হামলায় পাড়ুই থানার ওসি প্রসেনজিৎ দত্ত মাথায়, পিঠে ও পায়ে গুরুতর চোট পান। তাঁকে সিউড়ি সদর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। জখম হয়েছেন সুনীত গুপ্ত হালবাই নামে এক কনস্টেবলও। পরে বীরভূমের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া বিশাল বাহিনী নিয়ে গ্রামে যান। তাঁর বক্তব্য, “বোমা-বারুদ মজুতের খবর পেয়ে পুলিশ অভিযানে নেমেছিল। দুষ্কৃতীরা লাঠি, রড, বোমা নিয়ে আক্রমণ করে। চার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।” বিকেলে আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেট থেকে ‘বম্ব ডিসপোজাল টিম’ আনিয়ে এলাকা ঘিরে ফেলা হয়। ঘটনায় জড়িত সন্দেহে বেশ কয়েক জনকে আটকও করা হয়েছে।

এই হামলায় প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে যার নাম উঠে আসছে, সেই সদাই শেখ এক সময়ে তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের অনুগামী বলে পরিচিত ছিল। সম্প্রতি সে শিবির বদলে বিজেপির দিকে ঝুঁকেছে। ঘটনার পরেই অনুব্রত দাবি করেন, “সদাই শেখই গোটা ঘটনায় যুক্ত। ও আগে সিপিএম করত। এখন বিজেপি করে। ওখানে বিজেপির লোকেরাই পুলিশের উপরে হামলা করেছে।” বিজেপির কেন্দ্রীয় সম্পাদক তথা এই রাজ্যের পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ সিংহের পাল্টা দাবি, “পুলিশের উপরে এই হামলায় বিজেপি-কে জড়ানোর কোনও মানেই নেই। সমস্ত সংবাদমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, তৃণমূল অভিযুক্ত।”

তৃণমূল ও বিজেপি একে অন্যের ঘাড়ে দায় চাপানোর চেষ্টা করলেও ঘটনার নেপথ্যে আসলে রয়েছে দুই দলের এলাকা দখলের লড়াই। পাড়ুই থানার সাত্তোর ও মঙ্গলডিহি— এই দুই পঞ্চায়েত এলাকায় দু’দল লোক জড়ো করছে বলে আগেই পুলিশের কাছে খবর ছিল। এ দিন খবর আসে, তৃণমূলের লোকজন সাত্তোর-কসবা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভিতরে একটি পরিত্যক্ত ঘরে বিপুল পরিমাণ বোমা ও বোমার মশলা মজুত করেছে। পুলিশ গিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভগ্নপ্রায় আবাসনের একটি পরিত্যক্ত ঘর থেকে ঘি রাখার ১৬টি প্লাস্টিকের ড্রামে প্রায় ছ’শো তাজা বোমা ও মশলা পায়। সেই সময়েই তৃণমূলের একটি সূত্রে পুলিশকে জানানো হয়, কাছেই চৌমণ্ডলপুরে একটি পুকুরপাড় এবং মুরগি খামারে বোমা বাঁধার কাজ চলছে। সিআই (বোলপুর) চন্দ্রশেখর দাস ও পাড়ুই থানার ওসি প্রসেনজিৎ দত্ত দু’টি ছোট-ছোট পুলিশ বাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে যান।

দুপুর ১টা নাগাদ পুলিশ পৌঁছতেই পুকুরপাড়ে বসে থাকা দুষ্কৃতীরা গ্রামের দিকে দৌড় দেয়। সেখান থেকে পুলিশ বোমা ও মশলা উদ্ধার করে। এর পরে গ্রাম লাগোয়া মুরগি খামারের দিকে যেতেই পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা, ইট-পাটকেল ছোড়া হতে থাকে। দুই বাহিনী মিলিয়ে মোট জনা পনেরো পুলিশকর্মী ছিলেন। আক্রমণের ঝাঁঝ দেখে তাঁরা বুঝে যান, সামাল দেওয়া সহজ হবে না। তার চেয়ে আপাতত পিছু হটে গিয়ে বড় বাহিনী নিয়ে ফিরে আসাই শ্রেয়। কিন্তু পুলিশের দু’টি গাড়ি মুখ ঘুরিয়ে ফেরার চেষ্টা করতেই মুড়ি-মুড়কির মতো বোমা পড়তে থাকে। পুলিশের গাড়িতেও বোমা পড়ে। ওসি আগেই গাড়ি থেকে নেমেছিলেন। তিনি আর উঠতে পারেননি। ওসি-র কথায়, “আমাকে লক্ষ্য করে বোমা ছোড়া হয়। আমি পড়ে যেতেই কিছু লোকজন লাঠি-ইট দিয়ে আমায় মারধর করে।”

পাড়ুই থানা সূত্রের খবর, অবস্থা বেগতিক বুঝে তাদের একটি গাড়ি এগিয়ে গিয়ে ওসি-কে উদ্ধার করে। গ্রামের বেশ কিছু মহিলা অবশ্য পাল্টা দাবি করেন, পুলিশ দুষ্কৃতীদের খোঁজার নামে বাড়ি-বাড়ি ঢুকে ভাঙচুর চালাচ্ছিল। পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে মারধরও করে। তাঁরা তার প্রতিবাদ করেছেন মাত্র। কিন্তু কাউকে মারধর করা হয়নি। বরং ছুটে পালাতে গিয়ে ওসি নিজেই পড়ে গিয়ে চোট পান। মহিলারাই তাঁকে জল খাইয়ে পুলিশের গাড়িতে তুলে দিয়েছেন। এই গ্রামেই সদাই শেখের বাড়ি, তাঁর বোন আঞ্জু মানোয়ারা বেগমই এখানকার পঞ্চায়েত সদস্য। যদিও তৃণমূলের টিকিটে জিতে সদাইয়ের মতো তিনিও এখন বিজেপির দিকে ঘেঁষেছেন বলে স্থানীয় সূত্রের খবর। তবে সদাই বা আঞ্জু কাউকেই এ দিন ঘটনাস্থলে দেখা যায়নি। স্বাস্থ্যকেন্দ্র কী করে বোমার আড়ত হল, বীরভূম জেলা স্বাস্থ্য দফতর তার ব্যাখ্যাও দিতে পারেনি।

প্রশ্ন হল, যে পাড়ুই কিছু দিন আগেও তৃণমূলের খাসতালুক ছিল, সেখানে বিজেপির বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ উঠছে কী করে?

স্থানীয় সূত্রের খবর, গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের মুখে যেখানে দাঁড়িয়ে অনুব্রত প্রয়োজনে পুলিশকে বোমা মারতে বলেছিলেন, সেই পাড়ুই আর আগের মতো তাঁর হাতের মুঠোয় নেই। তৃণমূলের সাত্তোর অঞ্চল সম্পাদক শেখ মুস্তফার নেতৃত্বে (যিনি পাড়ুইয়ে সাগর ঘোষ হত্যা মামলাতেও অভিযুক্ত) দলের কর্মী-সমর্থকেরা সে বার বিরোধীদের কাউকেই মনোনয়ন জমা করতে দেননি বলে অভিযোগ। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মঙ্গলডিহি দখল করেছিল তৃণমূল। কিন্তু লোকসভা ভোটের পর থেকেই বিশেষত বোলপুর মহকুমায় ছবিটা পাল্টে যেতে শুরু করে। ইলামবাজার ও পাড়ুই এলাকার বহু তৃণমূল ও সিপিএম কর্মী-সমর্থক সরাসরি বিজেপি-তে যোগ দেন। এক সময়ে ‘মুস্তফার লোক’ বলে পরিচিত সদাইও সেই দলেই পড়ে। ইতিমধ্যে একাধিক বার দু’দলের সংঘর্ষ হয়েছে। বিজেপির দুই কর্মী খুন হয়েছেন। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত।

তৃণমূলের অভিযোগ, গ্রাম দখলের জন্যই বিজেপির লোকেরা সদাই শেখের নেতৃত্বে চৌমণ্ডলপুরে বোমা ও অস্ত্র মজুত করছিল। পুলিশের বাধা পেয়ে বিজেপি গ্রামবাসীদের খেপিয়ে তোলে। বিজেপির জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডল অবশ্য তা উড়িয়ে দিয়ে দাবি করেন, “আমাদের দলের কেউ এই ঘটনায় যুক্ত নন। আমিই বরং খবর পেয়ে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং তার লাগোয়া তৃণমূলের পার্টি অফিসে বোমা মজুত রাখার অভিযোগ জানিয়েছিলাম। তৃণমূলের লোকেরাই পুলিশকে বোমা মেরে বিজেপির ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে।” দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, “কোনও ঘটনায় বিজেপি কর্মী আক্রান্ত হলে তাঁর বিরুদ্ধেই অভিযোগ হয়! বিজেপির উপর দায় চাপানো তৃণমূলের দস্তুর। ঘটনার মোড় ঘোরাতে তৃণমূল বিজেপির নামে অভিযোগ করছে।

এক জনকে পুলিশের গাড়ির চালক সাজিয়ে তাঁকে দিয়ে অভিযোগ করানো হচ্ছে।”

দলীয় নেতৃত্ব ঘটনার দায় অস্বীকার করলেও বিজেপির অন্দরের খবর, তৃণমূল এবং সিপিএম ছেড়ে যারা গেরুয়া শিবিরে যোগ দিয়েছে, তারাই তৃণমূলের মোকাবিলায় অস্ত্র ব্যবহারের কৌশল নিয়েছে। সেই অস্ত্রেরই একাংশ পুলিশের উপর ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু বিজেপি সব সময়ই দাবি করে, তারা অন্য দলগুলির মতো হিংসা বা প্রতিহিংসার রাজনীতি করে না। সে ক্ষেত্রে অন্য দল থেকে বিজেপি-তে এসে এক দল লোক পুলিশকে বোমা মারার মতো গুরুতর অন্যায়ে জড়িয়ে পড়লে দলের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিশেষত, পুরভোট এবং ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে এ হেন ঘটনায় দলের ভাবমূর্তির ক্ষতি হলে ভোটারদের মধ্যে তার প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু এলাকা দখলের জন্য সিপিএম, কংগ্রেস, তৃণমূল এত দিন যা করে এসেছে, বিজেপি-ও কার্যত একই ভাবে দুষ্কৃতী ব্যবহারের পথে হাঁটছে বলে অভিযোগ।

অনুব্রতই যে এক সময়ে পুলিশকে বোমা মারার নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই কথাও কিন্তু এই সুযোগে মনে করিয়ে দিচ্ছেন বিজেপি নেতারা। রাহুলবাবুর দাবি, এ দিনের ঘটনা অনুব্রতর সেই নির্দেশেরই ফলশ্রুতি। তৃণমূল কর্মীরা পুলিশকে আক্রমণ করে অনুব্রতর প্রতি আনুগত্য দেখাতে চেয়েছেন। এর জন্য অনুব্রতকে গ্রেফতারের দাবিও তোলেন তিনি। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় পাল্টা বলেন, “বিরোধীরা পুরনো রেকর্ড বাজিয়ে মূল চক্রান্তকারী, পুলিশের উপর আক্রমণকারীদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে।” যুব তৃণমূল সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “বিজেপি দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাচ্ছে। আইন আইনের পথে চলবে। দোষীরা ছাড়া পাবে না।”

তবে রাজনৈতিক লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে পুলিশকর্মীদের বারবার আক্রাম্ত হওয়া মেনে নিতে পারছেন না তাঁদের পরিবারের লোকজন। গত জুনেই দুবরাজপুরে তৃণমূল-সিপিএম সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে বোমায় জখম হয়ে মারা যান এসআই অমিত চক্রবর্তী। এর পরে খয়রাশোলের লোকপুর ফাঁড়িতে হামলা চালায় তৃণমূল। বোলপুর থানায় ঢুকে পুলিশ পেটানোয় অভিযুক্ত প্রাক্তন যুব তৃণমূল নেতা সুদীপ্ত ঘোষ এখনও অধরা। এ দিনের ঘটনার পরে অমিতের বোন শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায় বলেন, “পুলিশের চাকরিতে ভবিষ্যতে আর কেউ এগিয়ে আসবে না। যাঁদের নিরাপত্তা বলে কিছু নেই, এই ভাবে রাজনীতির শিকার হয়ে তাঁদের আক্রান্ত হতে হচ্ছে। রাজ্য সরকার যদি এখনও কড়া পদক্ষেপ না করে, তা হলে ভবিষ্যতে অনেক পুলিশকর্মীকেই অসহায় ভাবে মরতে হবে।”

mahendra jena dayal sengupta bjp tmc assault police birbhum parui suri
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy