Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বাম জমানাতেও অফিসারদের সরিয়েছে কমিশন

ঘটনাটা ২০০৩ সালের। কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন। নদিয়ার জেলাশাসক কৃষ্ণ গুপ্তকে সরিয়ে দিল নির্বাচন কমিশন। অভিযোগ, আদর্শ আচরণবিধি জারি হয়ে যাওয়ার পরেও তিনি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। কৃষ্ণ গুপ্ত যুক্তি দিয়েছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী ভোটের প্রচারে এসে সার্কিট হাউসে ছিলেন বলে তিনি সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিরোধী দল তৃণমূল অভিযোগ করার পরে সেই যুক্তিতে কান দেয়নি কমিশন।

নবান্ন থেকে বেরিয়ে আসছেন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র। মঙ্গলবার সুমন বল্লভের তোলা ছবি।

নবান্ন থেকে বেরিয়ে আসছেন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র। মঙ্গলবার সুমন বল্লভের তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:০৫
Share: Save:

ঘটনাটা ২০০৩ সালের। কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন। নদিয়ার জেলাশাসক কৃষ্ণ গুপ্তকে সরিয়ে দিল নির্বাচন কমিশন। অভিযোগ, আদর্শ আচরণবিধি জারি হয়ে যাওয়ার পরেও তিনি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। কৃষ্ণ গুপ্ত যুক্তি দিয়েছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী ভোটের প্রচারে এসে সার্কিট হাউসে ছিলেন বলে তিনি সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিরোধী দল তৃণমূল অভিযোগ করার পরে সেই যুক্তিতে কান দেয়নি কমিশন। ওই আমলাকে দিল্লিতে পশ্চিমবঙ্গের রেসিডেন্ট কমিশনার পদে বদলি করে দেওয়া হয়।

ভোটের মুখে আইএএস-আইপিএস অফিসারদের বদলি করে দেওয়ার ঘটনা তাই পশ্চিমবঙ্গে নতুন নয়। ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচন, ২০০৬ এবং ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচন প্রত্যেক ক্ষেত্রেই রাজ্যের বেশ কিছু আইএএস-আইপিএস অফিসারকে বদলি করেছে নির্বাচন কমিশন। ইতিহাস বলছে, সেই সময়ে অনেক আমলার বিরুদ্ধেই পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলেছিল তৎকালীন বিরোধী দল তৃণমূল। আর কমিশনের নির্দেশে অফিসারেরা বদলি হলে বাম নেতারাও তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সিপিএম নেতাদের অবশ্য দাবি, জ্যোতি বসু, অনিল বিশ্বাস থেকে বর্তমান রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু এঁরা বিভিন্ন সময়ে কমিশনকে নিশানা করেছেন ভোট পরিচালনার প্রক্রিয়া নিয়ে। পুলিশ-প্রশাসনের অফিসারদের বদলি নিয়ে নয়। দলীয় নেতা রবীন দেবের বক্তব্য, “বাম সরকার কোনও দিনই এ সব নিয়ে কমিশনের সঙ্গে সাংবিধানিক সংঘাতে চলে যায়নি।”

অফিসারদের বদলি নিয়ে বাম নেতৃত্বের সঙ্গে কমিশনের মতান্তর এখনকার মতো চরমে পৌঁছয়নি ঠিকই, কিন্তু একাধিক বার বিবাদ-বিতর্ক বেধেছে ভোট পরিচালনা ঘিরে। প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার টি এন শেষন সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র তৈরির কাজ শুরুর পরে রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে তাঁর সংঘাত বাধে। জ্যোতিবাবু সেই সময় শেষনকে ‘মেগালোম্যানিয়াক’ পর্যন্ত বলেছিলেন। ২০০৪-এর লোকসভা নির্বাচনের পর্যবেক্ষকদের কলার ধরে থানায় হাজির করার ডাক দিয়েছিলেন বিমানবাবু। সেই সময়ে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসার ছিলেন বর্তমান স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যে ছিলেন কমিশনের বিশেষ পর্যবেক্ষক আফজল আমানুল্লা। ওই হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যের ভোট প্রক্রিয়া যে বানচাল হয়ে যেতে পারে, তা নিয়ে কমিশনকে রিপোর্ট দিয়েছিলেন বাসুদেববাবু। আমানুল্লা তাঁর রিপোর্টে রাজ্যে ভোট স্থগিত করার সুপারিশ করেছিলেন। কমিশন তা মেনে নিয়ে ভোট স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েও ফেলেছিল। কিন্তু তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নরম মনোভাব নেওয়ায় সে যাত্রায় রক্ষা পাওয়া যায়। কমিশন অবশ্য বিমানবাবুর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিল।

প্রয়াত অনিল বিশ্বাস তখন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক। বিধানসভা নির্বাচনে বাইরে থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনী এনে ভোট করানো নিয়ে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের বিরোধ চরমে ওঠে। রাজ্য পুলিশকে সে বারই প্রথম ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের আশেপাশে ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি। এ জন্য জ্যোতিবাবু কমিশনকে আক্রমণ করেছিলেন। অনিল বিশ্বাস কটাক্ষ করে বলেছিলেন, “কমিশন সবাইকে রাজ্যের বাইরে থেকে নিয়ে আসতে পারে। শুধু ভোটাররা এ রাজ্যের হলেই হল!”

ঘটনা হল, মতান্তরের বিষয়বস্তু যা-ই হোক, প্রত্যেক বারই কমিশনের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল বাম সরকার। বর্তমান ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে যে কথা বলতে গিয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা আরও এক বার মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, ভোট পরিচালনার ক্ষেত্রে কমিশনই শেষ কথা।

বাম জমানায় যেমন শুধু বিরোধী দলের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নয়, অনেক সময়ে ভোট পরিচালনার নিয়ম মানতে গিয়েও পুলিশ-প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের বদলি করেছে নির্বাচন কমিশন। ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগেই কলকাতার পুলিশ কমিশনারের পদ থেকে গৌতমমোহন চক্রবর্তীকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কমিশন জানিয়েছিল, ওই পদে তিন বছর হয়ে গিয়েছিল গৌতমমোহনের। সিপিএমের এক নেতার বক্তব্য, “বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রিয় পাত্র হিসেবেই পরিচিত ছিলেন গৌতমমোহন। তা সত্ত্বেও কিন্তু রাজ্য প্রশাসন এ নিয়ে কোনও আপত্তি তোলেনি।”

গৌতমমোহনকে সরানোর দু’সপ্তাহের মধ্যেই পাঁচ জন আইপিএস এবং দু’জন আইএএস অফিসারকে বদলি করে নির্বাচন কমিশন। এঁদের মধ্যে পুলিশ সুপার, ডিআইজি, যুগ্ম-কমিশনার পদের পুলিশকর্তা যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন বর্ধমানের ডিভিশনাল কমিশনার, মালদহের জেলাশাসকও। এর পর পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার অজিত সরকারকেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তৃণমূলের অভিযোগের ভিত্তিতেই সরানো হয় তাঁকে। সিপিএম নেতারা তখন বদলির কারণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।


সবিস্তার...

২০০৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগেও তিন জন আইপিএস অফিসারকে বদলি করা হয়েছিল। মালদহ রেঞ্জের ডিআইজি গৌরব দত্ত, উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার বাসুদেব বাগ এবং নদিয়ার পুলিশ সুপার বিনয় চক্রবর্তীর বদলি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন জ্যোতি বসু। বলেছিলেন, এই তিন জনের বদলির পিছনে কোনও কারণ দেখানো হয়নি। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী এ নিয়ে প্রস্তাবও পাশ করেছিল।

সূত্রের খবর, চলতি ঘটনাক্রমেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা মনে করিয়ে দিয়েছেন টি এন শেষনের আমলের একটি ঘটনার কথা। ওই সময়ে কর্নাটক সরকারও কমিশনের নির্দেশে রাজ্যের অফিসারদের বদলি মানতে চায়নি। শেষন তখন রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে কর্নাটকে ভোট করাতে চেয়েছিলেন। সেই কথা জেনে কর্নাটক সরকার শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে গিয়েছিল।

বদলি-বিতর্ক নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রীকে আজ বিঁধেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। তিনি বলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বিরোধী নেত্রী ছিলেন, সে দিনের কথাটা আজ স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। ভোটের আগে পক্ষপাতদুষ্ট আমলাদের সরানোর ব্যাপারে তিনি তখন সবচেয়ে সরব হতেন। সে সময় বামেরা যে বুলি আওড়াত, এখন দেখছি তিনি সে সব কথাই বলছেন!” অধীরবাবুর দাবি কমিশন পুলিশকর্তা হুমায়ুন কবীরকে বদলির নির্দেশ দেওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী বলছেন যে, তাঁকে (অধীরবাবু) রিগিংয়ের সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই এই ব্যবস্থা। অথচ বাম আমলে সেই হুমায়ুনই যখন উত্তর ২৪ পরগনার দায়িত্বে ছিলেন, তখন মমতা নিজে বারবার ওই পুলিশকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির বক্তব্য, “এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, অধীর চৌধুরীর বারোটা বাজানোর জন্যই হুমায়ুনকে মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার করেছিলেন মমতা।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

votebadyi election commission mamata bandyapadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE