পরিবহণ শিল্পের সমস্যা খতিয়ে দেখতে নজিরবিহীন ভাবে সর্বদলীয় কমিটি গঠন করল রাজ্য সরকার। যার আড়ালে ঘুর পথে বাস ভাড়া বাড়ানোর ইঙ্গিতই দেখছেন রাজনীতিকদের অনেকে।
দফায় দফায় জ্বালানির দাম বেড়ে চলা সত্ত্বেও বাস ভাড়া কেন দু’বছর ধরে একই জায়গায় আটকে রয়েছে, এই প্রশ্নে চাপ রয়েছে রাজ্য সরকারের উপরে। বিষয়টি নিয়ে বাস মালিকরা একাধিক বার আন্দোলন এবং ধর্মঘটের কথা বললেও শেষ পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে আলোচনা শেষ পিছিয়ে এসেছেন। এই দফায় তাঁরা ২৫ জুন থেকে ফের লাগাতার তিন দিন ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন। ভাড়া বাড়ানো যে জরুরি, সেটা শাসক দলের একটি অংশও বোঝে। কিন্তু জনপ্রিয় রাজনীতির জন্য শেষ পর্যন্ত দলীয় নেতৃত্ব এই পথ মাড়াতে চান না।
এ দিনও পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র বাস ভাড়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, “বাসভাড়া বাড়ানোর জন্যই কমিটি তৈরি হচ্ছে না। বেসরকারি বাস মালিকেরা অনেক দিন ধরেই ভাড়া বৃদ্ধির দাবি জানাচ্ছেন। সমস্যা বুঝতে সব দলের মতামত চাইছি।” সেই সঙ্গে তিনি যোগ করেন, “তবে কমিটি বাসভাড়া বাড়ানোর সুপারিশ করলে সরকার তা মানতেও পারে।”
এ রাজ্যে ২০১২ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে শেষ বার বাসের ভাড়া বাড়িয়েছিল সরকার। তখন লিটার প্রতি ডিজেলের দাম ছিল ৫০.৭৮ টাকা। তার পর প্রায় দু’বছরে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে কুড়ি শতাংশ। বর্তমানে কলকাতায় লিটার-পিছু ডিজেলের দাম ৬১.৩৮ টাকা। তেলের দাম লাফিয়ে বাড়ায় বাস মালিকরা বারবার ভাড়া বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন। তাঁদের যুক্তি, ভাড়া না বাড়ালে বাস চালানোই কঠিন হয়ে পড়বে। তার পরেও সরকার ভাড়া না-বাড়ানোর সিদ্ধান্তে অনড় থাকায় গত দেড় বছরে রাস্তায় বেসরকারি বাস-মিনিবাসের সংখ্যা অর্ধেকেরও কম হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই হাল সরকারি বাসেরও। দিনে কিছু চললেও সন্ধ্যার পর উধাও হয়ে যায় বাস। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। পরিবহণ দফতরের কর্তারাও মনে করেন, সরকারি নিগমগুলিকে রুগ্ণ অবস্থা থেকে বের করে আনতে ভাড়া বাড়ানো দরকার। তবু বাস ভাড়া বাড়ালে সাধারণ মানুষের উপর বাড়তি চাপ পড়বে এই যুক্তিতে মুখ্যমন্ত্রী একক ভাবে ভাড়া বাড়াতে রাজি হননি। উল্টে মালিকদের ধর্মঘট তাঁর সরকার ভেস্তে দিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে বুধবার সর্বদল কমিটি গঠনের ঘোষণা ভাড়া বাড়ানোর অনিবার্যতাকে মেনে নেওয়া বলেই মনে করছে রাজনৈতিক দল ও প্রশাসনের একাংশ। তাদের মতে, আর কোনও পথ নেই বুঝে ঘুরপথে মান বাঁচানোর চেষ্টা করছে রাজ্য। বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, “সরকার বিরোধীদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে গুলি চালাতে চায়। এই সিদ্ধান্তে এক দিক থেকে সরকারের অযোগ্যতাই প্রমাণিত হয়।” তাঁর কটাক্ষ, “রাজ্যে কী ভাবে শিল্প আসবে বা সন্ত্রাস বন্ধ করা যাবে, তাই নিয়ে বারবার বলা সত্ত্বেও সরকার সর্বদল বৈঠক ডাকেনি। এখন বেকায়দায় পড়ে বাসভাড়া নিয়ে অন্য দলকে ডাকছে।” নবান্নের এক কর্তাও মনে করিয়ে দেন, এর আগে বিদ্যুৎ এবং দুধের ক্ষেত্রে ঘোষণা না করেও ঘুরপথে দাম বাড়ানো হয়েছে। এ বারেও হয়তো তাই হবে।
আজ পরিবহণ ভবনে বাস মালিকদের সঙ্গে বৈঠকের পরে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র জানান, সর্বদলীয় কমিটিতে তিনি ছাড়াও থাকবেন রাজ্যের নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, শিক্ষামন্ত্রী ও পরিবহণ সংক্রান্ত মন্ত্রিগোষ্ঠীর প্রধান পার্থ চট্টোপাধ্যায়, আবাসন ও যুবকল্যাণ দফতরের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, বিধানসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের মুখ্যসচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। মদনবাবু বলেন, “কমিটিতে কংগ্রেস, এসইউসিআই এবং সিপিএমের এক জন করে বিধায়ককে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিধায়কদের কমিটি বলে বিজেপি নেই। কংগ্রেসের পরিষদীয় দলের নেতা মহম্মদ সোহরাব জানান, তাঁদের মানস ভুঁইয়া থাকবেন। এসইউসি-র পক্ষে থাকবেন বিধায়ক তরুণ নস্কর। সিপিএম কী করবে, তা পরে জানাবে দল।” মদনবাবু বলেন, “মালিকেরা সর্বদলের সামনে বলবেন। অন্য সদস্যরাও বলবেন। সব বিচার-বিবেচনা করে কমিটি এক মাসের মধ্যে তাদের সুপারিশ করবে।”
বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন বলেন, “প্রস্তাব পেয়েছি। আমরা সময় চেয়েছি। কমিটি কী করবে, তাতে সদস্যদের ভূমিকাই বা কী হবে তা নিয়ে দলে বিস্তারিত আলোচনার পরেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানাব।” কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া বলেন, “কিন্তু এ ব্যাপারে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার দল নেবে।”
বাস ভাড়া বাড়লে প্রথমেই যাঁরা আন্দোলনে নামেন, সেই এসইউসি-র বিধায়ক তরুণ নস্কর অবশ্য সর্বদলীয় কমিটি গড়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁর মতে, “বৈঠকে সরকার তাদের মতামত জানালে আমাদের মতামতও জানানো হবে।” সরকারের সর্বদল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনও মন্তব্য করেনি বাস মালিক সংগঠনগুলি। তাদের নেতা তপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমরা মন্ত্রীর কথা শুনেছি। তাঁর বক্তব্য নিয়ে ২১ জুন বৈঠক করব। সেখানেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।” কিন্তু ২৫ থেকে লাগাতার তিন দিন বাস ধর্মঘট কি হবে? তপনবাবু জানান, সেটাও ২১ তারিখের বৈঠকে ঠিক হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy