জেলে পা দিয়েই চোখে অন্ধকার দেখেছিলেন। বুকে চিনচিনে ব্যথা। পত্রপাঠ তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছিল এসএসকেএমের কার্ডিওলজি বিভাগের ঠান্ডা কেবিনে। কথা ছিল, শনিবারই মেডিক্যাল বোর্ড গঠন হবে মদন মিত্রের জন্য। বাস্তবে এ দিন সেই বোর্ড তৈরিই হল না। ডাক্তাররা বলছেন, সোমবার নাকি তা হলেও হতে পারে। তার আগে শনিবার মদনের কেবিনের ভিতরে-বাইরে যে ছবি দেখা গেল, তাতে একটা বিষয় স্পষ্ট। খাতায়-কলমে যতই তিনি সারদা-কাণ্ডে ‘জেলবন্দি’ হন, এসএসকেএমের উডবার্ন ওয়ার্ড আপাতত মদন মিত্রের আম-দরবার। আক্ষরিক অর্থেই খোলা হাট!
কলকাতা পুলিশের উর্দিধারীরা নামেই রয়েছেন। শনিবার সারাদিন যে পেরেছেন মদনের কেবিনে ঢুকেছেন। বাড়ির লোকেরা তো ছিলেনই, ‘দাদার’ ভক্তরাও ছিলেন। যাঁরা শুক্রবার মদনের জেল হেফাজত হওয়ায় রীতিমতো উল্লাস করেছিলেন। কারণ, নিজের খাসতালুক এসএসকেএমে মদন যে অনেকটা ‘খোলামেলা থাকবেন, তা নিয়ে কারও মনেই সংশয় ছিল না। শনিবার সকালে কার্ডিওলজি বিভাগ থেকে মদনকে উডবার্ন ওয়ার্ডে সরানোর পর হয়েছেও তাই।
হাসপাতালে ভর্তি কোনও জেলবন্দির সঙ্গে কি সাধারণ রোগীর মতোই ইচ্ছেমতো দেখা করা যায়? প্রশ্নটা তুলতে সকলেই দায় এড়িয়েছেন। এসএসকেএমের সুপার প্রদীপ মিত্রের দাবি, “জেল হেফাজতে থাকা রোগী হাসপাতালে থাকার সময়ে তাঁর ঘরে কে ঢুকছে বা তাঁর নিরাপত্তার কী ব্যবস্থা হয়েছে তা দেখার দায়িত্ব পুলিশ ও জেল কর্তৃপক্ষের। আমরা দায়িত্ব নেব কেন? হাসপাতালের কাজ
চিকিৎসা পরিষেবা দেখা। সেটুকুই দেখছি এবং দেখব।” জেল কর্তৃপক্ষের একটি সূত্রের বক্তব্য, “যত ক্ষণ এক জন বন্দি জেলে আছেন, তত ক্ষণ পাহারার দায়িত্ব আমাদের। মন্ত্রী হাসপাতালে ভর্তি, তাই নিরাপত্তার বিষয়টি দেখছে কলকাতা পুলিশ।”
পুলিশ কী বলছে?
কিছুই না! কলকাতা পুলিশের ডিসি (আরএফ) অশেষ বিশ্বাস প্রশ্নটা ভাল করে শুনে নিয়েও কোনও মন্তব্য করতে চাননি। যুগ্ম কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্র ফোন ধরেননি, এসএমএস-এরও উত্তর দেননি। তবে পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, আগের বারের চেয়ে এ বার মদনের ২০ নম্বর কেবিন ঘিরে অনুগতদের সংখ্যা কম।
গ্রেফতার হওয়ার দিন কয়েক আগে ‘পাঁচ মিনিটে আসছি’ বলে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে মদন চুপিচুপি চলে এসেছিলেন এসএসকেএমে। হাজার পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরেও তেমন কিছু ধরা পড়েনি। তবে তৃণমূল সাংসদ সৃঞ্জয় বসু গ্রেফতার হওয়ার পর বলেছিলেন, “মনে হচ্ছে যেন কেউ গলা টিপতে আসছে।” বিরোধীরা বলেছিলেন, গ্রেফতারি এড়াতেই এসএসকেএমে ঘাঁটি গেড়েছেন মদন। এ বারও তাঁদের (সেই সঙ্গে এসএসকেএমের চিকিৎসকদের একাংশেরও) বক্তব্য, মদনের নতুন করে বড় কোনও সমস্যা ধরা পড়েনি। পুরনো সমস্যাই বাড়ছে-কমছে। কিন্তু এটা জানাজানি হলে তাঁকে বেশি দিন হাসপাতালে ভর্তি রাখা যাবে না জেনেই মেডিক্যাল বোর্ড গঠন পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
তবে কি বোর্ড গঠনের প্রয়োজন নেই? অধ্যক্ষ প্রদীপ মিত্রের বক্তব্য, “যাঁর তত্ত্বাবধানে রোগী রয়েছেন, সেই চিকিৎসক না বলা পর্যন্ত মেডিক্যাল বোর্ড হবে না। শিবানন্দবাবু (হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ শিবানন্দ দত্ত) এখনও বোর্ডের ব্যাপারে কিছু জানাননি।” শনিবার মদনবাবুর জন্য মেডিক্যাল বোর্ড গড়ার কথা শিবানন্দবাবুই জানিয়েছিলেন। তিনি এ দিন বলেছেন, “সব আমাদের হাতে নেই। এর মধ্যে অনেক প্রশাসনিক ব্যাপার থাকে। তবে সোমবার বোর্ড হবে। মন্ত্রীর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। সে সব শেষ না হলে বোর্ড তৈরি করে লাভ নেই।” কেন সোমবার? শিবানন্দবাবুর বক্তব্য, মেডিক্যাল বোর্ড বিভিন্ন পরীক্ষার রিপোর্ট দেখেই সিদ্ধান্ত নেবে। সোমবারের মধ্যে মদনের সেই পরীক্ষাগুলো হয়ে যাবে।
মদন আছেন কেমন?
এ ক্ষেত্রে শিবানন্দবাবু ও অধ্যক্ষ একসুরে দাবি করেছেন, মদনের শারীরিক অবস্থা বেশ খারাপ। রক্তচাপ বেড়েছে (১৫৫/৯৫)। এমনিতেই তিনি ‘প্যানিক অ্যাটাক’-এর রোগী। গত ক’দিনে মানসিক চাপ আরও বেড়েছে। এবং এ বারও মদন বলছেন, কেউ যেন তাঁর গলা কেউ টিপে ধরছে! তার উপর ফুসফুসের সমস্যা, ডায়াবেটিস, অনিদ্রা রোগ রয়েছে। অতএব ক’দিন তাঁর পূর্ণ শারীরিক ও মানসিক বিশ্রাম প্রয়োজন। অধ্যক্ষের আরও দাবি, “মন্ত্রীর হৃৎপিণ্ডে রক্ত চলাচলের হার কিছুটা কম। ফলে হৃদযন্ত্রে কম অক্সিজেন যাওয়ায় তাঁর দম নিতে অসুবিধে হচ্ছে।” হাসপাতাল সূত্রের খবর, এ দিন দুপুর প্রায় দেড়টা পর্যন্ত ঘুমিয়েছেন মদন। মাঝে এক বার গ্রিন টি খেয়েছেন। বিকেলে ডেপুটি সুপার সর্বেশ্বর মণ্ডল-সহ কয়েক জন তাঁকে দেখতে যান। তাঁদেরও মন্ত্রী জানান, শ্বাসের সমস্যা হচ্ছে, গলা আটকে আসছে, বুকে মাঝে মাঝেই চাপ লাগছে।
এই অবস্থায় অনেকেরই প্রশ্ন, এমন ‘গুরুতর’ অসুস্থ, তার ওপর জেলবন্দি রোগীর ঘরে দিনভর এত ভিড় কেন? অধ্যক্ষ পুলিশকে দেখাচ্ছেন, পুলিশের মুখে কুলুপ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy