Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

বন্ধ কারখানা বাড়াচ্ছে গরিবি, আক্ষেপ খাদ্যমন্ত্রীর

পশ্চিমবঙ্গের শিল্প-চিত্রকে যতটা উজ্জ্বল করে মুখ্যমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রী বা শ্রমমন্ত্রী তুলে ধরতে চাইছেন, খাদ্যমন্ত্রী কিন্তু বাস্তব ছবিটাকে ততটা উজ্জ্বল দেখছেন না। বরং রাজ্যে বিপিএল-তালিকার পাল্লা যে ভাবে ভারী হচ্ছে, তার পিছনে কল-কারখানা বন্ধের ভূমিকাকেই বড় করে দেখছেন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। যা কি না অস্বস্তির কাঁটা হয়ে সরকারকে বিলক্ষণ বিঁধতে পারে।

কাজী গোলাম গউস সিদ্দিকী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:০৪
Share: Save:

পশ্চিমবঙ্গের শিল্প-চিত্রকে যতটা উজ্জ্বল করে মুখ্যমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রী বা শ্রমমন্ত্রী তুলে ধরতে চাইছেন, খাদ্যমন্ত্রী কিন্তু বাস্তব ছবিটাকে ততটা উজ্জ্বল দেখছেন না। বরং রাজ্যে বিপিএল-তালিকার পাল্লা যে ভাবে ভারী হচ্ছে, তার পিছনে কল-কারখানা বন্ধের ভূমিকাকেই বড় করে দেখছেন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। যা কি না অস্বস্তির কাঁটা হয়ে সরকারকে বিলক্ষণ বিঁধতে পারে।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র দাবি করে চলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের শিল্পক্ষেত্রে যথেষ্ট বিনিয়োগ হচ্ছে। শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটকও সম্প্রতি দাবি করেছেন, গত দু’বছরে রাজ্যে কোনও কারখানায় লক-আউট হয়নি। শ্রমমন্ত্রীর মতে, যা হয়েছে, তা হল ‘সাসপেনশন অব ওয়ার্ক’, আর তারও ৯৫% ক্ষেত্রে কারখানা ফের চালু হয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের হিসেব অবশ্য সে রকম বলছে না। বিভিন্ন বণিকসভার প্রতিনিধিরাও মমতা সরকারের শিল্প-বান্ধব ভাবমূর্তি নিয়ে নানা সময়ে ঘোর সংশয় প্রকাশ করেছেন।

এ বার তাঁদের চেয়ে কার্যত কয়েক ধাপ এগিয়ে মমতা সরকারের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয়বাবু জানিয়ে দিলেন, রাজ্যে চাকরি নেই। তাঁর ব্যাখ্যা: এখানে কল-কারখানা বন্ধ হয়ে বহু লোক বেকার হয়ে গিয়েছেন। ফলে গত ক’বছরে দারিদ্রসীমার উপরে (এপিএল) থাকা ৫৮ লক্ষ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে (বিপিএল) চলে গিয়েছেন। তৃণমূল সরকারের অবস্থানের পরিপন্থী কথাবার্তা বলে সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সাধন পাণ্ডের মতো দলীয় মন্ত্রী ও সুগত বসু-সৌগত রায়ের মতো সাংসদ সম্প্রতি নেতৃত্বকে অস্বস্তিতে ফেলেছেন। তার পরে খাদ্যমন্ত্রীর এই জাতীয় পর্যবেক্ষণ নবান্নের শীর্ষ মহলের বিড়ম্বনা আরও বাড়াবে বলে প্রশাসনের একাংশের ধারণা।

জ্যোতিপ্রিয়বাবু কোন প্রসঙ্গে এমন কথা বললেন?

বিষয়টা ছিল খাদ্য-সুরক্ষা আইন। জ্যোতিপ্রিয়বাবু জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে বিপিএল-তালিকাভুক্ত রেশনকার্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩ কোটি ৩০ লক্ষ। সম্প্রতি রাজ্য সরকারের তত্ত্বাবধানে রাজ্যের আর্থ-সামাজিক ও জাতিগত পরিস্থিতি সম্পর্কে চালানো এক সমীক্ষার খসড়ায় প্রকাশ, এপিএল-তালিকায় থাকা ৫৮ লক্ষ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে চলে গিয়েছেন। অর্থাৎ, সংখ্যাটি এখন বেড়ে ৩ কোটি ৮৮ লক্ষ। সরকারের এক মুখপাত্র জানান, রাজ্য সরকারগুলিকে এই সমীক্ষা চালাতে বলেছে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক। ফলে এই রিপোর্টও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের অনুমোদন সাপেক্ষ।

এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন ওঠার পরে মন্ত্রীর মন্তব্য, “কারখানা বন্ধ হয়ে, চাকরি খুইয়ে বহু মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে চলে গিয়েছেন।” তাঁর হিসেবে, বন্ধ কারখানার মধ্যে চটকল ও চা-বাগানও রয়েছে। “এই ৫৮ লক্ষ মানুষকে বিপিএল কার্ড দিয়ে খাদ্য-সুরক্ষা আইনের আওতায় ঢোকানো হবে।” ঘোষণা করেন খাদ্যমন্ত্রী। তিনি আরও জানান, বিভিন্ন জেলার খসড়া রিপোর্ট এবং জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জি থেকে উঠে আসা তথ্যের ভিত্তিতেই তিনি এ কথা বলছেন।

শিল্প-বাণিজ্য মহলের বড় অংশের আক্ষেপ, মমতা-সরকারের জমি-নীতির বাধায় পশ্চিমবঙ্গে বড় শিল্পে তো বটেই, মাঝারি ও ছোট শিল্পেও লগ্নি মার খাচ্ছে। সঙ্গে জুড়েছে রাজ্যের সামগ্রিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, শাসকদলের প্রত্যক্ষ মদতে সিন্ডিকেট-কারবারের রমরমা কিংবা পদে পদে ‘কাট মানি’র চাহিদা। এত প্রতিকূলতার মুখে পড়ে বহু শিল্প-কারখানা ঝাঁপ বন্ধ করে রাজ্য থেকে পাততাড়ি গুটিয়েছে বলে অভিযোগ। রাজ্য সরকারের এই নেতিবাচক শিল্প-ভাবমূর্তি নিয়ে বিরোধীরাও সরব। তাঁদের দাবি, ফি বছর ঘটা করে শিল্প সম্মেলন বা বিজয়া সম্মেলনীর ডেকে, এমনকী শিল্পমন্ত্রী বদল করেও পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী বন্দারু দত্তাত্রেয় কয়েক দিন আগে কলকাতায় এসে বলে গিয়েছেন, লক-আউটের সংখ্যার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ এখন দেশের শীর্ষে। রাজ্যের শিল্প-দুরবস্থার অবস্থার জন্য মোদী সরকারের উদ্বেগের কথাও তিনি জানিয়ে গিয়েছেন।

বাস্তবের এ হেন প্রেক্ষাপটে জ্যোতিপ্রিয়বাবুর মন্তব্য স্বভাবতই নজর কেড়েছে। সরকার-ঘনিষ্ঠ এক অর্থনীতিবিদ অবশ্য খাদ্যমন্ত্রীর কারখানা বন্ধের তত্ত্ব পুরোপুরি মানতে নারাজ। বিপিএলের সংখ্যাবৃদ্ধির অন্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি। কী রকম?

ওঁর দাবি, বাম আমলে সরকারি উদ্যোগে রাজ্যে শেষ যে যে আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা হয়েছিল, তাতে হিসেবে বিস্তর গণ্ডগোল ছিল। এ বার অনেক সতর্ক হয়ে কাজ হয়েছে। ফলে এমন বহু বিপিএল পরিবারের নাম তালিকাভুক্ত করা গিয়েছে, যারা আগের বার বাদ পড়ে গিয়েছিল। ওই অর্থনীতিবিদের আরও যুক্তি, সরকারি সমীক্ষার ভিত্তিতে যে বিপিএল কার্ড পাওয়া যাবে, গত বার বহু লোক তা জানতেনই না। এখন সিংহভাগ সে সম্পর্কে সচেতন, আর সে ভাবেই তাঁরা পরিবারের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন। “আমার মনে হয়, এ সব কারণে বিপিএলের সংখ্যা বেড়েছে।” বলছেন তিনি।

খাদ্য দফতরের খবর: কেন্দ্রীয় নির্দেশ মেনে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০১৫-র এপ্রিলে রাজ্যে খাদ্য-সুরক্ষা আইন কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আইনটির মূল কথা, শহরাঞ্চলের ৫০% ও গ্রামাঞ্চলের ৭৫% পরিবারকে খাদ্য-সুরক্ষা দেওয়া হবে। অর্থাৎ, পরিবারগুলোকে রেশন মারফত চাল-গম মিলিয়ে মাসে ৩৫ কেজি খাদ্য জোগানো হবে। পশ্চিমবঙ্গে এখন রেশনকার্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৯ কোটি ৩০ লক্ষ। কেন্দ্রীয় আইন কার্যকর হলে এঁদের ছ’কোটি খাদ্য-সুরক্ষা পাবেন। কারা বাদ যাবেন, সে সম্পর্কে দিল্লি কোনও নির্দেশিকা দেয়নি বলে জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE