Advertisement
২৪ মে ২০২৪

ভোটের আগেই বহিষ্কৃত বিদ্রোহী

বিধানসভা ভোটে দলের ভরাডুবির পরে প্রকাশ্যে তোপ দেগেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যদের প্রতি। দলীয় নেতৃত্বের প্রতি আক্রমণের মাত্রা দিনকে দিন বেড়েছে। এমনকী, নতুন ‘সামাজিক ন্যায়বিচার মঞ্চ’ গড়ে ২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটে লড়ার কথাও ঘোষণা করেন সম্প্রতি। এই পরিস্থিতিতে আব্দুর রেজ্জাক মোল্লাকে লোকসভা ভোটের আগেই দল থেকে ছেঁটে ফেলল সিপিএম। দলবিরোধী কার্যকলাপ ও দলের ভাবমূর্তিকে জনসমক্ষে হেয় করার যুক্তি দেখিয়ে ক্যানিং পূর্বের বিধায়কের সঙ্গে ৪৫ বছরের সম্পর্কে ইতি টানল তারা।

বহিষ্কারের খবর শোনার পর মিষ্টি মুখ। কুষ্ঠিয়া হাউসিংয়ের বাড়িতে। ছবি: প্রদীপ আদক।

বহিষ্কারের খবর শোনার পর মিষ্টি মুখ। কুষ্ঠিয়া হাউসিংয়ের বাড়িতে। ছবি: প্রদীপ আদক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১৬:২৩
Share: Save:

বিধানসভা ভোটে দলের ভরাডুবির পরে প্রকাশ্যে তোপ দেগেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যদের প্রতি। দলীয় নেতৃত্বের প্রতি আক্রমণের মাত্রা দিনকে দিন বেড়েছে। এমনকী, নতুন ‘সামাজিক ন্যায়বিচার মঞ্চ’ গড়ে ২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটে লড়ার কথাও ঘোষণা করেন সম্প্রতি। এই পরিস্থিতিতে আব্দুর রেজ্জাক মোল্লাকে লোকসভা ভোটের আগেই দল থেকে ছেঁটে ফেলল সিপিএম। দলবিরোধী কার্যকলাপ ও দলের ভাবমূর্তিকে জনসমক্ষে হেয় করার যুক্তি দেখিয়ে ক্যানিং পূর্বের বিধায়কের সঙ্গে ৪৫ বছরের সম্পর্কে ইতি টানল তারা।

বুধবার আলিমুদ্দিনে দীর্ঘ বৈঠক হয় সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর। সেখানে সব নেতা-ই রেজ্জাকের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে মত দেন। কারণ, বহু বার সতর্ক এবং ভর্ৎসনা করার পরেও রেজ্জাককে থামানো যায়নি। সদ্য সমাপ্ত রাজ্যসভা নির্বাচনে বুদ্ধবাবুর পছন্দের ছাত্র-নেতা ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রার্থী করায় দলকে তোপ দেগে বিবৃতি পর্যন্ত জারি করেছিলেন টানা ৯ বারের বিধায়ক। সম্প্রতি একটি ইংরেজি দৈনিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই বর্ষীয়ান নেতা দলের পলিটব্যুরোর সদস্যদের দালাল বলে পর্যন্ত আখ্যা দেন। সিপিএম নেতৃত্বের অভিযোগ, ওই সাক্ষাৎকারে পলিটব্যুরো সদস্যদের চরিত্রহননের চেষ্টাও হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার বৈঠকে তাঁকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী। তার পরেই দলের তরফে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, ‘গুরুতর পার্টি-বিরোধী কার্যকলাপ ও পার্টির ভাবমূর্তিকে জনসমক্ষে হেয় করার অভিযোগে অভিযুক্ত কমরেড রেজ্জাক মোল্লাকে পার্টি গঠনতন্ত্রের ১৯ নম্বর ধারার ১৩ নম্বর উপ-ধারায় পার্টি থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

বস্তুত, নিজের কার্যকলাপকে যে জায়গায় নিয়ে চলে গিয়েছিলেন রেজ্জাক, তার পরিপ্রেক্ষিতে দলের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে উঠছিল। ঘনিষ্ঠ মহলে রেজ্জাক বারবার বলছিলেন, দলই তাঁকে ছেঁটে ফেললে তিনি মুক্তি পান! সে ক্ষেত্রে তিনি নিজের মতো চলতে পারবেন, কোনও পিছুটান কাজ করবে না। সিপিএম নেতৃত্বই বরং বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখছিলেন। লোকসভা ভোটে সিপিএমের ফল দেখে রেজ্জাক চূড়ান্ত পদক্ষেপ করবেন, এমন জল্পনাও শুরু হয়েছিল। কিন্তু তাঁর সাম্প্রতিক কাজকর্মের নিরিখে দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেই প্রশ্ন উঠছিল, তা হলে কি কমিউনিস্ট পার্টিতে শৃঙ্খলার কোনও গুরুত্ব নেই? যে যার মতো তোপ দেগে বা বিদ্রোহ ঘোষণা করলেও দলীয় নেতৃত্ব কড়া সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না? দলে রাশ আলগা হয়ে আসার আশঙ্কা থেকেই এ দিন তড়িঘড়ি রেজ্জাককে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিতে হল বলেও সিপিএমের একটি সূত্রের ব্যাখ্যা। শিয়রে লোকসভা ভোট এবং রেজ্জাক দলের অন্যতম সংখ্যালঘু মুখ জেনেও!

রেজ্জাক অবশ্য তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই বহিষ্কারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন! বলেছেন, “মোস্ট ওয়েলকাম!” তাঁর বাড়িতে মিষ্টিমুখও হয়েছে! রেজ্জাক বলেছেন, “এখনও বলছি, আমি বামপন্থার বিরুদ্ধে নই। আমি ভেজাল বামপন্থীদের বিরুদ্ধে!” সিপিএম বহিষ্কার করে দেওয়ায় আপাতত দলহীন বিধায়ক হিসাবে থেকে যেতে পারবেন রেজ্জাক। দলত্যাগ-বিরোধী আইন তাঁর উপরে কার্যকর হবে না। তবে রেজ্জাক ইঙ্গিত দিয়েছেন, কয়েক দিনের জন্য তিনি দিল্লি যাচ্ছেন। সেখান থেকে ফিরে নীতিগত কারণে বিধায়ক-পদ থেকে ইস্তফা দেওয়া উচিত কি না, ভেবে দেখবেন। সিপিএম তাঁকে বার করে দিলেও লোকসভা ভোটে তাঁর মঞ্চ প্রার্থী দেবে না বলেই জানান তিনি। রেজ্জাককে গুরুত্ব দিতে না চেয়ে সিপিএমের একাংশের বক্তব্য, দল ছেড়ে কোনও নেতাই বিশেষ সফল নন। বাম শিবির থেকে কেউ কেউ অবশ্য তৃণমূলে গিয়ে মন্ত্রী বা সাংসদ হয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, নিজের পৃথক অস্তিত্ব প্রমাণ করাই আগামী দিনে রেজ্জাকের চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে।

এখনও বলছি, আমি বামপন্থার বিরুদ্ধে নই। আমি ভেজাল বামপন্থীদের বিরুদ্ধে!

আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা

খবরটা শুনে থেকে মনে হচ্ছে ওঁকে বলি, ঢের হয়েছে, সারাটা জীবনপার্টিকে দিয়ে যা পাওয়ার তা তো পেলে। বয়সও তো অনেক হল, এ বার বাড়িতে বসে বিশ্রাম নাও।

সাকেদা বিবি, রেজ্জাক মোল্লার স্ত্রী

দলের ভিতরে-বাইরে এখন প্রশ্ন উঠেছে, রবীন্দ্র সদনে সামাজিক ন্যায়বিচার মঞ্চের কনভেনশন আয়োজন করার পরে রেজ্জাক বহিষ্কৃত হলেন, অথচ সে দিন ওই মঞ্চের নীচে বসে আর এক বিক্ষুব্ধ নেতা লক্ষ্মণ শেঠ আলিমুদ্দিনকে যে সব শেলে বিদ্ধ করেছিলেন, তার কী বিহিত হবে? সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের বক্তব্য, “বিষয়টা পূর্ব মেদিনীপুর জেলা নেতৃত্বকে দেখতে বলা হয়েছে। তদন্তের কাজ তাঁরা শেষ করবেন। তার পরে সিদ্ধান্ত।” লক্ষ্মণও এ দিন তমলুক আদালতে হাজিরা দিতে এসে দলীয় নেতৃত্ব সম্পর্কে মুখ খোলেননি। রেজ্জাক শিবির থেকে সিপিএম রাজ্য নেতৃত্বের বিরুদ্ধে এই সূত্রে অভিযোগ তুলে বলা হয়েছে, একই বিদ্রোহে দু’জনের ক্ষেত্রে আলাদা অবস্থান কেন?

দলেরই একাংশের ব্যাখ্যা, আসলে পূর্ব মেদিনীপুরে লক্ষ্মণের প্রভাব এখনও যথেষ্ট বলেই তদন্ত প্রক্রিয়ার কথা বলে সময় নিচ্ছে আলিমুদ্দিন। রেজ্জাকের ক্ষেত্রে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ততটা ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে না বলেই একেবারে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। ভাঙড়, ক্যানিং এলাকায় পঞ্চায়েত ভোটে প্রত্যাশিত ফল হয়নি বামেদের। তা থেকেই রেজ্জাকের ক্ষয়িষ্ণু প্রভাবের কথা দলীয় নেতৃত্ব বুঝতে পেরেছিলেন বলে সিপিএম সূত্রের বক্তব্য।

সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তীর কথায়, “রেজ্জাক মোল্লা পার্টির পুরনো নেতা। তাঁর সম্পর্কে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়াটা নিশ্চয়ই আনন্দের নয়! কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনও বিকল্প দলের কাছে ছিল না।” বারবার তাঁকে সতর্ক করেও লাভ হয়নি। সুজনবাবুর বক্তব্য, “দলে থেকে অন্য দল তৈরি এবং তার হয়ে নির্বাচনে লড়াই করার ঘোষণা কোনও দলেই চলে না। তাই কষ্ট হলেও স্বাভাবিক কারণেই তাঁর সম্পর্কে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rejjak mollah cpm
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE