Advertisement
E-Paper

ভোট-হুকুম না মানাতেই হামলা, অভিযুক্ত শাসক

শাসক দলের ফরমান মানেননি কিছু মানুষ। সেই ‘অপরাধে’ সোমবার রাত থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে একের পর এক হামলা চালানোর অভিযোগ উঠল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। শেষ পর্বের ভোট মিটতে না মিটতেই এমন লাগাতার হামলা শুরু হয়ে যাওয়ায় রাজ্যর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৪ ০৩:০৬
আরএসপি-র সমর্থক পরিবারের দুই মহিলা। (বাঁ দিকে) অন্তঃসত্ত্বা বৌদি এবং তাঁর ননদ। বাসন্তীর গ্রামে। ছবি: সামসুল হুদা।

আরএসপি-র সমর্থক পরিবারের দুই মহিলা। (বাঁ দিকে) অন্তঃসত্ত্বা বৌদি এবং তাঁর ননদ। বাসন্তীর গ্রামে। ছবি: সামসুল হুদা।

শাসক দলের ফরমান মানেননি কিছু মানুষ। সেই ‘অপরাধে’ সোমবার রাত থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে একের পর এক হামলা চালানোর অভিযোগ উঠল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। শেষ পর্বের ভোট মিটতে না মিটতেই এমন লাগাতার হামলা শুরু হয়ে যাওয়ায় রাজ্যর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। যে হেতু এই ধরনের যাবতীয় ঘটনাই ঘটেছে বুথের চৌহদ্দির বাইরে, তাই নির্বাচন কমিশনেরও দাবি, এখানে তাদের কিছু করার নেই। কিন্তু রাজ্য প্রশাসনের দিক থেকেও আস্থা রাখার মতো কোনও পদক্ষেপ দেখতে পাননি ভুক্তভোগীরা। কাজেই দু’দিন পরে ভোটের ফল প্রকাশ হলে পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়াবে, সে কথা ভেবে তাঁরা রীতিমতো আতঙ্কিত!

দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তীর কথাই ধরা যাক। ভোট দিতে যাওয়ায় ‘নিষেধাজ্ঞা’ চেপেছিল আগেই। তা না মানায় এক অন্তঃসত্ত্বাকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে শাসক দলের বিরুদ্ধে। শুধু বাসন্তীই নয়, তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে আসা জনতার উপরে হামলার অভিযোগ মিলেছে ক্যানিং, উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালি, পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল, এমনকী কলকাতা শহরেও। একদা সিপিএমের শক্ত ঘাঁটি বেলেঘাটাতেই ভোটের আগের দিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের হুমকি দেওয়া এবং ভোটার পরিচয়পত্র কেড়ে রেখে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে শাসক দলের বিরুদ্ধে। তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব অবশ্য স্বাভাবিক ভাবেই অভিযোগ মানেননি। লিখিত অভিযোগ না পেলেও বাসন্তীর ঘটনার তদন্ত করছে পুলিশ।

এ রাজ্যের ভোটে তাঁদের মূল নজর যে বুথের উপরেই ছিল, সে কথা কবুল করেছেন নির্বাচন কমিশনের বিশেষ পর্যবেক্ষক সুধীরকুমার রাকেশ। আর সেটা বুঝেই শাসক দল এ বার বুথ থেকে দূরবর্তী এলাকাগুলিকেই বিরোধীদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য বেছে নিয়েছে বলে কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন। বস্তুত, মঙ্গলবারও তৃণমূলের শীর্ষ নেতারা বলেছেন, নির্বাচনকে ঘিরে বা বুথে কোনও ঘটনাই ঘটেনি। বিক্ষিপ্ত ভাবে যেখানে যেটুকু ঘটেছে, তার সঙ্গে ভোটের কোনও সম্পর্কই নেই বলে তাঁরা দাবি করেছেন।

হামলার স্থান নির্বাচনের মতো ‘কাল’-এর ক্ষেত্রেও শাসক দল অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছে বলে বিরোধীদের বক্তব্য। সচরাচর ভোট-পরবর্তী হিংসার প্রকোপ দেখা যায় ফল প্রকাশের পরে। এ রাজ্যে অতীতেও বহু নির্বাচনের পরে হামেশাই তেমন প্রতিহিংসার ঘটনা ঘটেছে। এ বার কিন্তু ফল ঘোষণার আগে নানা এলাকা থেকে হামলার অভিযোগ আসছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে।

এমনকী ভুক্তভোগীদের অনেকের দাবি, তাঁরা তৃণমূলকে ভোট দেবেন না এমনটা আগাম ধরে নিয়ে ভোটের আগে থেকেই উপদ্রব শুরু হয়েছিল। শাসক দলের আতঙ্কিত হয়ে পড়া ছাড়া এমন আচরণের আর কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছেন না তাঁরা! বিরোধীদের বক্তব্য, সারদা-কাণ্ড থেকে মোদী-হাওয়া সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটই শাসক দলকে অস্থির করে তুলেছে।

তৃতীয় দফার ভোট পর্যন্ত মূলত ছিল ব্যাপক রিগিং বা বুথ দখলের অভিযোগ। চতুর্থ দফা থেকে সরাসরি শাসক দলের বিরুদ্ধে তাদের ফরমান অগ্রাহ্য করা ভোটারকে ‘শাস্তি’ দেওয়ার অভিযোগ উঠতে থাকে। আসানসোল লোকসভার পাণ্ডবেশ্বরে ভোটের আগের রাতে (৬ মে) শাসক দলের নেতা-কর্মীরা আমজনতাকে বুথমুখো না হতে বলে গিয়েছিল বলে অভিযোগ। সেই নির্দেশ না শুনে ভোট দিয়ে ফেরার পথে ৭ মে এক প্রতিবন্ধী মহিলাকে হুইলচেয়ার থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয়। তাঁর আত্মীয়কে লাঠি-রড দিয়ে বেধড়ক পেটানো হয় বলে অভিযোগ।

মঙ্গলবার বাসন্তীর কাঁঠালবেড়িয়া গ্রামের লস্কর পরিবারের অভিজ্ঞতা কতকটা একই রকম। তাঁদের দাবি, রবিবার রাত থেকেই এলাকায় বিরোধী দলের সমর্থকদের ভোট দিতে যেতে বারণ করছিল তৃণমূল। আরএসপি সমর্থক নাসির লস্কর এবং তাঁর বাবা এসদান লস্করকেও একই কথা বলা হয়েছিল। সে কথা না শুনে সোমবার ভোট দেন পরিবারের ছয় সদস্য।

তার জেরে এ দিন সকালে স্থানীয় কাঁঠালবেড়িয়া পঞ্চায়েতের সদস্য তথা তৃণমূল নেতা সিরাজ লস্করের নেতৃত্বে আরও কয়েক জন নাসিরের বাড়িতে হামলা করেন বলে অভিযোগ। মারধর করা হয় এসদানকে। নাসিরের স্ত্রী সুরাইয়ার দাবি, শ্বশুরকে মার খেতে দেখে বাধা দিতে গিয়ে ননদের (এঁরও নাম সুরাইয়া) সঙ্গে তিনিও আক্রান্ত হন। বধূটির কথায়, “কত বার বললাম, আমি আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ওরা আমার পেটে লাথি মেরে উঠোনে ফেলে দিল!” তাঁর সংযোজন, “ওরা বারবার বলছিল, ‘এত বার নিষেধ করলাম, তা-ও ভোট দিলি’? মাটিতে পড়ে চোট পেয়েছি। কিন্তু ওদের ভয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও যেতে পারিনি।” বাসন্তী থানা ঘটনার অভিযোগ নিতে চায়নি বলে দাবি করেছে পরিবারটি। থানা সেই অভিযোগ মানেনি। জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পূর্ব) কঙ্করপ্রসাদ বারুই জানান, ঘটনা জেনে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।

তৃণমূলের অবশ্য দাবি, এই ঘটনার পিছনে রয়েছে শরিকি বিবাদ। এলাকার একটি পুকুর থেকে মাটি কাটা নিয়ে নাসিরদের পরিবারের সঙ্গে তাঁর তৃণমূল সমর্থক এক আত্মীয়ার বিবাদ চলছিল। সেই মহিলার সঙ্গে সুরাইয়াদের বিবাদকে রাজনৈতিক কারণে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে, বলেছেন সিরাজ।

ভোট দিতে যাওয়া বাম কর্মী-সমর্থকদের বাড়িতে ভাঙচুর-মারধরের খবর এসেছে ক্যানিং থানার মিঠাখালি, জীবনতলা থানার ঘুটিয়ারি শরিফের শ্রীনগরের মতো এলাকা থেকেও। এ দিনই ক্যানিং মহকুমায় আক্রান্ত কর্মীদের বাড়িতে যান জয়নগর কেন্দ্রের বামফ্রন্ট প্রার্থী সুভাষ নস্কর। তাঁর মন্তব্য, “হেরে যাবে বুঝতে পেরে তৃণমূল ফলপ্রকাশের আগেই প্রতিহিংসার রাস্তা নিয়েছে।”

পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালের মসরপুরে আবার কংগ্রেস কর্মীদের মারধরের অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। কংগ্রেসের দাবি, ‘নিষেধাজ্ঞা’ উপেক্ষা করে ভোট দিতে যাওয়া এবং পোলিং এজেন্ট হওয়ার জেরেই এই হামলা। বিজেপির দাবি, উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালির গোলুবেনিয়া গ্রামে তাদের সমর্থকদের ভোট দিতে বারণ করেছিল শাসক দল। সে ‘ফতোয়া’ না মানায় এ দিন গ্রামে কিছু আদিবাসীর উপরে হামলা হয়। জখম হন জনা কুড়ি। পাঁচ জনকে বসিরহাট হাসপাতালে আনতে হয়। অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে তৃণমূল।

কলকাতা ও তার উপকণ্ঠেও এমন অভিযোগ মিলেছে সোমবার রাত থেকে। সল্টলেক পুরসভার ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে নবপল্লি এলাকায় ভোটের আগে থেকেই শাসক দলের বিরুদ্ধে হুমকি, ভয় দেখানোর অভিযোগ তুলেছিলেন বাসিন্দাদের একাংশ। স্থানীয় সিপিএম সমর্থক রঞ্জিত মণ্ডলের দাবি, নির্দেশ অমান্য করে ভোট দিতে যাওয়াতেই সোমবার রাতে তাঁর বাড়িতে বোমা মারে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা। বিস্ফোরণে বাড়ির একাংশ খসে পড়ে রঞ্জিতবাবুর এক আত্মীয়া মাথায় চোট পান। ঘটনার খবর পেয়ে রাতে এলাকায় যায় পুলিশ। তবে এ দিন পর্যন্ত কেউ ধরা পড়েনি।

বেলেঘাটা-বারোয়ারিতলায় এক সিপিএম কর্মীর পারিবারিক দোকান লাগোয়া ফোন-বুথে ভাঙচুরের ঘটনাতেও অভিযোগের তির শাসক দলের দিকে। ওই পরিবারের প্রবীর ঘোষ জানান, দীর্ঘকাল তাঁরা সিপিএম সমর্থক। পরিবারে ভোটার সংখ্যা ১৬। ভোটের দিন বাড়ির বাইরে না বেরোতে তাঁদের হুমকি দেন এলাকার কিছু তৃণমূল নেতা-কর্মী। কিন্তু প্রবীরবাবুরা ভোট দেন। তার পরেই হামলা। সল্টলেকের মতো বেলেঘাটার ঘটনা নিয়েও অভিযোগ মানেনি তৃণমূল।

বস্তুত, সামগ্রিক ভাবে হামলার অভিযোগকে গুরুত্বই দিতে চাননি তৃণমূল নেতৃত্ব। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের দাবি, “বাংলায় পরিপূর্ণ শান্তি রয়েছে।” দলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন একই সুরে দাবি করেছেন, ‘‘সামান্য কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটেছে।”

বিরোধীরা অবশ্য শাসক দলকেই কাঠগড়ায় তুলছে। রক্তাক্ত নির্বাচনে রাজ্যে গণতন্ত্র কলঙ্কিত হওয়ার অভিযোগ নিয়ে এ দিন রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদে নেমেছিল বামফ্রন্ট। হাওড়ায় প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিয়ে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেন, “তৃতীয় দফার ভোট থেকেই সন্ত্রাস শুরু হয়েছে। ভোটের পরেও তা অব্যাহত।” কোচবিহারের ফরওয়ার্ড ব্লক জেলা সম্পাদক উদয়ন গুহ আবার মন্তব্য করেছেন, প্রথম দফার ভোটে কোচবিহারে গোলমালের পরেই কমিশনের ভরসায় না থেকে বামেরা প্রতিবাদে নামলে ভাল করত! নির্বাচনোত্তর এই হামলাকে রাজ্যের ‘লজ্জা’ বলে মন্তব্য করেছেন প্রদেশ কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য।

বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের অভিযোগ, এ দিন হুগলির ধনেখালির একটি বুথে পুনর্নির্বাচন শেষ করে ফেরার সময়ে তাঁদের দলের কর্মীরা একদল তৃণমূল কর্মীর হাতে আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের গাড়ি ভাঙচুর হয়। সাত কর্মী গুরুতর আহত হন জানিয়ে রাহুলবাবু বলেন, ডায়মন্ড হারবারের কালীতলা এলাকাতেও তৃণমূলের লোকজন বিজেপির সমর্থক গ্রামবাসীদের উপর সোমবার রাত থেকে দফায় দফায় হামলা করছে। প্রশাসনিক স্তরে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাহুলবাবু রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক সুনীল গুপ্তের কাছে দাবি জানিয়েছেন।

basanti samsul huda tmc cpm
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy