Advertisement
E-Paper

‘ভালবাসা’য় মুগ্ধ মুকুল

পুরনো ভূমিকায় খাঁড়া নেমে আসছে প্রায় প্রতি দিন। নতুন ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে জল্পনাও বাড়ছে রোজ। এমন সন্ধিক্ষণে কি নিজের পায়ের তলার মাটি যাচাই করে নেওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি? একই সঙ্গে কি দলকেও বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন, তাঁর শক্তি কোথায়? তৃণমূলের শীর্ষ পর্যায়ে রদবদলের ২৪ ঘণ্টা পরে মুকুল রায়ের দিনযাপন এ সব প্রশ্নকেই আরও উস্কে দিয়ে গেল। দলের জন্মলগ্ন থেকে পালন করে আসা সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব শনিবারই সুব্রত বক্সীর সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার নির্দেশ জারি করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:১৬
নিজাম প্যালেসে অনুগামীদের মাঝে মুকুল রায়। ছবি: রণজিৎ নন্দী

নিজাম প্যালেসে অনুগামীদের মাঝে মুকুল রায়। ছবি: রণজিৎ নন্দী

পুরনো ভূমিকায় খাঁড়া নেমে আসছে প্রায় প্রতি দিন। নতুন ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে জল্পনাও বাড়ছে রোজ। এমন সন্ধিক্ষণে কি নিজের পায়ের তলার মাটি যাচাই করে নেওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি? একই সঙ্গে কি দলকেও বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন, তাঁর শক্তি কোথায়?

তৃণমূলের শীর্ষ পর্যায়ে রদবদলের ২৪ ঘণ্টা পরে মুকুল রায়ের দিনযাপন এ সব প্রশ্নকেই আরও উস্কে দিয়ে গেল। দলের জন্মলগ্ন থেকে পালন করে আসা সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব শনিবারই সুব্রত বক্সীর সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার নির্দেশ জারি করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। তার পরে রবিবার মুকুল প্রায় গোটা দিনটা কাটালেন অনুগামী পরিবৃত হয়ে। নিজাম প্যালেসে কেন্দ্রীয় সরকারি হস্টেল চত্বরে তাঁর ঠিকানায় শুধু কাঁচরাপাড়া থেকে নয়, বিভিন্ন জেলা থেকেও কর্মী-সমর্থকেরা এসে ভিড় জমিয়েছিলেন। তাঁদের বার্তা একটাই দাদার ‘অসময়ে’ তাঁর পাশে দাঁড়াতে চান। দাদার চোখে-মুখেও যেন একটা তৃপ্তির ছাপ আলতো লেগেছিল দিনভর! খুব সরবে কিছু না বলেও যেন একটা বার্তা দেওয়ার চেষ্টা জারি থাকল, দলের আসল ‘সম্পদ’ সাধারণ কর্মীরাই। আর সেই কর্মী-সমর্থকেরা তাঁকে ছেড়ে যাননি।

তৃণমূল নেত্রীর এখন ঘোর উষ্মার কারণ মুকুলের আচরণ! মুকুল কেবলই দলের মধ্যে বিক্ষুব্ধ স্বরের সন্ধান করে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন এবং নিজের শিবিরে ‘নম্বর’ বাড়াচ্ছেন, মনে করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার উপরে শুক্রবার উপনির্বাচনের দিন কল্যাণী, গয়েশপুর, হরিণঘাটা এলাকায় মুকুল ও তাঁর পুত্র শুভ্রাংশু রায়ের অনুগামীদের কাজকর্ম আরও সন্দিহান করে তুলেছে দলের একাংশকে। ওই শিবিরের ধারণা, শেষ পর্যন্ত তৃণমূলের জয়ের রাস্তা বন্ধ করতে না পারলেও কাঁটা দেওয়ার সব রকম চেষ্টা নাকি চালিয়েছে মুকুল-শিবির! এমন চূড়ান্ত অবিশ্বাসের আবহেই এ দিন দুপুরে মুকুলকে ফোন করেছিলেন দলনেত্রী। কিন্তু তাতে বরফ বিশেষ গলার কোনও খবর নেই। অথচ মুকুল থেকেছেন বিন্দাস! যেন অনুচ্চারিত একটা বার্তা দিতে চাইছেন, নেতা-নেত্রীরা কী ভাবলেন, কী সন্দেহ করলেন, তাতে বয়েই গেল! কর্মীরা তো আছেন তাঁর সঙ্গেই!

আলাপচারিতার ফাঁকে মুকুল এ দিন বলেও ফেলেছেন, “দলের কর্মীরা আমায় পছন্দ করে, এটা জানতাম। কিন্তু জানতাম না, এত মানুষ আমায় ভালবাসেন! রাজ্যে প্রায় ৩৩ হাজার গ্রাম রয়েছে। প্রত্যেকটি গ্রামের মন্দিরে বা মসজিদে কেউ না কেউ আমার জন্য প্রার্থনা বা দোয়া করেছেন।” মুকুলের উপলব্ধি, ওরা ভেবেছে দাদার কোনও ‘বিপদ’ হয়েছে। তাই ছুটে এসেছে। তাঁর কথায়, “কিন্তু কী করে বোঝাব, আমার কিছু হয়নি! আমি ভালই আছি!” তৃণমূল নেত্রী ইদানীং দলের অন্দরে বলছেন, তাঁর একদা বিশ্বস্ত সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের কোনও বিশ্বাসযোগ্যতাই নেই! আর কর্মীদের প্রতি মুকুলের আপাত-নিরীহ কৃতজ্ঞতার সুরে যেন ধরা থাকছে তারই জবাব! যেন বোঝাতে চাইছেন, সাধারণ কর্মী-মানুষ যাঁকে ভালবাসেন, তাঁর আবার বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব?

এর পর তিনি কী করবেন, তা নিয়ে মুকুল অবশ্য মুখ খোলেননি। যাবতীয় জল্পনাকে স্রেফ ‘জল্পনা’ বলেই উড়িয়ে দিয়েছেন। তবে একটি সূত্রের ইঙ্গিত বলছে, তৃণমূলের বাইরে পৃথক মঞ্চ বা দল গড়ার লক্ষ্যেই মাপা পদক্ষেপে এগোচ্ছেন মুকুল। প্রয়োজনীয় সৈনিক জোগাড় এবং মোক্ষম মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছেন। আর সেই সময়টুকুতে দূরত্ব বাড়িয়ে নিচ্ছেন দলের সঙ্গে।

এবং এই সুযোগে তৃণমূলের মধ্যে বিবাদের বাতাবরণ উস্কে দিতে কসুর করছে না বিরোধীরাও। কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে এসে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা শাহনওয়াজ হুসেন যেমন এ দিন মন্তব্য করেছেন, “মুকুল রায়ের দলে তাঁর বিরুদ্ধে কিছু চক্রান্ত হচ্ছে! তাই উনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর রেগে আছেন।” তৃণমূলের ভিতরের অবিশ্বাসকে উস্কে দিতে হুসেন আরও বলেছেন, “বাংলায় তৃণমূলের নৌকো এখন ডুবছে। দুর্নীতি বোঝাই ওই নৌকোয় যে বসবে, সে-ই ডুববে! যাঁদের ওই নৌকোয় দমবন্ধ হয়ে আসছে, তাঁদের বন্দরের সন্ধান করা উচিত।”

মুকুল কি কংগ্রেসে আসতে পারেন? প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেছেন, “মুকুল রায় অত বোকা লোক নন যে, অধীর চৌধুরীর কাছে আসবেন! উনি অমিত শাহের কাছে যাবেন। বিজেপি-তে যাবেন। মুকুল বলছেন, আমাকে ধাক্কা মেরে তাড়াও। তবু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ধাক্কা মারছেন না!” মুকুলকে নিয়ে কিছু না বলেও শমীক লাহিড়ী, ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সিপিএম নেতারা আবার আহ্বান জানিয়েছেন, বিজেপি বা কংগ্রেসের কথায় না ভুলে তৃণমূলের মধ্যে ভাল এবং বিক্ষুব্ধ মানুষেরা বরং আসতে পারেন বাম শিবিরেই!

তাঁকে নিয়ে এত রকমের টানাপড়েন এবং জল্পনা যেন উপভোগই করছেন মুকুল! সকালে সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং লক্ষ্মীরতন শুক্লের সঙ্গে বসে টিভিতে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ দেখেছেন। দুপুরেও খেলা দেখতে দেখতে অনুগামীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। খোঁজ নিয়েছেন জেলার অন্য কর্মীদের। ক্রিকেট খেলেছেন কখনও? মৃদু হেসে বলেছেন, “শুধু ক্রিকেট নয়। সব খেলাই আমি খেলতে পারি। ভাল করে না পারলেও, পারি!”

নিজাম প্যালেসের ভিড় বেড়েছে দুপুরে। নীচে নেমে এসে জড়ো হওয়া তৃণমূল সমর্থকদের মুকুল অনুরোধ করেছেন, কোনও বিশৃঙ্খলা যেন না হয়। কোনও স্লোগান, চিৎকার যেন না শোনা যায়। মনে করিয়ে দিয়েছেন, ওই হস্টেলে তিনি ছাড়াও আরও অনেক আবাসিক রয়েছেন। তাঁদের যেন কোনও অসুবিধা না হয়। বিকেলে আবার হঠাৎই এক বার নীচের চত্বরে নেমে এসেছিলেন রাজ্যসভার সাংসদ। অনুগামীরা ঘিরে ধরেছিলেন তাঁকে। ভিড় সঙ্গে নিয়েই সামনের চত্বরটায় এক পাক চক্কর খেয়ে ফের ভিতরে চলেন গেলেন তিনি। কেন এসেছিলেন, বোঝা গেল না! নিজের ‘চাহিদা’ পরখ করতেই কি?

সারা দিন নিজাম প্যালেস চত্বরটা ছিল প্রায় মুকুল-অনুগামীদের দখলেই। তাঁর ছেলে শুভ্রাংশু ছাড়া হাজির ছিলেন দুই বিধায়ক শিউলি সাহা ও শীলভদ্র দত্ত। বিকেলে শঙ্কুদেব পণ্ডাকেও আসতে দেখা গিয়েছে এক বার। চাপা স্বরে জল্পনায় ব্যস্ত ছিলেন অনুগামীরা। তারই মাঝে এক সমর্থক একটু জোরেই বলে ফেললেন, “দিদি ছাড়া আর কোনও নেতার জন্য এত লোক ছুটে আসবে?”

আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনও বিবৃতি দেননি মুকুল। তবে দলে নেতৃত্বের নতুন বিন্যাস নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই ফের বলেছেন, “দল বড় হয়েছে। এখন তো অনেককে দায়িত্ব নিতে হবে! আর যাঁদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাঁরা প্রত্যেকেই সংগঠক হিসেবে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ। এতে দলের ভাল হবে।” দলনেত্রীর সঙ্গে তাঁর এখনও নিয়মিত কথা হয় বলে নিজেই উল্লেখ করেছেন। কিন্তু নেতৃত্বে এই রদবদল নিয়ে তাঁর সঙ্গে তৃণমূল নেত্রীর কোনও আলোচনা হয়েছে কি? এ বার আর মুখ খোলেননি মুকুল!

সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক আছে মঙ্গলবার। তার জন্য আজ, সোমবার দুপুরের বিমানে দিল্লি উড়ে যাওয়ার কথা মুকুলের। দুপুরের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যাবে উপনির্বাচনের ফল। যা নিয়ে মুকুল-ঘনিষ্ঠদের ভবিষ্যদ্বাণী বলছে, “তৃণমূলের জয় নিশ্চিত। তবে মার্জিনটা দেখতে হবে!” ভোটের ফলের জেরে মুকুল-সমীকরণ যখন আবার নতুন উড়ান নিতে পারে, তৃণমূলের প্রতিষ্ঠাতা সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তত ক্ষণে মমতা-নগরী থেকে অনেক দূরে!

mukul roy mamata bandyopadhyay tmc turmoil
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy