Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

মুখচোরা হাসেম কী ভাবে জড়াল, স্তম্ভিত গোটা গ্রাম

রোজ সকালে মাথা নিচু করে নিজেদের জুতোর দোকানে যেত ছেলেটি। সন্ধ্যায় আবার মাথা নিচু করেই বাড়ি ফিরত। এই আধ কিলোমিটার রাস্তায় কোথাও দাঁড়াতে বা কারও সঙ্গে কথা বলতে তাকে বিশেষ দেখেনি কেউ। সকলেই জানত, ছেলেটা মুখচোরা, ধর্মকর্মে মতি। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্তে নেমে বর্ধমানের পূর্বস্থলী থেকে বছর সাতাশের সেই বদ্রু আলম মোল্লা ওরফে হাসেমকেই গ্রেফতার করেছে সিআইডি। অভিযোগ জঙ্গি কার্যকলাপে যুক্ত থাকা।

বর্ধমান থানা থেকে আদালতে নিয়ে যাওয়ার পথে, পূর্বস্থলী থেকে ধৃত হাসেম মোল্লা। ছবি: উদিত সিংহ

বর্ধমান থানা থেকে আদালতে নিয়ে যাওয়ার পথে, পূর্বস্থলী থেকে ধৃত হাসেম মোল্লা। ছবি: উদিত সিংহ

কেদারনাথ ভট্টাচার্য
পূর্বস্থলী শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:২৪
Share: Save:

রোজ সকালে মাথা নিচু করে নিজেদের জুতোর দোকানে যেত ছেলেটি। সন্ধ্যায় আবার মাথা নিচু করেই বাড়ি ফিরত।

এই আধ কিলোমিটার রাস্তায় কোথাও দাঁড়াতে বা কারও সঙ্গে কথা বলতে তাকে বিশেষ দেখেনি কেউ। সকলেই জানত, ছেলেটা মুখচোরা, ধর্মকর্মে মতি।

খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্তে নেমে বর্ধমানের পূর্বস্থলী থেকে বছর সাতাশের সেই বদ্রু আলম মোল্লা ওরফে হাসেমকেই গ্রেফতার করেছে সিআইডি। অভিযোগ জঙ্গি কার্যকলাপে যুক্ত থাকা। সোমবার বর্ধমান আদালতে তোলা হলে তাকে ১২ দিন সিআইডি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু পূর্বস্থলীর পিলা পঞ্চায়েত এলাকার খড়দত্তপাড়ার বাসিন্দারা যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না।

পূর্ব রেলের হাওড়া-কাটোয়া শাখায় পাটুলি স্টেশন থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে খড়দত্তপাড়া। ঘিঞ্জি এলাকা। গলির ভিতরে একতলা পাকা বাড়ি হাসেমদের। দু’ভাই ও চার বোনের মধ্যে হাসেমই বড়। বাবা জব্বার শেখ রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। একটি জুতোর দোকানও আছে তাঁর। বছর কয়েক হাসেমই সেটি চালাচ্ছিল। সেলাই মেশিনও বসিয়েছিল, টুকটাক দর্জির কাজ করত। স্থানীয় সূত্রে পুলিশ জেনেছে, দোকানে অচেনা লোক আসা-যাওয়া করত। জামাকাপড় দেওয়া-নেওয়ার আড়ালেই কিছু জিনিসপত্র আদানপ্রদান হতো বলে পুলিশের একটি সূত্রের সন্দেহ।

ইদানীং দোকান চালালেও হাসেম কিন্তু নিজেকে তৈরি করেছিল কিছুটা অন্য রকম করে। পরিবার সূত্রের খবর, ছ’বছর বয়সে সে গ্রামের একটি মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছিল। বছর দুয়েক পরে তাকে কালনার এক মাদ্রাসায় পাঠানো হয়। বারো বছর বয়সে বীরভূমের সাঁইথিয়ায় একটি মাদ্রাসায় যায় সে। পরে সাঁইথিয়ারই অন্য একটি খারিজি মাদ্রাসার (সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলা এই ধরনের মাদ্রাসায় মূলত ধর্মশিক্ষা দেওয়া হয়) পরীক্ষায় পাশ করে সে ‘মৌলনা’ হয়। সেখানে পড়ার সময়ে স্থানীয় একটি মসজিদে সে ইমামের কাজও করেছিল।

বছর পাঁচেক আগে হাসেম বাড়ি ফেরে। বছরখানেক পরে তার বিয়ে হয়। আড়াই বছরের একটি মেয়েও রয়েছে তার। হাসেমের বাবা জব্বার বলেন, “গ্রামে ফেরার পরে এখানেও বড়ডাঙা মসজিদে কাজ করত ও। সেই সঙ্গে জুতোর দোকানেও বসত। সেখানে সেলাইয়ের যন্ত্র বসিয়েছিল। এ ছাড়া বাড়ি-বাড়ি গুলকয়লা দিত। বছর দুয়েক পরে মসজিদের কাজ ছেড়ে দেয়। ব্যবসা নিয়েই থাকত।” যদিও জেলার এক পুলিশকর্তার দাবি, “হাসেম লিঙ্কম্যানের কাজ করত বলে খবর রয়েছে।” পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, খাগড়াগড় বিস্ফোরণের প্রধান অভিযুক্ত, ফেরার আবুল কালাম এক সময়ে কিছু দিন পূর্বস্থলীতে ছিল। সেই সময়েই হাসেমের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল বলে জানা গিয়েছে।

খাগড়াগড় বিস্ফোরণ-কাণ্ডে পূর্বস্থলীর খড়দত্তপাড়া থেকে গ্রেফতার হয়েছে হাসেম মোল্লা। সোমবার তাঁর

স্ত্রী রেবিনা বিবি দাবি করেন, স্বামী এ সবের সঙ্গে যুক্ত তা তাঁরা বুঝতে পারেননি। নিজস্ব চিত্র।

রবিবার সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ সিআইডি-র একটি দল খড়দত্তপাড়া গ্রামে যায়। সঙ্গে ছিল পূর্বস্থলী থানার পুলিশ। দোকান থেকেই হাসেমকে আটক করে বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়। হাসেমের দু’টি মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করে তাকে নিয়ে চলে যায় সিআইডি। এর ঘণ্টা দুয়েক পরে ফের পুলিশ গ্রামে এসে হাসেমের সম্পর্কিত কাকা হোসাইন মোল্লার বাড়িতে যায়। পরিবার সূত্রের খবর, তিনিও হাসেমের সঙ্গে সাঁইথিয়ার খারিজি মাদ্রাসায় পড়তেন। হোসাইন বলেন, “আমার মোবাইল রিচার্জ করার ব্যবসা। যে সব ফোন থেকে রিচার্জ করি, সেই রকম তিনটি বাজেয়াপ্ত করে পুলিশ। তাতে চারটি সিম কার্ড রয়েছে। কেন সেগুলি বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে, আমায় কিছুই বলেনি। আর কিছু জানতেও চায়নি।”

গ্রামের ফরজ শেখ, ন্যাকাই মল্লিক, গাজি দফাদারদের মতো অনেকেরই প্রশ্ন, “যে লোক ঠিক মতো কথা বলতে পারত না, গ্রামের মানুষ বরং ‘বোকা’ বলেই জানত, সে কী করে এমন কাণ্ডে জড়াল?” হাসেমের স্ত্রী রেবিনা বিবি জানান, বাড়িতেও সে বিশেষ কথাবার্তা বলত না। “আমার স্বামী বরাবরই ধর্মভীরু। সঙ্গে সব সময়ে কোরান থাকত। মোবাইলে ধর্মীয় গান শুনত। সকালে দোকানে যেত, রাতে ফিরত। মাঝে-মধ্যে আমার বাপের বাড়ি ছাড়া কোথাও যেতে দেখিনি। শুধু মাঝে-মধ্যে আমার বাবা অসুস্থ হলে ডাক্তার দেখাতে বর্ধমানে নিয়ে যেত” বলতে-বলতে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে কী ভাবেন রেবিনা। তার পরে যোগ করেন, “আমার স্বামী সম্ভবত চক্রান্তের শিকার!”

সত্যিটা আসলে কী, হাসেমকে হেফাজতে নিয়ে এখন সেটাই জানার চেষ্টা করছে সিআইডি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE